নানা সমস্যায় জর্জরিত বানারহাটের মানুষ

নানা সমস্যায় জর্জরিত বানারহাটের মানুষ

নানা সমস্যায় জর্জরিত বানারহাটের মানুষ; -পার্থপ্রতিম; ৮ নভেম্বর, ১৯৯২; দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত
বানারহাট :- ২৭ টি চা বাগিচার কেন্দ্রবিন্দু জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাট নানা সমস্যায় জর্জরিত। এই  অঞ্চলের লোকসংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার। যার মধ্যে ৫২ শতাংশ তফসিলী উপজাতি ও ২৩ শতাংশ তফসিলী জাতির মানুষ। ১৯৯৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মাত্র ১৫, ১৫৯ জন পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার আওতায় এসেছেন। চা বাগিচাগুলি রয়েছে পঞ্চায়েতের বাইরে। কিন্তু চিকিৎসা, শিক্ষা, কেনাবেচা প্রায় সব বিষয়েই চা-কর্মীরা বানারহাটের উপর নির্ভরশীল।
    বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে তুঙ্গে হলো জলের সংকট। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য ব্যবহারযোগ্য জলের স্তর ভূ-পৃষ্ঠের ২৭৫ থেকে ৩০০ ফুট নিচুতে। এই পাহাড়ি পাথুরে অঞ্চলে একটি সরকারি গভীর নলকূপ ছাড়া আর কোন জলের উৎস নেই। তাও দৈনিক সরবরাহ মাত্রা মাথাপিছু  ১১.৬ লিটার। ২০ হাজার লোকের পানীয় জলের সংকট আরও মারাত্মক আকার নেয় যখন বিদ্যুৎ গোলযোগের জন্য সবে ধন নীলমণিও অচল হয়ে পড়ে। আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে জিজেল পাম্প চালান হতো। গত বছর থেকে ব্যয়সংকোচন নীতির ফলে ডিজেল পাম্পের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।। বৈদ্যুতিক পাম্পই এখন একমাত্র ভরসা।

    এ সমস্যা নিয়ে বানারহাট গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বিমলচন্দ্র দাস বলেন, জলের বিষয়ে আমরা গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত  বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ার, জেলা সভাধিপতি এমন কী মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। যাতে উপজাতি অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জন্য সরকারি নিয়মনীতি শিথিল করে, প্রয়োজনে ডিজেল পাম্প চালু করা যায়। আশা করি কিছুদিনের  মধ্যেই সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে।
    বিমলবাবুর কথার প্রতিধ্বনি তুলে  বানারহাটের ভারপ্রাপ্ত পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ার তনয় ব্যানার্জি জানালেন, অবিলম্বে জলের আরও একটি বিকল্প-উৎস তৈরি করা দরকার, না হলে যে-কোন মুহূর্তে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
    বানারহাট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শৈবাল ভট্টাচার্য বলেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসী আমলে এই অঞ্চল ছিল উপেক্ষিত, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিক। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল এই ভূখন্ডকে। গত দশ বছরে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, তবে আরও প্রয়োজন। হিন্দি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকার জন্য অনেক আদিবাসী ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক পাশের পর পড়াশুনায় ইতি দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে অসুবিধার কারণ হলো- চা-বাগানগুলি পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার বাইরে থাকার জন্য চা শ্রমিক পরিবারের লোকজন পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সুবিধা যেমন আই আর ডি পি, এস সি পি ট্রাইবাল সাবপ্ল্যান (টি এস পি) প্রভৃতি ঋণ ও অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বানারহাট রয়েছে ধূপগুড়ি ব্লকের আওতায়। ধূপগুড়ি ব্লক তুলনামূলকভাবে অনেক বড়, সে কারণেই ঠিকমতো প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো সম্ভব হয়ে উঠেছে না। বানারহাটের আদিবাসী তথা আদিবাসী চা-শ্রমিকদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে বানারহাটকে ব্লক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
    শৈবালবাবুকে শুধু শিক্ষক বললে, অনেক কম বলা হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ও ডব্লু বি সি এস পাশ করেও গাড়ি, বাংলো, টেলিফোনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে তিনি আদিবাসী মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধার ডোরে বাধা পড়েছেন। বানারহাট অঞ্চলের যা কিছু উন্নতি, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি পিচঢালা প্রধান সড়ক, শিশুউদ্যান, আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়- এসবের পিছনেই রয়েছে শৈবালবাবুর উদ্যোগ। সম্প্রতি তাঁরই অক্লান্ত প্রয়াসে গড়ে উঠেছে প্রয়াত বনমন্ত্রী পরিমল মিত্রের স্মরণে হিন্দি মাধ্যম জুনিয়র হাইস্কুল।
    বিগত দশ বছরে সরকারি ও বেসরকারি  বাস চলাচল বেশ ভালভাবেই বেড়েছে। তবে এতগুলি চা-বাগিচার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া সত্ত্বেও কলকাতার  সঙ্গে বানারহাটের কোন সরাসরি যোগাযোগ আজও গড়ে ওঠে নি। রকেট বাস সার্ভিস বানারহাটের ওপর দিয়ে চলাচল করলেও এখানে থামে না। রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা আগে ভাল ছিল। মিটার গেজ লাইন দিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন চলতো। ১৯৮২ সালের পর থেকে গাড়িগুলি এক-এক করে বন্ধ হতে থাকে। এখন সর্বসাকুল্যে মাত্র দু’টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। কাছাকাছি পশু হাসপাতালটি এ অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর  বেশ কয়েকশো গৃহপালিত পশু, হাঁস, মুরগি মারা  যায়। আর মড়ক লাগলে তো কথাই নেই। প্রধানত দরিদ্র আদিবাসীরা এ অব্যবস্থার শিকার। পশুপালন ও পোলট্রি শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সব সম্ভাবনা স্বপ্নেই রয়ে গেছে।
    দক্ষিণবঙ্গ থেকে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে এসেছিল জিয়াউল আলম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি নেওয়ার পর তাঁর আর কংক্রিটের জঙ্গলে ফেরা হল না। মাদলের বোল ও পাহাড়ি জঙ্গলে আটকা পড়ে গেলেন। বানারহাটের সংশ্লিষ্ট চা-বাগিচার শ্রমিকদের আজ তিনি ব্যথা-বেদনার সঙ্গী। শ্রমিক পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্য-পরিবেশ সচেতনতা, বিজ্ঞান মানসিকতার বিকাশ ও কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি জিয়াউল জানালেন, শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার না ঘটার জন্য এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার, অন্ধ-বিশ্বাস প্রভৃতির শিকার। অনেকেই চিকিৎসার বিষয়ে ওঝা, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কবজের ওপর নির্ভরশীল। তবে অদূর ভবিষ্যতেই এ অবস্থার  অবসান ঘটবে। দরকার আরও বেশি সরকারি ও বেসরকারি সাহায্যের।

 

Join our mailing list Never miss an update