ডুয়ার্স ডে-তে মিলুন, সবারে করি আহ্বান; -দেবযানী সেনগুপ্ত; ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪১৭; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
আজ আমরা সবাই আনন্দিত। কারণ আমাদের প্রিয় ডুয়ার্সে আবার নতুন করে রঙ লেগেছে, প্রতিটি মানুষের মনে জোয়ার এসেছে, সবার মনের খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে আগের মতোই সেই ভেদাভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্বের, প্রেমের, মানবিকতার শৃঙ্খলে বেঁধে নিয়েছি আমরা নিজেদের। আপামর ডুয়ার্সবাসী মেতে উঠেছে নতুন খেলায়। যা লোকের চোখে ভালো, যা সুন্দর, যা সত্যি সেটাই যেন প্রকাশ পাচ্ছে। গত কয়েক বছর খুব কঠিন সময় কেটেছে ডুয়ার্সের জনজীবনে।
শত বছরের বেশি সময় ধরে ডুয়ার্সের হালকা পাহাড়ি বুকে গড়ে উঠেছিল চা বাগিচা। শুরু হয়েছিল কঠিন নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে চা গাছ লাগানো, কলকারখানা, অফিস, কী সুন্দর অভাবনীয় নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ভালোবাসার বন্ধনেও বেঁধেছিল তদানীন্তন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ, মালিক-কর্মচারী। আজও সুন্দরভাবে চলে আসছে সেইভাবেই কাজকর্ম। পৃথিবীর মানচিত্রে, ভারতের মানচিত্রে ডুয়ার্স নিজের মহিমায় অবস্থান করে আছে।
কিন্তু বিগত ১৫-১৬ বছর আগে থেকে হঠাৎ শুরু হল Quality নয়, Quantity দেখার প্রয়োজন। প্রোডাকশন বাড়ানো শুরু হল, শুরু হল অত্যধিক কীটনাশক ব্যবহার করে গঙ্গাফড়িং, লুপারও আরও নানারকম চায়ের শত্রুপোকাদের মেরে ফেলার কাজ। ফলস্বরূপ কিছুদিন পর চায়ের প্রোডাকশন বাড়ল কিন্তু চায়ের বাজারে শুরু হল মন্দা, চায়ের দাম পড়ে গেল, সুনাম নষ্ট হল। আরও আনুষঙ্গিক নানা কারণে পরপর কতকগুলি চা বাগান বন্ধ হয়ে গেল। এর সঙ্গে মনুষ্যজীবনে দেখা দিল র্দুদশা, গরিবি, হতাশা, বিভ্রান্তি। দলে দলে নারী, পুরুষ মৃতপ্রায় পরিবারকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে ডুয়ার্স ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি জমাল।
ডুয়ার্সে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, ডুয়ার্সে সৎ উপায়ে পয়সা উপার্জন করা খুব কষ্টকর। ডুয়ার্সে চিকিৎসা পদ্ধতি অনুন্নত। তবুও আমরা ডুয়ার্সবাসী, ডুয়ার্স আমাদের, আমরা ডুয়ার্সের। ডুয়ার্সের প্রতিটি মানুষের মনে আছে সজীবতা, একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করি, পরস্পরকে সাহায্য করি, ভালোবাসি। বাংলা, বিহারি, নেপালি, রাঁচি-ওড়িশার আদিবাসী, খান, পাঠান, ইউরোপীয়ান, কাবুলি সব ভাষাভাষীর লোক, অ্যাঙলো চাইনিজ, ভুটানিজ সবারই উপস্থিতি আছে এখানে। আজ যেন বরফের গালিচাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘাস ফুলগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সবাই শোক-তাপ, দুঃখ-কষ্টকে দূরে ঠেলে দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে নতুন রঙ। মেতেছে আলোর উৎসবে, রাখি উৎসবে, কবিতায় রং লেগেছে, লেখায় রং লেগেছে নতুন।
প্রায়ই মনে হয় আমি দুটো ডানা লাগিয়ে উড়ে যাই ওই নীল আকাশে- যখন পারি না এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে, পাইনা রাত্রিকালীন বাস, ট্রেন, পাই না কোনো সঙগীত মহাবিদ্যালয়, হর্টিকালচার, ফ্লোরা কালচার, পাইনা বীণা আর সন্তুরের শিক্ষককে। ডুয়ার্স তবুও আমাদের প্রিয়, ডুয়ার্সের মাটিতে বসবাসকারী মানুষেরা গুণী, প্রতিভাবান। আর পুরুষ সমাজ, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরুষ সমাজ উদার মনের, তারা নারী জাতিকে উপযুক্ত সম্মান দেয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কোনো দেশের বা সমাজের উন্নতি, রক্ষা তখনই সম্ভব যখন পুরুষেরা বর্বরোচিত স্বভাবের দিকে না গিয়ে ভালোবাসা সামাজিকতা, মানবিকতার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারকে লালনপালন করে। ভ্রাতৃত্বের প্রেমে বেঁধে নেয় সবাইকে। এ ভাবনাকে সামনে রেখে ডুয়ার্সবাসী হিসেবে সমস্ত মানুষকে ‘ডুয়ার্স ডে’-তে শামিল হওয়ার জন্য স্বাগত জানাই।
- দেবযানী সেনগুপ্ত; কারবালা চা বাগান, বানারহাট।