শান্তি ও প্রগতির পক্ষে পথে নামছেন ডুয়ার্সবাসী

শান্তি ও প্রগতির পক্ষে পথে নামছেন ডুয়ার্সবাসী

শান্তি ও প্রগতির পক্ষে পথে নামছেন ডুয়ার্সবাসী; শুভজিৎ দত্ত; ১০ মে ২০১১; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
আগামী ১২ মে ভিন্ন ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে পথে নামতে চলেছে ডুয়ার্সের মানুষ। ১৩ মে এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনি ফল প্রকাশ হচ্ছে। ফল প্রকাশের পর এই এলাকার শান্তি যাতে কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয়, এই এলাকায় উন্নয়নের জোয়ার আসে সেই লক্ষ্য নিয়েই সারা ডুয়ার্সজুড়ে সোচ্চার হতে চলেছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষজন। ডুয়ার্স ডে উদযাপন সমিতি, বিভিন্ন ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সমিতি ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই উদ্যোগ নিয়েছে। ডুয়ার্স ডে উদযাপন সমিতির সম্পাদক ডাঃ পার্থপ্রতিম বলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ বিভিন্ন বিষয়ে পিছিয়ে রয়েছে এই ডুয়ার্স এলাকা। অতীতে এখানে রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে অনেক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। জাতিদাঙ্গা, পুলিশের গুলি, রক্তপাতে ভারী হয়ে উঠেছিল ডুয়ার্সের শান্তি সমীরণ। আমরা আর কোনো ভাবেই সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। ১২ মে ওদলাবাড়ি থেকে কুমারগ্রাম শহর, গঞ্জ, মফস্বল, গ্রামে শান্তি ও প্রগতির বার্তা নিয়ে পথে নামছে সকালে। বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মিছিলে পা মেলাবেন ব্যবসায়ী থেকে রিকশাচালক, ছাত্র-শিক্ষক-চিকিৎসক সকলে। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে হবে পথসভা।
    মালবাজারের সমাজসেবী রাজেন প্রধানের কথায়, নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, যে পক্ষই জয়ী হোক না কেন, যারা এলাকায় অশান্তি বা হিংসার বাতাবরণ কায়েম করতে চাইবে স্থানীয়স্তরে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলে তা প্রতিরোধ করব।
    ওদলাবাড়ি উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক জীবন মিত্র বলেন, জয়ী দলের সমর্থকদের বিজয় উল্লাস যেন অন্য কোনো মানুষের বিষাদের কারণ না হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।

    হ্যামিলটনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির অমরদীপ চৌধুরি বলেন, আমাদের এই মিছিলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হাঁটবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। কালচিনি বিধানসভা কেন্দ্রে এবার যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে এই মহামিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য।
    পশ্চিমে তিস্তা থেকে পুবে সংকোশ নদী প্রায় ১৬০ কিমি বিস্তৃত ডুয়ার্স। বিভিন্ন বিকাশের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর এখানে নতুন কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ আমলের চা-শিল্পই একমাত্র ভরসা। কর্মসংস্থানের সন্ধানে এই এলাকার বহু যুবক-যুবতিকে পাড়ি দিতে হচ্ছে ভিনরাজ্যে। বীরপাড়া কলেজের সমাজবিদ্যা অনার্সের ছাত্রী সুদীপ্তা ভৌমিক বলেন, আশা করি নতুন জনপ্রতিনিধিরা এই এলাকায় নতুন কলকারখানা, অফিস-দপ্তর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হবে। আমরা ডুয়ার্সে থেকেই এখানে কাজ করেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।
    লাটাগুড়ি রিসোর্টে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কমল ভৌমিক জানান, এ বছর শীতকালে রাজনৈতিক বন্ধ, অবরোধে ও উত্তেজনার কারণে ডুয়ার্সের পর্যটনশিল্প অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশাকরি আগামী সরকার সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে গুরুত্ব দেবে। সবল করতে হবে এলাকার আর্থিক বুনিয়াদ।
    বানারহাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য বলেন, এলাকায় অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হলে ছাত্রছাত্রীদের উপর প্রভাব পড়ে। আগামী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ও সমর্থকদের সংযত হতে হবে। অতীতে অনেকবারই সামাজিক অস্থিরতার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল শিক্ষার অঙ্গনে। দিনের পর দিন বনধ থেকেছে স্কুল-কলেজ, এই পরিস্থিতি যাতে আবার তৈরি না হয় তা নিয়ে এলাকার বিধায়করা প্রথম থেকেই সতর্ক হবেন।
    গয়েরকাটার বন ও বন্যপ্রাণীপ্রেমী সংস্থা আরণ্যক-এর কর্ণধার বিনায়ক বোসের কথায়, গত কয়েক বছর ধরে ডুয়ার্স এলাকায় লাগাতার  বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়ে চলেছে। খাদ্যের আশায় হাতির পাল হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। রেলপথে মারা যাচ্ছে হাতি-বাইসন। মানুষের পাশাপাশি এরাও এই এলাকার অধিবাসী। বন ও বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে অবিলম্বে মাস্টার প্ল্যান করা দরকার। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সচেতন করার জন্য আমরা দলমত নির্বিশেষে ১২ মে পথে নামব।
 
   বিন্নাগুড়ি বেথনিক ফেলোশিপ চার্চের প্রিস্ট সাইমনের দাবি অবিলম্বে ডুয়ার্সে হিন্দি কলেজ গড়ে তুলতে হবে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী আজ বেশি মাত্রায় হিন্দি মাধ্যমে পড়ছে। হিন্দি কলেজ না থাকার কারণে অসুবিধায় পড়ছে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের কিশোর যুবকরা।
খগেনহাট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সম্পাদক লক্ষী রায়ের মতে ডুয়ার্স এলাকায় কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। আরও আইটিআই, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা দরকার। আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের ল্যারি বোস বলেন, অবিলম্বে ডুয়ার্সে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল গড়ে তোলা দরকার। নতুন বিধায়কদের কাছে এটা আমাদের অন্যতম দাবি।
    চালসার সাংস্কৃতিক সংস্থা উদাত্ত-র কর্ণধার রেমা গাঙ্গুলি জানান, ডুয়ার্স এলাকায় লোকসংস্কৃতির যে ভান্ডার আছে তার সঠিক সংরক্ষণ দরকার। মেচ, রাভা, গারো, ধীমাল এইসব প্রান্তিক জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাদের পদযাত্রায় বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের মানুষ তাদের ট্রাডিশনাল পোশাকে অংশ নেবে।
    নাগরাকাটা অগ্রদূত সংঘের প্রাক্তন সম্পাদক অভিজিৎ দত্ত বলেন, ক্রীড়াক্ষেত্রে ডুর্য়াস এলাকায় অনেক সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় রয়েছে যারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো পেলে রাজ্যে তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। ডুয়ার্সে ক্রীড়া একাডেমি গড়ে তোলা দরকার।
    ডুয়ার্স অঞ্জুমান কমিটির সভাপতি রেজা করিম বলেন, বছরের পর বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষাভাষীর মানুষ ডুয়ার্সে পাশাপাশি থেকে একে অপরের সুখ-দুঃখে শামিল হয়েছে। বেশ কয়েকবছর ধরে সেই অবস্থার অবনতি হয়েছে। আমাদের মিলিত প্রয়াসে আমরা নতুন আলোর দিন আনব।
    লালবাড়ি দখলের লড়াইতে শেষ হাসি কে হাসবে তা ১৩ মে বলবে। তবে তার একদিন আগে সাধারণ মানুষের মুখের হাসি অটুট রাখতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যে পথে নামছে ডুয়ার্সের মানুষের এই সচেতনতা রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিয়েই ভোট পরবর্তী কাজকর্ম নিয়ে সতর্ক করবে।

Join our mailing list Never miss an update