তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার-বঞ্চিত তবু স্পর্ধায় আকাশ ছুঁয়েছে

তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার-বঞ্চিত তবু স্পর্ধায় আকাশ ছুঁয়েছে

তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার-বঞ্চিত তবু স্পর্ধায় আকাশ ছুঁয়েছে; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১২ মে ২০০৫ জলপাইগুড়ি ক্রোড়পত্র পৃষ্ঠা খ; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত।

নাগরা-মান্দর-চায়ের দেশে বানারহাট তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার। সরকারি বঞ্চনার শিকার। দীর্ঘ তিন বছর ধরে এখানে গ্রন্থাগারিক নেই। রয়েছে আর্থিক বৈষম্য। তবুও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রয়াস ও সুষ্ঠু পরিচালন ব্যবস্থার মেলবন্ধনে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। সূর্যস্নাত সেই যাত্রাপথের বর্ণময় ছবি এঁকেছেন -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
অবিন্যস্ত বইয়ের স্তূপ, আলমারি বা ঘরের আনাচে-কানাচে জাল বুনছে বেরসিক মাকড়সারা, সময়মত খোলে না। ধূলিধূসরিত বই-এর তাক...। সরকারি আনুকূল্যে চলা বেশিরভাগ গ্রামীণ গ্রন্থাগারের এই দশা দেখে যারা রীতিমতো বিরক্ত, তারা বানারহাট তরুণ সংঘ গ্রামীণ গ্রন্থাগারে এলে চমকে যেতে পারেন। গ্রামীণ গ্রন্থাগার হয়েও যে-কোনো টাউন লাইব্রেরির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিতে পারে।
    সুন্দর রিডিংরুম, ২৫টি আলমারিতে বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজানো রয়েছে সাত হাজারের বেশি বই, পত্র-পত্রিকা, আলো-পাখা, পুরুষ-মহিলার পৃথক শৌচালয়, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। সামনের ফুলের বাগান পেরিয়ে দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের এই লাইব্রেরিতে ঢুকলে আপনার শিরা ধমনীতে বয়ে যাবে সেই গানের সুর- ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা...’। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, নেপালি, হিন্দি এসব বিভিন্ন ভাষায় বই-এ সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগার।
    চারিদিকে চা বাগিচার সবুজ মখমল মাঝে ছোট্ট জনপদ বানারহাট। ২৩টি চা বাগিচার কেন্দ্রবিন্দু। বানারহাটের এই জ্ঞানপ্রদীপের সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল সত্তর দশকের প্রথম দিকে। তরুণ সংঘের সদস্যরা উপলদ্ধি করলেন লাইব্রেরি তৈরির প্রয়োজনীয়তা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে চলল বই সংগ্রহ। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সেদিন এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অমল কুন্ডু, গৌরকিঙ্কর ভট্টাচার্য, শুল্কা বোস, লক্ষ্মী নারায়ন মাইতি, খোকন বোস সহ আরও অনেকে। ক্লাবঘরের এক কোণে ছোট্ট আলমারি দিয়ে যাত্রা শুরু। খাতাপত্র ও বই দেওয়া নেওয়ার হিসাব রাখতেন অমলকৃষ্ণ বিশ্বাস, দেবযানী বসু। সবটাই চলত স্বেচ্ছাশ্রমে।

    এইভাবে চলতে চলতে ১৯৮১ সালের ১ জুলাই লাইব্রেরিটি সরকারি অনুমোদন লাভ করে গ্রামীণ গ্রন্থাগার হিসাবে। সে সময় জেলা সমাজ শিক্ষা দপ্তরের অধীনে চলত লাইব্রেরিগুলি। গ্রন্থাগারের জন্য পৃথক মন্ত্রক বা দপ্তর ছিল না। সরকারি তরফ থেকে একজন সাইকেল পিওন ও একজন গ্রন্থাগারিক পদের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে গ্রন্থাগারিক আসেন আরও ২ বছর পর ১৯৮৩’র ২ মে। প্রথম গ্রন্থাগারিক অমলকৃষ্ণ তরফদার বেশ ভালোভাবেই চালাচ্ছিলেন লাইব্রেরিটি। তারপর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরবর্তী সময়ে বদলি হয়ে যান। দীর্ঘদিন গ্রন্থাগারিকের পদ খালি থাকার পর কেদারেশ্বর চক্রবর্তী আসেন। তিনি পঁয়ত্রিশ কিমি দূর থেকে যাতায়াত করে এই দায়িত্ব সামলাতেন। কাজে আসতেন দেরি করে, তাড়া থাকত আগে ভাগে বাড়ি ফেরার। বুদ্ধদেববাবু যতই কর্মসংস্কৃতির কথা বলুন না কেন, তা রূপায়নের দায়িত্ব তো সরকারি কর্মীদের উপরই। গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতি তার বিরুদ্ধে বহুবার লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে। তবে তার আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০০২ সালে তিনি এই গ্রন্থাগারের দায়িত্বভার ছেড়ে দেন। তারপর থেকে এখানে কোনো গ্রন্থাগারিক নেই।
    বানারহাটের এই গ্রন্থাগারের পুস্তকসংখ্যা, পাঠক-পাঠিকা সংখ্যা, নিয়মানুবর্তিতা সবকিছু বিচার করলে এটি টাউন লাইব্রেরি হতে পারে। টাউন লাইব্রেরি হলে উপকৃত হতেন আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষেরা। পাশাপাশি থাকা গয়েরকাটা, চালসার গ্রন্থাগার টাউন লাইব্রেরির অনুমোদন পেলে বঞ্চিত হয়েছে বানারহাট। টাউন লাইব্রেরির সাথে গ্রামীণ লাইব্রেরির বৈষম্যটা চোখে পড়ার মতো। ২০০৩-২০০৪-এ বই কেনার জন্য যেখানে গ্রামীন গ্রন্থাগার পেয়েছে ৫,২২০ টাকা সেখানে টাউন লাইব্রেরি পেয়েছে ১১,৭৫০ টাকা। পরিকাঠামো বাবদ টাউন লাইব্রেরির ১৩,০০০ টাকা পেলেও সেক্ষেত্রে গ্রামীণ লাইব্রেরি পায় মাত্র ৫০০০ টাকা। টাউন লাইব্রেরির কর্মীসংখ্যা ৪ আর গ্রামীণ লাইব্রেরির ক্ষেত্রে ২। সরকারি নিয়ম অনুসারে পাঁচ হাজারের বেশি পুস্তক ও পাঁচশোর বেশি সদস্য থাকলে সেই গ্রন্থাগারকে টাউন লাইব্রেরিতে উন্নীত করা হবে। তা গ্রন্থাগারটি পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটি যেখানেই অবস্থিত হোক না কেন, হ্যাঁ সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তরুণ সংঘ গ্রন্থাগার বঞ্চিত হয়েছে। সরকারি তরফে ২০০৩-০৪-এ ৫,২২০ টাকা পেলেও বই কেনা হয়েছে ১৭,০০০ টাকার। ২০০২-০৩-এ যেখানে সরকারি অনুদান  ছিল ৩,০০০ টাকা সেখানে বই কেনা হয়েছে ১৩,০০০ টাকার। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাদানই এই স্পর্ধা জুগিয়েছে গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতিকে। সরকারি তরফ থেকে দেওয়া হয়েছিল একটি আলমারি, বাকি ২৪টি এসেছে স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে।
    সৃষ্টি লগ্ন থেকে লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন শিক্ষক শৈবাল ভট্টাচার্য। না, শৈবালবাবু শুধু শিক্ষক নয়, এলাকার যে কোনো শুভ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই মানুষটির নাম। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মান, পানীয় জল, টেলিফোন পরিষেবা, রাস্তা তৈরি সব বিষয়েই নিজে থেকে দু’পা বাড়িয়ে থাকেন। রসিক মানুষেরা আড়ালে তাকে বলেন ‘সর্বঘটে বিল্বপত্র’। শৈবাল ভট্টাচার্য বর্তমান গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির সম্পাদক। সরকারি ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে তিনি বহুদিন থেকেই সরব। গ্রামীন থেকে টাউন লাইব্রেরিতে উন্নীত করার চেষ্টায় তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। জেলাশাসক থেকে শুরু করে লোকাল লাইব্রেরি অথরিটিতে। আশ্বাস দিয়েছেন অনেকেই তবে কাজের কাজ করেনি কেউ।
    জেলার কোন লাইব্রেরিতে যা নেই, এখানে তা আছে। টেকস্ট বুক লেন্ডিং সেকশন। পাঠ্যপুস্তকের অভাবে যাতে কারও পড়াশোনা ব্যাহত না হয়, সেজন্য পরিচালন সমিতি নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি করেছে টেকস্ট বইয়ের ভান্ডার। আশেপাশের স্কুলগুলি থেকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের বেছে নিয়ে তাদের পাঠ্যবই দেওয়া হয় এক বছরের জন্য। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা মূলত এই সুবিধা ভোগ করে। বানারহাটের চারটি বিদ্যালয় ছাড়াও চামুর্চীর ভারতীয় পাঠশালাতেও এই বই দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনটি হল হিন্দি মাধ্যমের বিদ্যালয়। যাদের নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী পিছিয়ে থাকা আদিবাসী জনসমাজের। হ্যাঁ, পড়ুয়ারাও এর জন্য কৃতজ্ঞ। শিক্ষাবর্ষ শেষে বইগুলি সঠিক সময়ে জমা দিয়ে যায়। গত শিক্ষাবর্ষে দেওয়া বইগুলি একশো শতাংশ বই ইতিমধ্যে জমা পড়ে গেছে। এ বিষয়ে বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশিস পাল জানালেন- ‘পাঠ্যপুস্তকের এই সুবিধা দেওয়ার জন্য স্কুলের পঠন পাঠনে যথেষ্ট লাভ হয়েছে। তবে বইয়ের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার।’ হ্যাঁ, সমস্যা হিমালয় প্রমাণ, সমাধানের পথ সংকীর্ণ। রুগণ বা বন্ধ চা বাগানগুলির প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে এই সুবিধার আওতায় আনা প্রয়োজন। বই-এর অভাবে অনেকেই আশানুরূপ ফল করতে পারছে না। মাঝপথে ইতি দিচ্ছে কেউ কেউ।
    এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে টেকস্ট বুক লেন্ডিং-এর ক্ষেত্রে। সরকারি নির্দেশ অনুসারে এবার নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল বিভাগের সিলেবাস বদলে গেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গেছে পাঠ্যপুস্তক। তাই আগের কেনা বইগুলি বাতিলের তালিকায়। নতুন সিলেবাসের জন্য বই কেনা বিরাট আর্থিক সমস্যা। পরিচালন সমিতি এ বিষয়ে স্থানীয় বিধায়ক চৈতন মুন্ডার তহবিল থেকে আর্থিক অনুদানের আবেদন করেছেন।
    গ্রন্থাগার চালানোর ক্ষেত্রে অনেক যুবক যুবতী স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকে। শ্রীমতী নয়ন পাল বি এ পাশ করে এখন গৃহশিক্ষকতা করছেন। টেকস্ট বুক সেকশনের ক্ষেত্রে নিয়মিত কাজ করে চলছেন বিনা পারিশ্রমিকে। নয়ন এর কথায়- ‘আমি দারিদ্রের মধ্যে পড়াশোনা করেছি। সব বই কিনে পড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাই এদের অসুবিধাটা বুঝি, সে কারণে নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছি এই কাজে।’
    গ্রন্থাগার অনুমোদনের সময় থেকে সাইকেল পিওন পদে রয়েছেন সুরেশ পাল। এখন তার পদটি জুনিয়র লাইব্রেরি অ্যাসিটেন্ট। প্রন্থাগারের অন্যতম প্রাণপুরুষ। নিজের কর্মস্থলকে সন্তানের মতো ভালবাসেন। গত তিন বছর বই দেওয়া, জমা নেওয়া, ঝাড়পৌঁছ সব দায়িত্বই তিনি পালন করে চলছেন। অবসর সময়ে এই মানুষটিকে দেখা যাবে আঠার শিশি হাতে বই মেরামতের কাজে। সুরেশবাবুকে দেখলে গায়ক নচিকেতা তাঁর ‘সরকারি কর্মচারী’ গানটি নতুন করে লিখতেন।
    লাইব্রেরিটি যেখানে অবস্থিত সেই জমির দায়িত্ব উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের হাতে। বসত বাড়ির ক্ষেত্রে পাট্টা দেওয়া চালু করলেও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার নিয়মনীতি এখনও নির্ধারণ করতে পারে নি। তাই সরকারি লাল ফিতার বাঁধনে আটকে পড়ে আছে গ্রন্থাগারের জমির মালিকানা। সে কারণে গৃহ নির্মাণের জন্য বাইরে কোথাও সাহায্যের আবেদন করতে পারছেন না লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ।
    লাইব্রেরি সংক্রান্ত অসুবিধাগুলি জানানো হয়েছে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। আচ্ছা দেখছি আপনাদের ব্যাপারটা কী করা যায়.....আমাদের মাথায় রইল.... আপনারা অনেক দিন ধরে ঘুরছেন.....হায়ার অথরিটির সঙ্গে এ বিষয়ে আমি কথা বলব....। এ ধরনের আশ্বাস শুনে শুনে এখন রীতিমতো বিরক্ত পরিচালন সমিতি। দুঃখের এখানেই শেষ নয়। লাইব্রেরি পরিচালন ব্যবস্থার ভিত্তিতে গ্রন্থাগার দপ্তর পুরস্কারের প্রচলন করেছে। বিগত তিন বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল তরুণ সংঘ গ্রন্থাগারকে জেলার শ্রেষ্ঠ গ্রামীণ গ্রন্থাগার হিসাবে পুরস্কৃত করা হবে। সেখানেও হতাশ হতে হয়েছে। পুরস্কারের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী প্রীতির অভিযোগ আনছেন শৈবালবাবুরা।
 

   সমস্যা রয়েছে অনেক। বিশেষত স্কুল পাঠ্যবই-র সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। দরকার নবসাক্ষরদের উপযোগী আরও বহু বই পুস্তক। এ বিষয়ে সাংসদ জোয়াকিম বাকলা-র কাছে তিন-তিনবার আবেদন জানানো হয়েছে, সাংসদ তহবিল থেকে সাহায্যের আশায়। ফলাফল হতাশজনক। তবে গ্রন্থাগারের রিডিং রুম তৈরির সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বানারহাট গ্রাম পঞ্চায়েত। সাহায্য এসেছে চামুর্চি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকেও। চারপাশের প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছে বানারহাট ১নং গ্রাম পঞ্চায়েত। তরুণ সংঘ নিয়মিত দিয়ে চলছে বই কেনার আর্থিক সাহায্য।
    দূরদর্শনের রগরগে সিরিয়াল যে বই পাঠকের ওপর তেমনভাবে থাবা বসাতে পারে না তা প্রমাণ করে চলেছে এই গ্রন্থাগার। পাঠকসংখ্যা তো কমেনি বরং দিনের পর দিন তা বেড়েই চলেছে। ৫৫ বছরের শ্যামলেন্দু বসু দীর্ঘদিন ধরে গ্রন্থাগারের পাঠক। প্রতি সপ্তাহে দু-তিনখানি বই তাঁর চাই। শ্যামলেন্দুবাবুর সেরা পছন্দ কিশোর সাহিত্য। গোগ্রাসে গেলেন টেনিদা, প্রফেসার শঙ্কু, তারিণী খুড়ো...। পরিচালন সমিতি সভাপতি বিষ্ণু শর্মা মনে করেন টিভি চ্যানেলের আক্রমনে বইপাঠক তো কমেনি উলটে বেড়েছে। গতবছর যেভাবে দেবদাস ও চোখের বালি ইশ্যু হয়েছে তাতে প্রমাণ হয় বই ও দূরদর্শন  একে অপরের প্রতিবন্দী নয় পরিপূরক। প্রবীণদের পাশাপাশি রয়েছে নবীনেরাও সতেরো বছরের সৌরভ বড়ুয়া কিশোর বিভাগের সব বই শেষ করে ফেলেছে। এমনকি কোনো কোনো বই দু-তিনবারও।
    ‘বেশিরভাগ গ্রামীণ লাইব্রেরি সঠিক সময়ে খোলে না। সরকার বা জনসাধারণের পয়সায় কিছু লোক বসে বসে বেতন গোনে, নিন্দুকেরা এমন কথা বলেন। হ্যাঁ, শুধু নিয়মিত নয়, অনিয়মেও গ্রন্থাগারটি খোলা থাকে। রবিবার সরকারি ছুটির দিন হলেও লাইব্রেরিটি একবেলা খোলা। চাকরিজীবীদের পঠনপাঠনে যাতে ছেদ না পড়ে, সে কারণে এই ব্যবস্থা।
    শুধু বই পড়া নয়, এই গ্রন্থাগার এলাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সরকারি উদ্যোগ ছাড়াই সত্তরের দশকে এখানে অবৈতনিক বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চলত। সাঁঝের বেলায় কেরোসিন লন্ঠন ঘিরে ভিড় জমাত। সীতারাম, লছমন আরও বহু ঠেলাওয়ালা-মুটেমুজুর –হাটুয়ারা। বিকালবেলায় ছোটখাটো মেলা বসে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে। পাঠকক্ষের স্থান সংকুলানের জন্য অনেকে আবার ফুল বাগানের পাশে চেয়ার পেতেছে। সাত থেকে সত্তর বিভিন্ন বয়সি মানুষের এক বিরল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। শিশু-কিশোরদের এখন আবার অন্যরকম তাড়াহুড়ো। লাইব্রেরির দেওয়াল পত্রিকা ‘দেয়ালিকা’-র পরবর্তী সংখ্যা বের হচ্ছে। রুমাদির নেতৃত্বে লিভি, পাপিয়া, মিমো, প্রিয়াংকা, জিতুল তাই বেশ ব্যস্ত। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতোয়ারা এই কচিকাঁচারা মুহুর্তে ভুলিয়ে দেয় মূল্যবোধহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের সব বিষাদ স্মৃতি। তখন পশ্চিমের জানালা দিয়ে সিঁদুরমাখা রোদ ঝাঁপিয়ে পড়েছে লম্বা রিডিং টেবিলটাতে। পাঠমগ্ন ছোট্ট তিতাসকে বললাম, এত দিন মন দিয়ে কি পড়ছো? নিঃশব্দে প্রচ্ছদটি উলটে দেখালো-"নতুন দিনের আলো . . ." 

Join our mailing list Never miss an update