শীতের কুম্ভকর্ণ

শীতের কুম্ভকর্ণ

শীতের কুম্ভকর্ণ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১ মে ২০১৪; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
নিদ্রা যায় কুম্ভকর্ণ জাগিবেক
কবে।
বিচার করিয়া দেখ সভাখন্ড
সবে।।
যায় অর্দ্ধ লঙ্কাপুরী কুম্ভকর্ণ
ভোগে।
ছয় মাস নিদ্রা যায়, একদিন
জাগে।।
পাঁচ মাস গত নিদ্রা এক মাস
আছে।
আজি লঙ্কা মজিলে সে কি
করিবে পাছে।।
    হ্যাঁ, কৃত্তিবাস অনুদিত সেই সপ্তকান্ড মহাকাব্যের লঙ্কাকান্ডে হয়তো অনেকেই এই অধ্যায় পড়েছেন। কুম্ভকর্ণের সেই ঘুমের কাহিনি ছেলে-বুড়ো সবারই জানা। আমাদের এই প্রাণী জগতে এমন কিছু প্রাণী রয়েছে যারা ততটা না হলেও শীতকালে কুম্ভকর্ণের সাথে টেক্কা দেয়। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু প্রাণী কিছুদিনের জন্য চলে যায় আমাদের চোখের আড়ালে, ঘুমের দেশে। হ্যাঁ, একেই বলে শীতঘুম বা ইংরাজিতে হাইবারনেশন  (Hibernation)।
সাধারণভাবে শীতঘুম দেখা যায়, সরীসৃপ, মাছ, বাঁদুড়, প্রভৃতি মেরুদণ্ডী ও শামুক, কীট-পতঙ্গ, কেঁচো প্রভৃতি অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে। শীতঘুমের মেয়াদ নির্ভর করে প্রাণীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশের শীতের তীব্রতার ওপর অর্থাৎ যেখানে ঠান্ডা বেশি সেখানে ঘুম গভীর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অংশ ও মিসিমিপি নদীর ধারে বসবাসকারী ইমাইডাক(Emyduc) কচ্ছপের ক্ষেত্রে দেখা যায় শীতল উত্তর অংশে কচ্ছপের শীতনিদ্রা চলে অনেকদিন ধরে, কিন্তু একই প্রজাতি কচ্ছপের মিসিসিপি অঞ্চলে হাইবারনেশনের সময় অনেক কম। নিরক্ষীয় বা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের তুলনায় মেরু ও শীতপ্রধান বলয়ের বেশিরভাগ প্রাণীরই শীতঘুমের অভ্যাস রয়েছে।

৭৭ থেকে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে রোমের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্লিনী (Pliny)-র লেখা ‘ন্যাচলার হিস্ট্রি’ (Natural Historia)  বইতে পাওয়া যায়- ‘শীতের আগে ভাল্লুক গর্তের ভেতর ডালপালা জমা করে তার ওপর শুকনো পাতা বিছিয়ে সুন্দর বিছানা বানায়। শীত এলেই সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। পুরুষ ভাল্লুক ঘুমায় ৪০ দিন, কিন্তু স্ত্রী ভাল্লুকের এই ঘুম চলে চার মাস।’ মানুষের ক্ষেত্রে নারীরা বেশি নিদ্রা বিলাসিনী কিনা, সে বিষয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে। তবে পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, মনুষ্যেতর পুরুষের তুলনায় স্ত্রী প্রাণীরাই বেশি ঘুমকাতুরে। গিরগিটি, সাপ, গোসাপ প্রভৃতি সরীসৃপেরা কনকনে ঠান্ডায় বাইরে বেরায় না। সাপ গর্তের মধ্যে, গাছের কোটরে অথবা স্তূপীকৃত জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নেয় এবং লম্বা শরীরটাকে কুল্ডলী করে নিঃস্পন্দ অবস্থায় পড়ে থাকে। ঠান্ডার সময় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে একসঙ্গে ঘুমাতে দেখা যায়, যদিও অন্য সময় পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। এর একটা সুন্দর বিবরণ নোবেলজয়ী প্রকৃতি বিজ্ঞানী কনবার্ড লোরেঞ্জ দিয়েছেন। তিনি উত্তর আমেরিকায় ১২ ফুট লম্বা একটি গর্তে শীতের সময় অত্যন্ত বিষধর ১৫০ টি র‌্যাটল সাপের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাঙ, গিরগিটি, মেঠো কাঠ-বিড়ালী ও প্রেইরী কুকুরকে (Prairie Dog) ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছিলেন। শীতনিদ্রার সময় সবাই বন্ধু, কেউই শত্রু নয়। প্রেইরি ডগ উত্তর আমেরিকার তৃণভূমি অঞ্চলে বাস করে। নামে ডগ শব্দটি থাকলেও এরা কুকুর নয়, ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। ইঁদুরের মতো সুরঙ্গ খুঁড়ে মাটির নীচে বিরাট কলোনি বানায়। সেখানে অনেকগুলি পরিবার একসঙ্গে থাকে।
    সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণীরা ঠান্ডায় খুব বেশি নাজেহাল হয় না। কারণ, বাতাস যত তাড়াতাড়ি ঠান্ডা বা গরম হয়, জল তত তাড়াতাড়ি হয় না। তাছাড়া, সমুদ্রের জলের নীচের স্তরে তাপমাত্রার পরিবর্তন খুবই সামান্য। ঠান্ডা বেশি পড়লে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা নিম্ন জলস্তরে নেমে যায়। ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিকা সার্ভের মেরিন বায়োলজিস্ট কীরণ ফ্রেসার (Keiron Faser)  দেখেছেন- কিছু সামুদ্রিক মাছের শৈশবে শীতঘুমের অভ্যাস থাকলেও, একটু বয়স বাড়লে তারা সে অভ্যাস ত্যাগ করে। রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মিঠে জলের পোনামাছ শীতকালে জলের তলায় পাঁকের কাছাকাছি থাকে। অধিকাংশ কীট-পতঙ্গ হাইবারনেশনে আচ্ছন্ন থাকলেও মৌমাছিরা কিন্তু ব্যতিক্রম। তারা দেহের তাপমাত্রা বাড়াবার জন্য একসঙ্গে দ্রুততালে ডানা কাঁপায়, গুনগুন সুর তোলে।
    শীতনিদ্রার বিভিন্ন কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও -এ বিষয়ে সবাই একমত যে, শীতঘুমের অন্যতম কারণ হল মৌল বিপাক হার (Basal Metabolic Rate-BMR)  কমানো। সুস্থ স্বাভাবিক প্রাণীর পূর্ণ বিশ্রাম অবস্থায় দেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ কারবার চালাতে যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়; সাধারণভাবে তাকেই মৌল বিপাক হার বলে। বিশেষত, শীতল রক্তের প্রাণী অর্থাৎ যাদের দেহে খাদ্যবস্তুর সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জৈব শক্তির উৎপাদন কম এবং যাদের দেহে তাপ উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত নয়, তাদের বেশি ঠান্ডাতে ঘুমোতেই হবে। বিপাকহার কমে যাওয়ার প্রথম লক্ষণ হল হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা হ্রাস পাওয়া। উত্তর আমেরিকার গুহাবাসী কাঠবেড়ালি সাইটিপ্লাস-এর দেহে তাপমাত্রা ১০ ঘন্টার মধ্যে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে আসে, প্রতি মিনিটে হৃদস্পন্দনের হার ২৫০-এর জায়গায় মাত্র ১৫ বার এবং শ্বাসের মাত্রা ১৫০-এর বদলে চারবার হয়। মারমট (Marmot)  এক বড়ো জাতের কাঠবেড়ালি। এদের প্রায় ১৫ টি প্রজাতি রয়েছে। তার মধ্যে একটি প্রজাতি রয়েছে পূর্ব-হিমালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে। এরা সমাজবদ্ধ প্রাণী। এদের অনেক মজার ব্যাপার স্যাপার রয়েছে। এরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ভাব- ভাষা আদান প্রদান করে। বিশেষত বিপদ দেখলে বখাটে ছেলের মতো মুখ দিয়ে সিটি মারে। প্রিয়জনকে সতর্ক করে দেয়। মারমট শীতের আগে প্রায় দশ গজ লম্বা সুড়ঙ্গ তৈরি করে। বাইরের তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে নেমে গেলে, সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে ১৫-১৬ জন গায়ে গা-লাগিয়ে ঘুম দেয়। স্বাভাবিকভাবে মারমট মিনিটে ১৬ বার শ্বাসগ্রহণ করে এবং হৃদপিন্ড মিনিটে ৮৬ বার স্পন্দিত হয়, কিন্তু শীতঘুমের সময় প্রতি মিনিটে দু’বার শ্বাস নেয় ও হৃদস্পন্দন হয় মাত্র ১৫ বার । ৩৫ ডিগ্রি সেঃ উষ্ণতায় যে সব শামুকের হৃদস্পন্দন ৫০-৬০ বার/ মিনিট, শীতকালে তা কমে দাঁড়ায় ৪-৫ বার। লেমুর এক বাঁদর জাতীয় প্রাণী, মাদাগাস্কার দ্বীপপুঞ্জে এদের দেখা যায়। অনেক জীববিজ্ঞানীদের মতে এরাই মানুষের পূর্বপুরুষ। উত্তর মাদাগাস্কারের হাসিখুশি লেমুর (Lepilemur Septentrionalis) শীতঘুমে থাকার সময় তাদের দেহ তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেঃ নেমে যায়। সাধারণত এদের দেহে তাপমাত্রা থাকে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

    শীতঘুমের সময় প্রাণীরা সাধারণত খাবার খায় না। দেহের চর্বি ও যকৃত পেশীতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন জারিত করে শক্তির চাহিদা মেটায়। শীতনিদ্রার প্রথম দিকে চর্বি ও শেষের দিকে গ্লাইকোজেন জারিত করে শক্তির চাহিদা মেটায় বা শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহার করে। এরা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় থেকেই শীতনিদ্রার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকে। জেপাস নামের একটি ইঁদুর দেহে প্রতিদিন দু’গ্রাম চর্বি সঞ্চয় করে। শীতঘুমের সময় প্রাণীরা খুব হিসাব করেই চর্বি খরচ করে, দেহের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের উষ্ণতার চেয়ে এক বা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি রাখে না। উত্তর আমেরিকার ডোরাকাটা কাঠবেড়ালি চিপমাংক ও ইঁদুরের মত প্রাণী হ্যামস্টার আগে থেকে গাছের কোটরে বা মাটির গর্তে খাবার সঞ্চয় করে রাখে, এদের ঘুম একনাগাড়ে হয় না, মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ও সে সময়ে খাবার খায়। খরগোস, গিনিপিগ, ভাল্লুক প্রভৃতি স্তন্যপায়ীদের বুকে ও গলায় মাইওগ্লোবিন, ফ্লাবিন, সাইট্রোক্রোম যুক্ত এবং মাইট্রোকনডিয়া পুষ্ট বিশেষ ধরনের বাদামি চর্বিকলা (Brown Adipose Tissue) জমে। এই কলা শীতের সময় তাপশক্তির প্রধান উৎস বলে একে শীতস্তম্ভ গ্রন্থি (Hiberatinating gland)  বলা হয়। ঠান্ডার সময় যাতে দেহ থেকে বেশি তাপ বেরিয়ে না যায়, সেজন্য অধিকাংশ প্রাণী দেহের আয়তন যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলে অর্থাৎ হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু বাদুড় তা করে না। স্বাভাবিক ঘুমের সময় যেমন মাথা নিচু করে ঝুলে থাকে, শীতকালেও সেই একইভাবে ঘুমায়। চওড়া ডানা থেকে যাতে তাপ বেরিয়ে না যেতে পারে, সেজন্য চোখ ও নাসারন্ধ্রের মধ্যে অবস্থিত গ্রন্থি থেকে ভেজলিনের মত রস ক্ষরণ করে ডানার চামড়ায় লাগিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে নাকের কফ কোল্ডক্রিমের মতো কাজ করে।

    কৃত্রিম পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণীর শীতঘুম বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। হেলিক্স ডেসারটোরাম (Helix desartaram)  বৈজ্ঞানিক নামের শামুককে তিন বছর ফ্রিজের মধ্যে রাখার পর উষ্ণ পরিবেশে আনলে জেগে উঠতে পারে। সাধারণত এই শামুকের শীতনিদ্রা  চলে পাঁচ মাস। পেঙ্গলে ও ফিশার নামে দুই জীববিজ্ঞানী সাইটিল্লাস কাঠবেড়ালির ওপর পরীক্ষা করে কয়েকটি চমকপদ্র তথ্য পেয়েছেন। গ্রীষ্মকালে কৃত্রিম শীতকক্ষে হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমাত্রায় রাখলেও শীতঘুমে আচ্ছন্ন হয় না, স্বাভাভিক জীবনযাপন করে। অপরদিকে, শীতকালে ৩৫ ডিগ্রি সেঃ উষ্ণতা বিশিষ্ট আলোকিত কক্ষে রেখে দেখা গেছে যে, আলো ও তাপমাত্রা বেশি থাকার জন্য এরা ঘুমতে পারে না। কিন্তু প্রচুর খাদ্য থাকা সত্ত্বেও অনাহারে থাকে এবং দেহের ওজন ক্রমশ হ্রাস পায়। অন্যান্য শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তনগুলি হয় ঠিক যেমনটি দেখা য়ায়, শীতের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশে।
    অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ হ্যামইস ক্যাম্পবেল(Hamish Campbell)  ও তার সহযোগীরা ওষুধ প্রয়োগ করে গ্রীষ্মকালে ইঁদুরকে ঘুম পাড়িয়ে তার দেহ তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেঃ পর্যন্ত নামিয়ে দিয়েছিলেন এবং দেড় ঘন্টা হৃদপিন্ড ও শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখার পর পুনরায় তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। শীতঘুমের বিস্তারিত কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। গবেষকরা দেখেছেন-এই ঘুমের সময় দেহের হরমোনাল গ্রন্থিদের নিয়ন্ত্রক  (Master Gland)  পিটুইটারি গ্রন্থির (Pitutary Gland) পরির্বতন ঘটে এবং সেই কারণেই থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত থাইরকসিন হরমোনের পরিমাণ হ্রাস পায়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শীতনিদ্রামগ্ন প্রাণীদের শরীরে পিটুইটারি ও থাইরকসিন প্রয়োগ করলে তাদের ঘুম ভেঙে যায়।

শীতঘুমের সময় হৃদস্পন্দন কম থাকার ফলে রক্ত সঞ্চালনের বেগ খুবই কমে যায়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, এই অবস্থায় রক্ত জমাট বেঁধে থ্রম্বোসিস (Thrombosis)  হয় না। রক্তে প্রোথ্রম্বিনের (Prothrombin)  পরিমাণ  হ্রাস এবং প্লাজমা প্রোটিন অণুর মৌলিক পরিবর্তনের ফলেই এটা সম্ভব হয়ে থাকে। এ বিষয়ে জার্নাল অব সেরিব্রাল ব্লাড ফ্লো অ্যান্ড মেটাবলিজম পত্রিকাতে ‘লোকাল সেরিব্রাল ফ্লো ডিউরিং হাইবারনেশন’ শিরনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন কাই ইউ, ফ্রিরিচস, চার্লস কেনিডি, লুইস সোকোলফ (Kai U. Frerichs, Charles Kennedy, Louis Sokoloff)  ও আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- চর্বি ও গ্লাইকোজেন থেকে তাপ উৎপাদনের জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পরিবেশের উষ্ণতা কমে গেলেই হাইপোথ্যালামাস সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমবেদী স্নায়ুর প্রান্তভাগ থেকে নিঃসৃত নর-অ্যাড্রিনাল হরমোন (Nor Adrenaline)  লাইপেজ উৎসেচককে উজ্জীবিত করে এবং ট্রাই-গ্লিসারাইড অণু গ্লিসারল বা ফ্যাটি  অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে অ্যাডিনোসিন ট্রাই-ফসফেট এর মাধ্যমে ফ্যাটি অ্যাসিডের অণুর বন্ধনে আবদ্ধ রাসায়নিক শক্তি থেকে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। এ সময়ে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা খুব বেশি থাকে। সে কারণেই শর্করার পরিমাণ থাকে অল্প। শীতঘুমের সময় রক্তে অ্যান্টিবডি ও ইমিউনিটি বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রাণীরা বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এবং পরজীবি প্রাণীদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। ঘুমন্ত উডচাক্ কাঠবেড়ালীকে পাঁচ ঘন্টা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের মধ্যে রাখলেও তার শরীরে কোন বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। বেশ কিছু প্রাণী শীতঘুমের সময় মারাত্মক তেজস্ক্রিয় বিকিরণও সহ্য করতে পারে।

শীতঘুমের সময় প্রাণীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই ক্যানসার, সোরিয়াসিস বা যেসব দুরারোগ্য রোগের সঠিক চিকিৎসা এখনও আমাদের হাতের মুঠোয় ভালোভাবে আসেনি, সেই সব রোগীদের যদি হাইবারনেশনে নিয়ে যাওয়া যায়- তাহলে তারা সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন বলে বিজ্ঞনীদের আশা। তাছাড়াও যেসব রোগীর হার্ট, লিভার বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন, তাদের যদি সময়মতো সেইসব অঙ্গ পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে তাদের ঘুমের দেশে নিয়ে গেলে বেশ কিছু সময় হাতে পেয়ে যাবেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। সিয়াটেলের ফ্রেড হ্যাচিংসন ক্যানসার রির্সাচ সেন্টারের বিজ্ঞানী মার্ক রথ (Mark Roth)  এর গবেষণা করে এ বিষয়ে আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছেন।
বিজ্ঞানীদের আশা অনাগত দিনে অবনীবাসী মানুষ পাড়ি জমাবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। ২০৩০ সালের মধ্যেই মঙ্গল গ্রহে মানুষকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে ‘নাসা’। পৃথিবী থেকে মঙ্গল যেতে প্রায় দেড় বছরের পথ। এত দীর্ঘসময় মহকাশপথে থাকতে গেলে মানুষের দেহের মাংস পেশি অসাড় হয়ে পড়ার কথা। কারণ যেখানে মধ্যাকর্ষণ বল নেই, সেখানে হাত-পা নাড়াতে আমাদের তেমন পরিশ্রম হওয়ার কথা নয়। জাপানি এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির অধীনে থাকা ইন্সটিটিউট অফ স্পেস এন্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল সায়েন্স এর বিজ্ঞানী ডঃ নোরিয়াকি ইসিওকা (Dr. Noriaki Ishioka)  জানাচ্ছেন এই যাত্রাপথটা মহাকাশচারীরা শীতঘুমের মতোই নিদ্রাচ্ছন্ন থাকবেন। এই ঘুমের ফলে একদিকে যেমন অক্সিজেনের চাহিদা কমে যাবে, অন্যদিকে ঠিক থাকবে মাংসপেশি ও দেহের অন্যসব অঙ্গ-তন্ত্র। অল্প খাবারে মহাকাশচারীরা বেশিদিন চালাতে পারবেন। যা এতদিন কল্পবিজ্ঞানের বইতে শিশু-কিশোরের মন জয় করত, তাই হয়ে যাবে প্রকৃত বাস্তব। গবেষণা চলছে স্পেস বায়োলজির পরীক্ষাগারে।
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে আমরা যখন তন্দ্রামগ্ন। তখন অতন্দ্র কৌতূহল নিয়ে কিছু চোখ জাগছে- কোনো ল্যাবরেটরির আর্টিফিসিয়াল ক্লাইমেটিক চেম্বারের দিকে তাকিয়ে। নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায়। ধূসর গোধূলি থেকে রাতের আঁধার ছিন্ন করা করা ফুটন্ত সকাল, সকাল থেকে উষ্ণ দুপুর পেড়িয়ে গোধূলি চলছে নিরন্তর গবেষণা। প্রকৃতি জয়ের মাইলস্টোনকে  একের পর এক টপকে যাওয়ার দুর্দম বাসনা। হ্যাঁ, এ এক আন এন্ডিং এপিসোড। নেই কোনো বিজ্ঞাপন বিরতি....।   
                            

Join our mailing list Never miss an update