ডাক্তার বাবুর কাছে

ডাক্তার বাবুর কাছে

ডাক্তার বাবুর কাছে (প্রথম পর্ব); -ডাঃ পার্থপ্রতিম; জানুয়ারী- ফ্রেব্রুয়ারী২০০৬; জ্ঞান বিজ্ঞান (ত্রিপুরা) পত্রিকায় প্রকাশিত
প্রায় সকলকেই অসুখে-বিসুখে ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হয়। তবে অনেকেই অসুবিধার কথা সঠিকভাবে বলতে জানি না।ফলে একদিকে আমরা যেমন যথার্থ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হই, অন্যদিকে ডাক্তারবাবুরাও ব্যাপক বিরক্ত এবং উত্যক্ত হন। এই অসুবিধা দূর করতে কলম ধরেছেন- ডাঃ পার্থপ্রতিম।
ছিপছিপে চেহারা মাঝারি গড়ন। নাম শ্যামল সরকার। চা বাগানের কেরানী নিজের পরিচয় দেন রেশনবাবু। ডাক্তারবাবু আপনার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে- ‘বলুন’।
“ গত বছর পুজোর সময় আমি চেন্নাইতে গিয়েছিলাম। আমার ভায়রা তো ইস্টার্ন রেলের কমার্সিয়াল অফিসার। ওই-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এখান থেকে কোলকাতা ফ্লাইটে যাই, তারপর করোমন্ডল এক্সপ্রেসে। চেন্নাইতে ছিলাম রেলের গেস্ট হাউসে। এলাহি ব্যবস্থা, বাথরুমে প্রতি ঘরে ঘরে ঠান্ডা জল-গরম জল, নিচে কার্পেট। জানালা দিয়ে মেরিনা বিচটা সুন্দর দেখা যায়।”
‘ও আচ্ছা’( আমি নিরুত্তাপভাবে )।
“চেন্নাইতে বহু জায়গা ঘুরলাম। পক্ষীতীর্থম, শ্রীপেরামবুদুর, কোকোডাইল ব্যাংক,  ভিজেপি গোল্ডেন বিচ। ভায়রাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রেলের অফিসারদের ব্যাপার-স্যাপারই  আলাদা... ।”
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। সরাসরি বলে ফেললাম- ‘আপনার ভায়রার ব্যাপার-স্যাপারের সঙ্গে আমার ডাক্তারির কী সম্পর্ক একটু বলবেন?’
আসলে ট্রেনে ভারি সুটকেশ তোলার সময় শ্যামলবাবুর ঘাড়ে টান লেগেছিল। অ্যানালজেসিক ট্যাবলেট খাওয়ায় তখনকার মতো তা কমে যায়। এখন মাঝেমধ্যে বেশ ব্যথা হয়। হ্যাঁ, অনেককেই দেখেছি ধান ভানতে শিবের গীত শোনাতে । শারীরিক আপদ-বিপদে প্রায় সবাইকেই ডাক্তারবাবুদের শরণাপন্ন হতে হয়। তবে নিজের অসুবিধার কথা অনেকেই গুছিয়ে বলতে পারেন না বা বলতে জানেন না।
ডাক্তারবাবুর চেম্বারে যাওয়ার আগেই নিজের কী কী অসুবিধার উপশম আপনার চাই তা মনে মনে ঠিক করে নিন। প্রয়োজন হলে টুকরো কাগজে লিখে নিতে পারেন । যেমন- ধরুন আপনার মাথাব্যথা আছে । মাথার ঠিক কোন অঞ্চলে ব্যথা করে, কখন ব্যথা বেশি হয়? সকাল-দুপুর না রাতে? খাওয়ার পর বাড়ে না কমে ? এইসব বিভিন্ন তথ্য কাগজে লিপিবদ্ধ করুন। অসুবিধাগুলি রোগ-যন্ত্রণার তীব্রতা অনুসারে সাজান। অহেতুক বকবক করবেন না। আপনার রোগের গুরুত্ব বুঝে ডাক্তারবাবু নিজেই প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি করে উত্তরটি আপনার থেকে জেনে নেবেন। চিকিৎসকের সামনে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব দেখাবেন না। বিশেষত স্বাস্থ্য সম্বন্ধে। যেমন- পি ডাব্লুউ ডি-র দীপেনবাবু- "ডাক্তারবাবু, কিছুদিন হল কোলাইটিসের প্রবলেমে ভুগছি।"
‘আপনার অসুবিধেটা কী?’
“গলা বুক জ্বালা করে, খিদে লাগে না, ঘুমও কম, বুকের নীচে ব্যথা।”
পরীক্ষায় দেখা গেল দীপেনবাবুর কোলাইটিস নয় হাইপার অ্যাসিডিটি থেকে এপিগ্যাসট্রিক পেন হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে রোগের নাম না  বলে আপনার উপসর্গগুলি বলুন। রোগ নির্ণয়ের দায়ভার আপনার নয় । সেটা যার কাজ, তার ওপরই ছেড়ে দিন। ক্রনিক বা পুরোনো রোগের ক্ষেত্রে আগে যে সব ডাক্তার দেখিয়েছেন তাদের প্রেসক্রিপশন সঙ্গে নিয়ে যাবেন। নিয়ে যাবেন রক্ত-প্রস্রাব এবং অন্যান্য প্যাথলজিক্যাল রির্পোটগুলি। প্রয়োজন মনে করলে ডাক্তারবাবু সেগুলি দেখতে পারেন। 
অনেককেই বলতে শুনি, ডাক্তারবাবু এর আগে আমি অ্যাপেলোতে বড়ো ডাক্তার দেখিয়েছি। অমুক জায়গায় তমুক করিয়েছি ইত্যাদি- ইত্যাদি। এসব কথা আমাদের না বলাই ভালো। ডাক্তার ছোটো-বড়ো হয় না। ডাক্তার কত নামি, কত বেশি তার কনসালটেশন ফি-তার সঙ্গে রোগ আরোগ্যের কোনো সম্পর্কই নেই। তিনি কতটা আন্তরিকতা, মমতা ও মনোযোগের সঙ্গে আপনার সমস্যার বিষয়ে ভাবছেন সেটাই বড়ো কথা। রোগী বা তার পরিবারের কাছ থেকে প্রায়ই বিভ্রান্তিকর ফোন পাই। গায়েত্রী সাহার কথাই ধরা যাক। হাইস্কুলের শিক্ষিকা। কর্তা একই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার।
রাত দশটায় ফোন- “ডাক্তারবাবু ওনার জ্বরটা বেড়েছে।”
 ‘ আপনি কে বলছেন? ’
“ওই যে হার্টের ট্রাবলস ছিল না? জ্বরও ছিল। জ্বর বেড়েছে। বমি হয়েছে, রাতে কিছু খায় নি।”
হ্যাঁ, এভাবে কখনোই ফোন করতে নেই । যদি ফোন করার প্রয়োজন হয়, তার আগে কী বিষয়ে আপনি চিকিৎসকের পরামর্শ চান তা ঠিক করে নিন। ফোনে কথা বলার সময় তাড়াহুড়ো করবেন না। প্রথমে নিজের নাম, রোগীর নাম, বয়স ডাক্তারবাবুকে জানান। শেষ কবে দেখিয়েছিলেন তাও বলবেন । তারপর ধীরে ধীরে সমস্যার কথা বলুন। ফোন করার আগে হাতের কাছে কাগজ-পেন রাখুন। ডাক্তারবাবু যদি কোনো নতুন ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দেন, তা লিখে নিন। আপনার প্রিয়জনের যে সমস্যা আছে তার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট তথ্য ডাক্তারবাবুকে জানান। যেমন, যদি রোগী রাতে বমি করে থাকেন, তাহলে জানাতে হবে দুপুরে কী খেয়েছিলেন? পেট ব্যথা আছে কী না? আজ পায়খানা হয়েছে কি? এসবই জানাবেন।
 নাড়ির গতি প্রকৃতি চিকিৎসাশাস্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় এটি জানা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষত যাদের কার্ডিয়াক প্রবলেম আছে। হৃদযন্ত্রের চুপসে যাওয়া ও বড়ো হওয়ার কারণে রক্তের নালিগুলি যে টিপটিপ করে সেটাই নাড়ি। হাতের কবজির কাছে বুড়ো আঙুলের দিকে যে রেডিয়াল ধমনী (রেডিয়াল আর্টারি) থাকে, তার ওপর তর্জনি, মধ্যমা ও অনামিকার সাহায্যে অল্প চাপ দিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করা হয়। হাত ছাড়াও কপালের দু-পাশে, গলায় এবং আরো কিছু জায়গায় নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যায়। তবে কবজিতে নাড়ি দেখাই সুবিধা, এখানে রেডিয়াল আর্টারি চামড়ার ঠিক নিচেই থাকে। পুরুষদের ডান হাত ও মহিলাদের বাঁ হাতের নাড়ি দেখাই ডাক্তারি রীতি ।
প্রতি মিনিটে নাড়ির স্পন্দন কতবার হচ্ছে? নাড়ি অনিয়মিত হচ্ছে কিনা? যেমন আপনি যদি নাড়ির তালে তালে গুনতে থাকেন, তবে অনিয়মিত নাড়ির ক্ষেত্রে ১, ২, ৩-৫, ৬, ৭-৯ এমন হতেই পারে। অর্থাৎ মাঝে মাঝে একটি স্পন্দন বোঝা যাচ্ছে না। এসব তথ্য ডাক্তারবাবুকে ফোনে অবশ্যই জানাবেন। বিশেষত যদি আপনার প্রিয়জনের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়ে থাকে ও তাঁর হৃদয়ে বাসা বেঁধে থাকে কোনো সুখনাশকারী অ-সুখ।
ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার করবেন। অতিরিক্ত বিনয় ঠিক নয়। মিসেস সেঁজুতি রায় চেম্বারে এলেই শুরু করে দেন- ‘ডাক্তারবাবু আপনি ধন্বন্তারী। মিসেস দত্ত তো সবসময় আপনার কথা বলেন। ও তো ভেলোরেও গিয়েছিল। কিন্তু আপনার ওষুধ খেয়েই ভালো আছে ।’ -এ ধরনের তেল মাখানো কথা বেশি না বলাই ভালো । ডাক্তারবাবুরা এসব বুঝতে পারেন। তারা বোকা নন। বোকারা স্বনামধন্য আধুনিক কবি বা আর যাই হন না কেন, সফল চিকিৎসক হতে পারেন না ।
আমরা প্রেসক্রিপশনে আপনার প্রয়োজনীয় ওষুধ লেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ওষুধগুলি খাওয়ার পদ্ধতি সাংকেতিক ভাষায় লিখি। এই ভাষা বুঝতে অনেককেই ফার্মেসিতে বা কমপাউন্ডারবাবুর কাছে ছুটতে হয়।এই সাংকেতিক নির্দেশগুলি আপনার নিজের জানা থাকলে খুবই সুবিধা হবে। যেমন-  Tab-ট্যাবলেট, Tinc - টিংচার, Cap - ক্যাপসুল, Lot-লোশন,  Oint-মলম, Lini-মালিস করার ওষুধ, B.D -দিনে দু-বার ,  T.D.S-দিনে তিনবার, Q.D.- দিনে চারবার, C.M.-পরদিন সকালে, Q.S.-প্রয়োজন মতো মাত্রায়, H.S.-রাতে শোওয়ার সময়, T.S.F-এক চামচ ভর্তি, Inj.-ইঞ্জেকশন, I.M.-ইন্ট্রামাসকুলার ( পেশিতে ইঞ্জেকশন ),   I.V. -ইন্ট্রাভেনাস ( শিরাতে ইঞ্জেকশন ), Subcut -সাবকিউটেনিয়াস (ত্বকের নিচে ইঞ্জেকশন )    Start- এখনই শুরু করুন।


ডাক্তার বাবুর কাছে (দ্বিতীয় পর্ব); -ডাঃ পার্থপ্রতিম; এপ্রিল ২০০৬; জ্ঞান বিজ্ঞান(ত্রিপুরা) পত্রিকায় প্রকাশিত
টাবুল মা-বাবার একমাত্র ছেলে। মাসি-দিদুর নয়নমণি। রাত দশটার সময় টাবুলের ইচ্ছা হল মোমো খাবে। ছোট মামা টিফিন- বাক্স হাতে ছুটলেন মোমোওয়ালার বাড়ি। পড়াশুনায় যথারীতি লবডঙ্কা, টিভির কার্টুন চ্যানেলের পোকা।
    এ হেন টাবুলের জ্বর সর্দি হয়েছে। সারা বাড়ি বিষাদে বিরস। চার পাঁচজন অভিভাবক পরিবেষ্টিত হয়ে আমার ক্লিনিকে হাজির , তার শারীরিক অসুবিধার কথা বলতে সবাই সরব। পাঁচজনের সমস্বর বাক্-উচ্ছ্বাসে আমার কান-মাথা ভোঁ ভোঁ। শুধু টাবলু কেন? অনেককেই দেখি পাঁচ ছয়জন আত্মীয় পরিজন নিয়ে ডাক্তারখানায় হাজির হতে । রোগী যদি খুবই অসুস্থ হন বা চলৎশক্তিহীন থাকেন তবে অন্য কথা। তা যদি না হয় তবে দল বেঁধে ফুচকা খেতে যেতে পারেন; ডাক্তারখানায় যাওয়ার কোনো অর্থ নেই। রোগীর কষ্ট তাকেই বলতে দিন। তা না হলে বাড়ির কোনো একজন কথা বলুন। একসাথে একাধিক ব্যাক্তির কথা শোনা সবার কাছেই বিরক্তিকর। এতে রোগ নির্ণয় উল্টোপাল্টা হয়ে যেতে পারে।
কারো কারো  মধ্যে দেখতে পাই এক উদ্ভট বাতিক। মনের মধ্যে সবসময় রোগ রোগ ভাব। ‘‘আমার না বড় অসুখ, আমি বোধ হয় বেশিদিন বাঁচবো না’- এসব কথা পারিপার্শ্বিক লোকদের শোনাতে থাকেন। এই ধরনের বাতিকগুলিতে কখনোই প্রশ্রয় দেবেন না। বেশি সান্ত্বনা দেবার বা বোঝানোর দরকার নেই। আশেপাশের সবার উচিত এ বিষয়ে উদাসীন থাকা। মনোবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে শোনার লোক কাছে পেলে রোগবিলাস বেড়ে যায়।
অনেকে আবার বড় বড় রোগের নাম শুনতে ভালোবাসেন। ঘটনাটি প্রফেসার দাশগুপ্তের কাছে শোনা। বিধানচন্দ্র রায় তখনো মুখ্যমন্ত্রী হননি। চিকিৎসক হিসাবে তার বিরাট নাম-ডাক। অধ্যাপকের তখন ছোকরা বয়স, ডাঃ রায়ের আন্ডারে কাজ করছেন। একদিন দুপুরে এক সভ্রান্ত মহিলা গাড়িতে মেয়েকে বসিয়ে ডাঃ রায়ের চেম্বারে হাজির। বিধান রায় সে সময় চেম্বারে ছিলেন না। এদিকে ভদ্রমহিলার চৌদ্দ বছরের মেয়ে কানের ব্যথায় অস্থির। অবশেষে ভদ্রমহিলা হতাশ হয়ে ডাঃ দাশগুপ্তকে অনুরোধ করলেন একটু দেখে দেওয়ার জন্য। ডাঃ দাশগুপ্ত দেখেশুনে বললেন- ‘‘তেমন কিছু না; কানে একটা ফোঁড়া হয়েছে।” ওষুধ দিয়ে বললেন তিনদিন পর আবার একবার দেখিয়ে যেতে। সেদিন সন্ধ্যাতেই আবার ভদ্রমহিলা চেম্বারে হাজির। মেয়েটা কিছুটা শান্ত। তখন বিধান রায় ক্লিনিকে উপস্থিত। ভদ্রমহিলা এসে বললেন- ‘‘ডাঃ রায়, দুপুরে এসেছিলাম  আপনি ছিলেন না, উনি ছিলেন। উনি তো বললেন বেবির কানে নাকি ফোঁড়া হয়েছে। আপনি একটু দেখুন না।’’ বিধান রায় সব দেখেশুনে বললেন- ‘‘এ তো খুব বড় অসুখ। ওটাইটিস ডিউ টু ফ্রাংকিউলোসিস। নতুন করে  ওষুধ লিখে দিলেন। ভদ্রমহিলা খুশি মনে আত্মতুষ্টি নিয়ে চলে গেলেন। পরে ডাঃ বিধান রায় ডাঃ দাশগুপ্তকে ডেকে বললেন- ‘‘এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ডাক্তার হবে? সময় মনে রাখবে; বড়লোকদের ফোঁড়া-পাঁচড়া এসব বলতে নেই।” আসলে ফোঁড়া থেকে কানে ব্যথা হলে ডাক্তারি ভাষায় আমরা তাকে ওটাইটিস ডিউ টু ফ্রাংকিউলোসিস বলি।
হ্যাঁ, এই বড় বড় রোগের নাম শোনার প্রবণতা এখনো অনেকের মধ্যে দেখতে পাই। বিশেষত উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে এটা খুবই প্রকট। যখন বলি, ‘রুবি দেবী  আপনার এটা বাতের ব্যথা বলেই মনে হচ্ছে, শুনে মুখটা কেমন ব্যাজার করেন, আবার যখন বলি ‘আপনার রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয়েছে’। বেশ খুশি খুশি ভাব। পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-পরিজনদের কাছে বড় মুখ করে বলার মতো রোগ। হায় ভগবান! এদের কে বোঝাবে? কোনো বড় রোগ হওয়া গর্বের বিষয় হতে পারে না। বরঞ্চ, আপনি সুস্থ, সবল, নীরোগ দেহের অধিকারী এটা আপনার গর্ব করার মতো বিষয়।

এখন তো অনেক কথা শোনা যায়-  ডাক্তারবাবুরা অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের সবসময় টু-পাইস ইনকামের ধান্ধা। প্যাথলজিক্যাল ল্যাব থেকে কমিশন খান। তাই অপ্রয়োজনে হেনতেন পরীক্ষা করান . . .  ইত্যাদি-ইত্যাদি। তা সে মন্ত্রী থেকে শুরু করে কোয়ার্টার নেতা; সকলে সুযোগ পেলে গলা ছেড়ে ডাক্তারদের গাল পারেন। তবে আমরা এমনও দেখি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট না করলে অনেক পেশেন্ট মনঃক্ষুন্ন হন। যেমন সেঁজুতি সাহা তার আড়াই বছরের মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সর্দি-কাশি-জ্বর, ভাইরাল ফিভার। ওষুধ খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সেরে যায়। না খেলে পুরো সাতদিন লাগে। সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে নিষেধ-বারণ জানিয়ে দিলাম। মন ভরলো না। মায়ের আকুল উৎকণ্ঠা, ‘‘ ডাক্তারবাবু রক্ত পরীক্ষা করতে হবে না?’’ বললাম - অহেতুক খরচ করে, সূঁচ ফুটিয়ে লাভ কী? তৎক্ষণাৎ উত্তর- ‘‘ না, না আপনি খরচের কথা ভাববেন না।’’
কত আর বোঝানো যায়। রক্তের টিসি-ডিসি, ই এস আর এই সব পরীক্ষা লিখে দিলাম। পরদিন প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেখে কয়েকটি জেনারেল টনিক প্রেসক্রাইব করলাম। ভাইরাল ফিভার তো ওষুধ ছাড়া আপনিই ঠিক হয়ে যায়, ঠিক তেমনটিই হল। বাড়ির সবাই আহ্লাদে আটখানা। যে কথাটা বলছিলাম। অনেক রোগী বা তার পরিজন মনে করে দামি দামি টনিক খেলেই চেহারা ফিরে যাবে। তাই যদি হতো তবে দেশের সব পয়সাওয়ালা পুরুষেরা ঋত্বিক-সলমন ও মহিলারা প্রীতি জিন্টা মাধুরী দীক্ষিত হয়ে যেতেন। আসলে আমরা যাই খাই না কেন তা পরিপাকতন্ত্রের দীর্ঘপথ পেরিয়ে ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছায়। ক্ষুদ্রান্তের গায়ে থাকা ভিলাই নামক পর্দার দ্বারা শোষিত হয়ে রক্তে মেশে। তারপর রক্তের মধ্য দিয়ে দেহের কোষে কোষে পৌঁছায় ও পুষ্টি যোগায়। খাদ্যের সব অংশ যে ক্ষুদ্রান্ত থেকে শোষিত হবে এমনটি নয়। অনেকটাই মল ও মূত্রের  মাধ্যমে দেহের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ কী খেলেন এটা যেমন প্রয়োজনীয়; তার চেয়েও জরুরী বিষয় হলো কতটা আপনি আত্তীকরণ বা অ্যাসিমিলেট করলেন। টনিক জাতীয় ওষুধ কম ক্ষেএেই প্রয়োজন হয়। বিষয়টা যতটা না শারীরিক, তার চেয়েও বেশি মানসিক। আপনি ভাবলেন - আমি ভিটামিন, টনিক খাচ্ছি তাই একটু বল পাচ্ছি। এই মনোবলই আপনার শক্তির যোগানদার। সত্যি কথা বলতে কী টনিক খেয়ে যতটা না রোগীর লাভ হয়, তার চেয়েও বেশি লাভ হয় তাদের যারা টনিক প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা।
শৈশবের কথা মনে পড়ে। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার জ্যেঠতুত-খুড়তুত ভাইবোন নিয়ে বিরাট পরিবার। আশি পার করা ঠাম্মা ছিলেন পরিবারের মাথা। তার কোলেপিঠে দশজন বাচ্চা-কাচ্চা বড় হয়ে গেছি। মা-বাবার ফুরসৎ ছিল না আমাদের প্রতি স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়ার। এখনও অবস্থা অন্যরকম। মা-বাবার সবেধন নীলমণি ডমি। ডমির বাবা তার বাবা- মা থেকে আলাদা হয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। মা-র কমান্ডো দৃষ্টি সদাসর্বদা ডমির দিকে। মাসে প্রায় দশ-বার  দিন ক্লিনিকে হাজির । ‘‘ডাক্তারবাবু আজ না ডমির তিন-তিনবার হাঁচি হয়েছে। গতকাল চার পাঁচবার কাশি হয়েছিল।’’
হ্যাঁ, এসব নিয়ে ভাবার কোনই কারণ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে বেশির ভাগ অসুখ আপনা আপনি সেরে যায়। আমাদের দেহের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলি ইমিউনিটি সিস্টেম। অকারণে বা অল্প কারণে বেশি বেশি ওষুধ খেলে ইমিউনিটি সিস্টেম বিগড়ে যেতে পারে।
নৃতত্ত্ববিদেরা বলেন পৃথিবীতে মানুষ বা হোমোসেপিয়েন্স এসেছে তিন লক্ষবছর আগে। আয়ুর্বেদ চার হাজার বছর। আর  অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি  হিপোক্রেটিস এর সময় ধরলে বড় জোর আড়াই হাজার বছর। তার আগেও প্রকৃতির বুকে মনুষ্য প্রজাতি টিকে ছিল। বেঁচে ছিল মূলত রোগ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে সম্বল করেই। আজ বিশ্বের বেশির ভাগ চিকিৎসাবিজ্ঞানী একমত হয়েছেন - যে অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার ফলে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম নষ্ট হতে চলেছে। আমরা দ্রুত পদক্ষেপে চলেছি যমদুয়ারের অভিমুখে।

Join our mailing list Never miss an update