বানারহাটের মধুবনে নীতিশিক্ষার পাঠশালা; ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বানারহাট, ১৫ ডিসেম্বর: একসময়ে শিশুদের মনোরাজ্য জুড়ে ছিল এদের বাস। ঠাকুরদা-ঠাকুমা বা দাদু-দিদার গল্পগাথা থাকত তাদের নিয়েই। ঘুমপাড়ানি সেই কথাকাহিনিতে থাকত সেই দুষ্টু ছেলের কান্ডকারখানা, যে পড়শিদের নাজেহাল করতে অযথা বাঘ বাঘ চিৎকার করে সকলকে জড়ো করত। অথবা সেই দুই বন্ধু যার একজন ভালুক দেখে বন্ধুকে ফেলে একাই উঠে গিয়েছিল গাছের মগডালে। বর্তমানে শিশুদের জগতে ডোরেমন, পোকেমন, নিনজা হাথোরি ইত্যাদি ভিনদেশি সুপার হিরোর দাপটে এরা এখন প্রায় রাজ্যছাড়া।
পুরোনো দিনের নীতিমালার সেই গল্পগুলিকে শিশুমনে ফিরিয়ে আনতে এক অভিনব পন্থা নিয়েছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। পেশায় হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক এই মানুষটির বাড়ি বানারহাট আদর্শপল্লির ২ নম্বর সরণিতে। বাড়ির নাম রেখেছেন মধুবন। বাড়িটির দেয়ালজুড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নীতিশিক্ষার সেই চিরনবীন গল্পগুলিকে। রংতুলির টানে কোথাও ফুটে উঠেছে কচ্ছপের কাহিনি যে নিরলস শ্রম ও নিষ্ঠার জোরে দৌড় প্রতিযোগিতায় হার মানিয়ে দেয় দ্রুতগামী খরগোশকে, বুদ্ধিমান সেই কাকের জলপানের গল্প, কোথাও আবার শিকারির জাল কেটে ছোট্ট ইঁদুর বাঁচিয়ে দেওয়া কলশালী সিংহকে। এমন বহু গল্প ফুটে উঠেছে সবুজ লনের চারধারে। গাছগাছালিতে ঘেরা এই বাড়িটিতে আছে রকমারি ফুলের গাছ, বনসাই, হাঁস, হরিণশিশু, নানা ধরনের পাখি ইত্যাদির বহু মডেল।
তাঁর এই প্রয়াস প্রসঙ্গে ডাঃ পার্থপ্রতিম বলেন ‘বর্তমানে বিভিন্ন কার্টুন চ্যানেলের দাপটে শিশুদের মধ্যে আজগুবি, অবাস্তব সব চরিত্রের অন্ধ অনুকরণ শুরু হয়েছে। যার সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। শৈশব, কৈশোরে নীতি ও মূল্যবোধের যে শিক্ষাগুলি গল্পচ্ছলে আমরা পেয়েছি, বর্তমান শিশুরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে নীতিহীনতা ও হতাশায় ভুগছে আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ। এই ফাঁকফোঁকরেই হানা দিচ্ছে ব্লু হোয়েলের মতো গেম।’
মধুবনকে ফুটিয়ে তোলার কাজে শিল্প নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন কোচবিহারের চিত্রশিল্পী প্রসেনজিৎ ভৌমিক। প্রসেনজিৎবাবু জানান, কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা ঈশপের গল্পকে নিয়েছি। তবে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সেগুলিকে ভারতীয় ভাবনা ও বাঙালি আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় গাথা- বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য, নির্বুদ্ধিস্য কুতঃ বলম, খরগোশ- সিংহের সেই ছবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে ঈশপের ধূর্ত শেয়াল ও কাকের। ছবিগুলির মধ্যে একটি অন্তনির্হিত মিল রাখা হয়েছে। ছবিগুলি এঁকেছেন আদিবাসী শিল্পী গণেশ মাহালি।’
বানারহাটের মধুবনে এই অভিনব নীতিশিক্ষার পাঠশালায় মাঝেমধ্যেই ভিড় জন্মায় খুদে শিশুরা। আশপাশের শিশুশিক্ষাকেন্দ্র বা সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আসেন এই গল্প দেখার আসরে। ছবিগুলিতে কোনো শিরোনাম নেই। অভিভাবকেরা বা শিক্ষকেরা গল্পগুলি নিজেদের মতো বুঝিয়ে বললেন, এটাই পরিকল্পনা করেছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম। তিনি ও প্রসেনজিৎবাবু বলেন, বর্তমানে দাদু-দিদা-পিসি-কাকা বর্জিত নিউক্লিয়ার পরিবারে এখন শিশুদের একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণহীণ স্মার্টফোন। এক অদ্ভুত একাকীত্ব চেটেপুটে খাচ্ছে শৈশবকে। এই পাঠশালা সেই কচিকাঁচাদের মগজে নতুন ভাবনার জোগান দেবে।