ঋজু কিচ্ছুই খায় না

ঋজু কিচ্ছুই খায় না

ঋজু কিচ্ছুই খায় না- সব মোনালিসাদের একই কথা; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১২ জুন ২০১০ পৃষ্ঠা- নয় -উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
সময় হলেই এক হুলুস্থুল কান্ড। আগে আগে ছুটছে ঋজু পেছনে পেছনে ছোট্ট ডিস হাতে মোনালিসা দেবী। ঋজু আর খাবে না, মোনালিসাও তাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। খাবার সময় হলেই নিত্য দিনের হাউস ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ।   
হ্যাঁ, শুধু ঋজু কেন? স্নেহা- সাম্য- পহেলী সবার মা-ই তো একই বগর বগর করে- “ডাক্তারবাবু, আমার  বাচ্চাটা না সত্যিই একদম কি-ই-ছ- ছু খায় না।” আমার মতো চিকিৎসক যাদের শিশু নিয়ে বেশী নাড়াচাড়া করতে হয়; তাদের তো এ অভিযোগ শুনে শুনে কান-মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।
বেশী কথায় যাবার আগে আমাদের খিদে লাগার ও খাওয়ার ব্যাপারটি ছোট্ট করে বুঝে নেওয়া যাক। অন্যসব বিষয়ের মতো আমাদের খিদে, তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। খিদে পাওয়া ও খাবার হজম করা বিষয়টির মধ্যে দুটি বিষয় লুকিয়ে আছে। প্রচলিত ভাষায় একে আমরা বলি আনকন্ডিশনাল ও কন্ডিশনাল বিফ্রেক্স অ্যাকশন। বাংলায় অনপেক্ষ ও সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সোভিয়েত জীব বিজ্ঞানী আইভান পাভলভ এক মজার বিষয় লক্ষ্য করলেন। তিনি একটি ঘন্টা বাজিয়ে কুকুরকে খাবার দিতেন। কিছুদিন পরে অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলেন ঘন্টার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরের জিভ দিয়ে জল পড়ছে। অর্থাৎ মুখে লালাগ্রন্থি থেকে লালারস নিঃসৃত হচ্ছে। এ ঘটনা দেখার পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাভলব সাহেব বললেন “ কিছু কিছু ক্রিয়া আছে যা বাইরের উদ্দীপকের প্রভাবে পরিচালিত হয়। যেমন - আচার-তেঁতুল দেখলে মুক্তুর জিভে জল আসে। এগুলি হল শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া। আর কিছু ক্রিয়া বাইরের উদ্দীপকের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। যেমন- খাবার পর পিত্তথলি থেকে পিত্তরস বা বাইলের নিঃসরণ। এগুলি অনাপেক্ষ প্রতিবর্তক্রিয়া।
সে শিশু হোক বা বুড়োধারী। খাবারের সময় মুখে সবারই লালা ঝরে। এছাড়াও মুখগহ্বরকে সবসময় ভেজা রাখতে অতি সামান্য পরিমাণে লালারস ক্ষরিত হতে থাকে। তাই আমরা জিভ নাড়িয়ে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারি। খাবার সুস্বাদু ও সুগন্ধি হলে প্রচুর পরিমাণে লালা নিঃসৃত হয়। অপছন্দের খাবারে লালা ঠিকমত বেরিয়ে আসেনা। আমাদের মুখের ভেতর তিন জোড়া লালাগ্রন্থি আছে। দুই কানের নীচে থাকে প্যারোটিড গ্ল্যান্ড। নীচের চোয়ালের ভেতরে থাকে সাব ম্যাক্সিলারী গ্ল্যান্ড আর সাব লিঙ্গুয়াল গ্ল্যান্ড থাকে জিভের নিচে দু’পাশে। এইসব লালাগ্রন্থি থেকে বেড়িয়ে আসা লালারসে থাকে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম।
 পাকস্থলীর জারকরসে একমাত্র উৎসেচক বা এনজাইম হল লাইপেজ। এটি দুধ বা মাখনে থাকা ফ্যাটের ওপর ক্রিয়া করে মনোগ্লিসারাইড, গ্লিসারিন এবং ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরী করে। বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের জারকরসে এই এনজাইমের উপস্থিতি বেশি থাকে। এটি দুধ ও ডিমের কুসুমে থাকা ফ্যাটের ওপর ক্রিয়াশীল। সে কারণে শিশুরা বয়স্কদের চেয়ে দুধ ও আধ সিদ্ধ ডিম তাড়াতাড়ি হজম করতে পারে।

আমাদের খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকেই। মস্তিষ্ক বা ব্রেনের বেশীরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে সেরিব্রাল কর্টেক্স অংশ। এখানে হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলে রয়েছে দুটি কেন্দ্র যাকে বলি ‘ফিডিং সেন্টার’ আর ‘স্যাটাইটি সেন্টার’। বাংলা তর্জমা করে বলা যায় ‘খিদে কেন্দ্র’ ও ‘তৃপ্তি কেন্দ্র’। যখন আমাদের পেট বা পাকস্থলী খালি থাকে তখন রক্তের শর্করা বা গ্লুকোজে মাত্রা কমতে থাকে। রক্তে শর্করার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে কমে গেলে মগজ ফিডিং সেন্টারকে স্টিমুলেন্ট বা উদ্দীপিত করে; ফলে আমাদের খিদে লাগে। আমরা তখন কিছু খেতে চাই। আবার পরিমাণ মতো খাওয়ার পর স্যাটাইটি সেন্টার উদ্দীপিত হয় মন বলে - ‘ না, বাবা অনেক খেয়েছো এবার উঠে পড়ো, হাত-মুখ ধুয়ে নেও’।
অর্থাৎ পেট খালি থাকলে ফিডিং সেন্টার স্টিমুলেট হবে বাচ্চা খেতে চাইবে। আর পেট ভরা থাকলে স্যাটাইটি সেন্টার উদ্দীপ্ত থাকে বাচ্চা খেতে চাইবে না। তবে হ্যাঁ, এই সব কাজকারবারের মধ্যে একটা ফাঁক আছে। রক্তে শর্করার মাত্রা বা পাকস্থলী খালি থাকা বা ভর্তি হওয়ার জন্য সবসময় যে খিদে কেন্দ্র বা তৃপ্তি কেন্দ্র উদ্দীপিত হবে তা কিন্তু নয়। আমাদের দেহে থাকা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র বা অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের প্রভাবেও স্টিমুলেট হতে পারে ফিডিং ও স্যাটাইটি সেন্টার। এমনটি হলে ভরা পেটেও খিদে লাগতে পারে, যাকে আমরা চলতি কথায় বলি ‘ চোখের খিদে ’। আবার খালি পেটে থাকলেও বাচ্চা খেতে না চাইতে পারে।   
অর্থাৎ খিদে জাগিয়ে তুলতে শুধু যে পাকস্থলী খালি থাকা বা শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া যে একমাত্র বিষয় তা নয়। এর সাথে রয়েছে আরো বহু কিছু। শিশুর মানসিক অবস্থা, তার চারপাশের পরিবেশ, খাবারের মেনু, তার পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, আরো অনেক ব্যাপার-স্যাপার। বাচ্চার মনমেজাজ ভালো না থাকলে সে খালি পেটে থাকলেও খেতে চাইবে না। যেসব বাচ্চা মা- বাবা ও অন্য শিশুদের সঙ্গ ঠিকমতো পায় না; তাদের অবচেতন মনে একাকিত্ব দেখা দেয়। তাছাড়া মা- বাবার মধ্যে যদি প্রায়ই ঝগড়া- ঝামেলা লেগে থাকে সেক্ষেত্রে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। বাচ্চার সাথে গল্প করা, তার সাথে খেলা এগুলি খুবই দরকার। দামী দামী খেলনা, দামী পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে ভালবাসা প্রকাশ করতে যাবেন না। ওর আশেপাশে অন্য সব শিশু যে ধরনের জামাকাপড় পড়ে, যে ধরনের খেলনা নিয়ে খেলে আপনার সোনামণিকে আপনি সেরকমই দেবেন। বেশী দামি কিছু দিতে যাবেন না। তাতে আপনার বাচ্চার সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ও ওর সঙ্গীসাথিদের  ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স দেখা দিতে পারে। ঋজুবাবু তার সঙ্গীসাথিদের সাথে ঠিক মতো মিশতে পারবে না। দেখা দেবে খাবার, পড়াশুনা বিভিন্ন বিষয়ে অনিহা।
আগে এই শিশুদের খাবারের ব্যাপারে এত ঝামেলার কথা শোনা যেত না। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল বেশি। শিশুরা আপনমনে খেলে খেয়ে কখন যেন বড় হয়ে যেত। আমাদের শৈশব কেটেছে ঠাম্মার কোলেপিঠে। ঠাম্মা খাবার মেখে দলা দলা করে থালায় সাজিয়ে দিতো। স্বরচিত ছড়া কেটে বলতো-‘ কাকে খায় না বকে খায়...’ আমরা জ্যেঠুতোতো, খুড়তুতো নয়-দশজন ভাইবোন বর্গীদের মতো ঝাপিয়ে পড়ে সব সাবার করতাম। এখন সময় পাল্টেছে। হাম দো হামারা একের জামানা। সংসার যত ছোট মা- বাবার ব্যস্ততা তত বেশী। বাবা-মার কমান্ড দৃষ্টি সবসময় সোনামনির ওপর। শিশু কি খাচ্ছে? কি শিখছে? কি ধরছে? সব বিষয়ে সবসময় তীক্ষ্ন নজর। তাছাড়া এখন চট জলদির যুগ। গাদাগাদা খেয়ে সোনামনি রাতারাতি সলমান খান, সুনীল শেট্টী হয়ে উঠুক- এটাই তাদের কামনা-বাসনা।
আমরা দৈনন্দিন যে খাবার খাই তার সিংহভাগ দখল করে থাকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাদ্য। অর্থাৎ ভাত, আলু, রুটি এইসব। লালারসে থাকা টায়ালিন ও ম্যালটোজ এনজাইম শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যকে পরিপাক করে। সেকারণে খাওয়ার সময় লালারসে নিঃসরন ও খাবারের সাথে তা ভালোভাবে মেশা জরুরি। তা না হলে সে খাদ্য ঠিকমত হজম হতে পারে না।
অনেক মা আবার শিশুর খাবারের বিষয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে পড়েন। খাবার নিয়ে সবসময় বাচ্চাকে জোড়াজুড়ি করতে থাকেন। শিশুও ভেবে বসে তার খাবার খাওয়াটা মা-বাবার কোন বিশেষ কাজ। সে তার খাবার খেয়ে বাড়ির লোকদের উদ্ধার করে দিচ্ছে।
শিশুর পুষ্টি নিয়ে বেশ কিছু মা-বাবার মধ্যে উদ্ভট ধারণা আছে। তেল-মশলা ছাড়া ট্যালটেলে হলুদ গোলা জলে ভাসতে থাকা অতিসিদ্ধ শিংগি বা মাগুরমাছ, আলু, কাঁচাকলাকে অনেকে শিশুর পক্ষে সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার বলে মনে করেন। দিনের পর দিন এসব অখাদ্য খেয়ে খেয়ে শুধু আপনার ঋজু নয়, বাচ্চা-বুড়ো সবারই অরুচি হবার কথা। হয় ও তাই। আগেই বলেছি অপছন্দের খাবার ঠিক মত হজম হয় না। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অন্য অনেক বিষয়ের মত খিদে ও পরিপাককে শুধু শারীরিক বিষয় হিসেবে মানতে রাজি নয়। তারা বলছেন এটা শরীর মনের যৌথ ব্যাপার-স্যাপার। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে সাইকোসোম্যাটিক ম্যাটার। হ্যাঁ, বিষয়টি তাই। যেমন- আনারকলির বিরিয়ানি বা সাবিরের রেজালার কথা ভাবলেই আমার কেমন খিদে খিদে লাগে। তেমনি আপনি যদি কোন নেমতন্ন বাড়িতে ঘৃণার সাথে কিছু খান তবে পরদিন আপনার হজমের গোলমাল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

বিভিন্ন মশলা দিয়ে বাচ্চার রান্না হবে সুস্বাদু ও সুগন্ধি। বাজারের গুড়ো মশলা ব্যবহার করবেন না। কারণ গুড়ো মশলায় ভেজালের পরিমাণ বেশী থাকে। গোটা মশলা সাফসুফ করে বাড়িতে গুড়ো করে নিন। আপনাকে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে বুঝে নিতে হবে আপনার বাচ্চার কি ধরনের খাবার কি পরিমাণে পছন্দ করছে। তবে কোন অবস্থাতেই বাজারি রেস্তোরার তৈরি খাবার সোনামনিকে দেবেন না। রেস্তোরার খাবারগুলি রেসিপি মেনে বাড়িতে তৈরি করতে পারেন। খাবারের বাসনপত্র রংবেরঙের আকর্ষনীয় হলে খাওয়ার প্রতি বাচ্চার আগ্রহ বেড়ে যায়। প্রতিদিন একই পাত্রে খাবার না দিয়ে মাঝে মাঝেই তা পরিবর্তন করুন। এতে একঘেয়ামি কাটবে। মনে রাখবেন শিশু মানে নির্বোধ নয়। শিশুর দু’বছর বয়স হলেই তার মধ্যে পছন্দ- অপছন্দের অনুভুতির বিকাশ ঘটে। তবে তাদের শব্দ ভান্ডার প্রয়োজন অনুসারে না থাকার জন্য সব অনুভুতি তারা বড়দের মত সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না।
বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে খাদ্যের প্রতি শিশুর অনিহা যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। এই অসুবিধা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবারে। শিশুদের খাদ্য অনিহাকে মূলধন করে ব্যবসা ফেঁদেছে বেশ কিছু কোম্পানি। অ্যাপিটাইজার, ডাইজেসটিভ টনিকের রমরমা কারবার। এগুলি নব্বই শতাংশ আয়ুর্বেদিক ওষুধ। কারণ- অ্যালোপ্যাথিক সিস্টেমে এবিষয়ে ভালো ওষুধ পাওয়া যায় না।
যাক্, বেশী কথা না বাড়িয়ে একঝলকে দেখে নিন বাচ্চা খেতে না চাইলে আপনি কী করবেন কী করবেন না-
১) বাড়ির পরিবেশ খোলামেলা রাখুন।
২) বাচ্চাকে খেলতে দিন। সম্ভব হলে নিজেও বাচ্চার সঙ্গে খেলুন।
৩) আপনার সোনামনিকে যে আপনি ভালবাসেন, ওর কথা ভাবেন তা তাকে বুঝতে দিন। ভালভাবে খাওয়া দাওয়া কর, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, তোকে মানুষ হতে হবে- এমন জ্ঞান দেওয়ার কথা সবসময় বেশি বলবেন না।
৪) বাচ্চাকে পড়তে বসিয়ে নিজে টিভি সিনিয়াল গিলবেন না।
৫) সোনামণির  না খাওয়ার সমস্যা বেশি তীব্র মনে হলে পারিবারিক চিকিৎসকের ও শিশু মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬) সমস্যার কতটা শারীরিক আর কতটা মানসিক চিহ্নিত করুন।
৭) চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু আয়ুর্বেদিক ও হোমিও ওষুধ খাওয়াতে পারেন তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। অ্যানড্রোগ্রাফিস প্যান বা কালমেঘ, ক্যারিকা প্যাপিয়া, জেনটিয়ানা লুটিয়া, হাইড্র্যাস্টিস ক্যান এইসব ওষুধে খিদে ও হজমশক্তি বাড়ে।                    

Join our mailing list Never miss an update