ডুয়ার্স দিবসে ডুয়ার্সের সঠিক উন্নয়নই হোক অঙ্গীকার;- সুকল্যাণ ভট্টাচার্য; প্রধান শিক্ষক; বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়; বানারহাট; ৯ জানুয়ারি ২০১৪; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
‘ডুয়ার্স’ শব্দটি শুনলেই মনে যেন অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগে। সবুজ দিগন্ত বিস্তৃত চায়ের গালিচা, ওই দূরে ভুটান পাহাড়ের ছোটো ছোটো টিলা, শীর্ণকায়া বয়ে চলা পাথুরে নদী, রোদে ঝিকমিক করা সবুজ জঙ্গল এ যেন কোনও ঝানু শিল্পীর তুলোট কাগজে আঁকা অদ্ভুত ল্যান্ডস্কেপ। মন মাতাল করা ধামসা-মাদলের মন পাগল করা সুর, মোরগ লড়াইয়ের হাড়হিম করা বীভৎসতার উল্লাস, জোলা মদের ঝাঁঝালো নেশাতুর চোখ সবকিছু নিয়ে আমাদের সকলের প্রিয় ডুয়ার্স যেন অনন্যা। সেই কবে ১৮৭৪ সালে লিস, চেল, ঘিস-এর ধারে গজলডোবা চা-বাগান পত্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে ডুয়ার্সের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
মহাভারতের যুগের এই জঙ্গলাকীর্ণ পান্ডব বর্জিত প্রকৃতির কোলে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর-এর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ শাসনের হাত ধরে আসে রেলপথ, টেলিগ্রাফ, মোটরগাড়ি, টেলিফোন, হাসপাতাল- আধুনিক সভ্যতার প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিষয়গুলো। ১৮৮০ সাল থেকে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কারণে ডুয়ার্স-এ আছড়ে পড়তে শুরু করে মানুষের স্রোত। কে আসেনি? দেশ দ্বিখন্ডিতকরণের মধ্য দিয়ে আসা স্বাধীনতার আগের থেকেই এপার বাংলা, ওপার বাংলা সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন ভাষা, সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসতি গড়ে তোলে। শুধু দেশ নয় একসময় ভুটিয়াদের দখলে থাকা ডুয়ার্সের মাটিতে নেপাল, ভুটান, বার্মা, তিব্বত থেকেও মানুষ বাধাহীনভাবে ভাগ্য ফেরানোর তাগিদে ভিড় জমিয়েছিলেন। এই জনঅভিবাসনের ঐতিহ্য দেশভাগের পরে তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ পায়। আজ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী তিস্তা, তোর্ষা, রায়ডাক, কালজানি, মহানন্দা, জলঢাকা, মুজনাই, আংরাভাসা, গিলান্ডি, সংকোশ, নোনাই বিধৌত এলাকা যেন বহুত্বময় ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। মোঙ্গলয়েড, দ্রাবিড়, আলপানীয় সব জনস্রোতের প্রবহমান ধারার অদ্ভুত এক মোজেইক হল আমাদের ডুয়ার্স। ওরাওঁ, মুন্ডা, হো, বোড়ো, জলদা, ডুকপা, অসুর, মগ মাহালি, কোরা, মেচ, রাভা, বিভিন্ন জনজাতির অরণ্যচারী মানুষ চা-বাগানে কাজের সূত্রে বিহার ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে এখানে যেমন এসেছেন তেমনি ওই আমলের কিছুটা শিক্ষিত বাঙালি সমাজ চা বাগানে গুদামবাবু, ফ্যাক্টরিবাবু, বাগানবাবু, কম্পাউন্ডারবাবু ইত্যাদি বাবু গোছের কাজে ভিড় জমিয়েছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রকৃতিবাদী নানা ধর্মীয় বিশ্বাসী মানুষ ডুয়ার্সকে একান্ত আপন করে নিয়েছে। বাঙালি, আদিবাসী, নেপালি, মাড়োয়ারি, রাজবংশী, বিহারি সব সম্প্রদায়ের মানুষের মহামিলনক্ষেত্র এই ডুর্য়াস। সরকারিভাবে চিহ্নিত স্বীকৃত ১৫১টি বাচিক গোষ্ঠীর মানুষ এখানে রয়েছেন। শুধুমাত্র একটি মাত্র ভাষা শিখে ডুয়ার্সের মাটিতে পথচলা অসম্ভব।
এই প্রেক্ষিতে কে ভূমিপুত্র তা বুঝতে যাওয়া বা তার চেষ্টা করাই যেন বোকামি! ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক আঞ্চলিক স্থানের মতোই ডুয়ার্স পিছিয়ে আছে। স্বাভাবিক ও সংগত কারণেই ডুয়ার্স থেকে আজ যুবক-যুবতিরা কাজের জন্য ভিনরাজ্যমুখী। সেই কবে ১৮৬৪ সালে ১৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ সার্জেন্ট রেনি তদানীন্তন ইংরেজশাসক গোষ্ঠীকে এই ডুয়ার্স এলাকার গুরুত্ব ও সার্বিক উন্নতির যে সম্ভাবনার কথা লিখে জানিয়েছিলেন তা যেন এই কয়েক দশকে স্তিমিত। স্বাধীনতার আগে থেকে এই এলাকার মানুষের ঘাম, রক্তের বিনিময়ে যে মুনাফার পাহাড় তৈরি হয়েছিল তার কানাকড়িও এই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পুরানো রাজা অস্ত গেল, নতুন গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমুখী সরকার এল। তাও এই এলাকায় চা ছাড়া নতুন কোন শিল্প হল না। যখন মঙ্গলগ্রহে মানুষের জয়যাত্রার নিশান উড়ছে তখন সবুজ গালিচায় মেড়া চা বাগিচায় অনাহারে বা অপুষ্টিতে হতভাগ্য আম আদমি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
আজ এই ডুয়ার্সকে কালনেমির লংকা ভাগের মতো ভাগ করবার জন্য কিছু মানুষ নতুন উদ্যমে পথে নেমেছে। শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা যে ডুয়ার্সে ছিল তাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে কিছু মানুষের অশুভ মন বিষধর সাপের ফণার মতো লকলক করছে। কোনও এলাকায় উন্নয়ন নির্ভর করে সেই এলাকার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, স্থিতিশীল বাতাবরণের ওপর। জাত-পাত, ধর্ম, ভাষা, সম্প্রদায় ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে মানুষে মানুষে প্রেম, ভালোবাসা মৈত্রীর চিরন্তন বন্ধনকে যদি নষ্ট করে ফেলা যায়, তা হলে যে অস্থিরতার অঙ্কুরের লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় মানুষের শুভবোধ। তাই ডুয়ার্সের মানুষের এই শুভবোধের ঐতিহাসিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে উন্নয়নের নতুন ধারার ক্ষেত্র তৈরি করতে এই ডুয়ার্সকে ভালোবাসতেই হবে। তার জন্য ডুয়ার্সের সব ভাষাভাষী ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, জনজাতি মানুষের সব ধরনের সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠে, ১৪ জানুয়ারি হৃদয়ের অন্তর থেকে অঙ্গীকার নিতে হবে। ভ্যালেন্টাইন-ডে, মাদার্স-ডে, লেবার-ডে, ফার্মার্স-ডে, সাক্ষরতা-ডে, এইডস-ডে ইত্যাদি ডে-এর মতো নিছক আনুষ্ঠানিক দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ডুয়ার্স-ডে পালন থেমে থাকবে না। সমস্ত সংকীর্ণতা, মলিনতা, জীর্ণতা, ভেদাভেদ, বিভেদ, বিভ্রান্তি, রাজনৈতিক চাপানউতোর, সামাজিক টানাপোড়েন ভুলে আমরা এক হয়ে ডুয়ার্সের উন্নয়নে শামিল হব-‘ডুয়ার্স-ডে’-তে, এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
সুকল্যাণ ভট্টাচার্য, প্রধান শিক্ষক
বানারহাট উচ্চবিদ্যালয়, বানারহাট।