রোগ নির্ণয়ে যন্তরমন্তর;-ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৪ জুলাই, ২০১৭, মঙ্গলবার; উত্তরের সারাদিন পত্রিকায় প্রকাশিত
কবিগুরুর খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে সেই ডাক্তারের ছড়াটা মনে আছে? না, পাড়াতে আজ আর নাড়ি টেপা ডাক্তারের অতি উঁচু নাক দেখা যায় না। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভিনব আবিষ্কারের ফলে ভোল পাল্টে যাচ্ছে পরিচিত দুনিয়ার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে আসছে নিত্যনতুন অত্যাধুনিক উপকরণ। রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বহু আধুনিক যন্তর মন্তর আজ আমাদের দোরগোড়ায়। ডাক্তারবাবুরা এখন হামেশাই এইসব পরীক্ষার জন্য রোগী ও তার পরিবারকে পরামর্শ দেন। এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে কলম ধরেছেন। - ডাঃ পার্থপ্রতিম।
শরীরের ভেতরের কোনও গহ্বর বা কেভিটি নিজ চোখে দেখার ব্যবস্থাকে ডাক্তারি ভাষায় এন্ডোস্কোপি বলে। এন্ডো মানে ভেতরে ও স্কোপি মানে দেখা। এন্ডোস্কোপি করার যন্ত্রটিকে বলে এন্ডোস্কোপ। গলা দেখার জন্য লেরিঙ্গোস্কোপ, ফুসফুসের নালি দেখার জন্য ব্রঙ্কোস্কোপ, সাইনাসের ভেতর দেখার জন্য সাইনোস্কোপ, খাদ্যনালি দেখার জন্য ইসোফেগোস্কোপ, পাকস্থলি দেখার জন্য গ্যাস্ট্রোস্কোপ, ক্ষুদ্রান্ত দেখার জন্য এন্টারোস্কোপ, বৃহদান্ত্র দেখার জন্য কলোনোস্কোপ, পায়ুপথ দেখার জন্য প্রক্টোস্কোপ ইত্যাদি নানা এন্ডোস্কোপ আজকাল হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে।
এন্ডোস্কোপি ব্যাপারটা কি?
একটা সময় ছিল যখন ডাক্তারবাবুরা রোগীর শরীরের ভেতরের রোগের অবস্থা দেখার জন্য পেট-বুক কেটে তা পরীক্ষা করতেন। অনেক সময় অবস্থা বুঝে একইসঙ্গে অপারেশন করে অঙ্গ যন্ত্রের ত্রুটি ঠিক করতে হত। পরবর্তী সময়ে শরীরের ভেতর দেখার জন্য ধাতব শক্ত বা মেটালিক রিজিড কিছু স্কোপ তৈরি হয়। এরপর আবিষ্কৃত হয় অপটিক্যাল ফাইবার। এটি এক বিশেষ ধরনের সুক্ষ নল বা পাইপ। এই নলের সাহায্যে আলোর অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন ধর্মকে কাজে লাগিয়ে আলো বা ছবিকে বহু দূরে নিয়ে যাওয়া যায়। তারের সাহায্যে যেমন বৈদ্যুতিক শক্তিকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা নিয়ে যাওয়া হয়, এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম। অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করার ফলে এন্ডোস্কোপি করার কাজটা অনেক সহজ ও সরল হয়েছে।
এন্ডোস্কোপির জন্য একটি নল রোগীর মুখ বা পায়ুপথে প্রবেশ করানো হয়। এ নলটিকে কম্পিউটারের সাহায্যে চিকিৎসকেরা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্যামেরা এবং আলোক উৎস দেহের বাইরে থাকলেও অপটিক্যাল ফাইবারের বাঁকানো পথে আলো রোগীর শরীরে প্রবেশ করে এবং ক্যামেরার মাধ্যমে সে ছবি নেওয়া হয়। কম্পিউটার বা ভিডিও মনিটরের মাধ্যমে চিকিৎসক এটি পরিষ্কার দেখতে পারেন। প্রয়োজনে ভিডিও বা স্থিরচিত্র তুলতে পারেন।
এন্ডোস্কোপি বিভিন্ন ধরণের হয়, তবে পদ্ধতিটা মোটামুটি একই রকম। দেহের কোন অংশে এন্ডোস্কোপি করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে তাকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন-
ব্রঙ্কোস্কোপি- শ্বাসনালী এবং ফুসফুসের অভ্যন্তরে পর্যবেক্ষণের জন্য করা হয় ব্রঙ্কোস্কোপি।
কোলনস্কোপি- মলাশয় এবং ফুসফুসের অভ্যন্তরে পর্যবেক্ষণের জন্য করা হয় কোলনস্কোপি। সিস্টোস্কোপি-মূত্রথলি ও মূত্রসংবহনতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ পর্যবেক্ষণের জন্য করা হয় সিস্টোস্কোপি। ল্যাপারোস্কোপি বড় ধরনের কাটাছেঁড়া না করে পেটে ছোট ছোট ছিদ্র করে অপারেশন করার পদ্ধতি হচ্ছে ল্যাপারোস্কোপি। এটাও এক ধরনের এন্ডোস্কোপি। ল্যাপারোস্কোপি করার পর রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
তবে এসবের মধ্যে খাদ্যনালি, পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম ভাগ (ডিওডিনাম) একসঙ্গে দেখার জন্য আপার জি. আই এন্ডোস্কোপি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। আজকাল মহনগর, মফস্বল শহর, উপশহর প্রায় সব জায়গাতেই আপার জি. আই এন্ডোস্কোপি ব্যবহার হচ্ছে। এন্ডোস্কোপির সঙ্গে ভিডিও মনিটারিং ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার ফলে এটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। ডাক্তার, রোগী ও রোগীর আপনজন সহ সবাই স্বচক্ষে পুরো পরীক্ষা ভিডিও মনিটারে দেখে নিতে পারেন। ভবিষ্যতের জন্য পুরোটা রেকর্ডও করে রাখা যায়। অন্য বিশেষজ্ঞকে ই-মেইল করে প্রয়োজনে পরামর্শ নেওয়া যায়। কিংবা হার্ডকপি হিসেবে এর রঙিন ছবি সারাজীবন সংরক্ষিত করে রাখা যায়।
এই পরীক্ষায় রোগ নির্ণয় সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ। এর মাধ্যমে অনেক চিকিৎসাও বিনা কাটাছেঁড়ায় করে ফেলা যায়। কোনও কারণে মাংসের দলা, হাড়, দাঁত বা পয়সা যদি খাদ্যনালিতে আটকে যায় তা এন্ডোস্কোপি দিয়ে সহজেই বের করে দেওয়া যায়। খাদ্যনালি, পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম ভাগ ডিওডিনাম বা বৃহদান্ত্রের রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়। ছোট টিউমার কেটে বাদ দেওয়া যায়, বায়োপসি করে যে কোনও টিউমারের ধরণ সহজেই বোঝা যায়। আজকাল এন্ডোস্কোপের মাথায় বিভিন্ন ছোট যন্ত্র লাগিয়ে অনেক ধরণের অপারেশন করা হচ্ছে।
প্রক্রিয়া
এন্ডোস্কোপি করার জন্য রোগীকে অজ্ঞান করার ওষুধ বা অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয় না। তবে ব্রঙ্কোস্কোপি, সিস্টোস্কোপি, কোলনস্কোপির ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে অবশ করার ওষুধ বা লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়ে থাকে। ল্যাপারোস্কোপি করে অপারেশন করার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত এন্ডোস্কোপিতে আধঘন্টার মত সময় লাগে। খালি পেটে পরীক্ষাটি করতে হয়। এন্ডোস্কোপি করার আগে ছয় থেকে আটঘন্টা রোগীকে খালি পেটে থাকতে হয়। অর্থাৎ পরীক্ষা করার ছয় থেকে আটঘন্টা আগেই রোগীকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতে হবে। সেকারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সকাল ও দুপুরের দিকে এন্ডোস্কোপি করা হয়ে থাকে। অনেক সময় রোগীকে পরীক্ষার আগের দিন পায়খানা পরিস্কার করার ওষুধ, খেতে দেওয়া হয়।
আমাদের ছোট আঙুরের মতো ব্যাসের একটি নল রোগীর মুখ বা পায়ু দিয়ে প্রবেশ করাতে হয়। অনেক সময় ডাক্তারবাবু অবশ করার বিশেষ ওষুধ রোগীর গলায় স্প্রে করতে পারেন। এছাড়া অবস্থা বুঝে শিরাতেও ব্যথানাশক ইনজেকশন দেওয়া হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই, কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অস্বস্তি বোধ হতে পারে; তবে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে রোগীর সামান্য সহযোগিতা করলে সব অস্বস্তির অবসান ঘটে। পরীক্ষা করার সময় মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের কথা মেনে চলতে হয়। ভয়ে শরীরটাকে শক্ত না করে সাধ্যমতো রিলাক্স থাকুন। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টানুন, মুখের মধ্যে দেওয়া পেগটি শক্তভাবে কামড়িয়ে রাখুন। পাইপটা গলার প্রথম অংশ পার হওয়ার সময়ই অস্বস্তিটা সবচেয়ে বেশি হয়, এক ধরণের সুড়সুড়ি লাগে। তবে অযথা ভয় পেয়ে এমন অত্যাধুনিক চিকিৎসা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না।
খরচপত্র
এন্ডোস্কোপি এখন ছোট-বড় নার্সিংহোম বা প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবগুলিতেই হয়ে থাকে। নার্সিংহোম বা ল্যাবের সুনাম, কৌলিন্য, পরিকাঠামো, শরীরের কোন অংশের এন্ডোস্কোপি করছেন, কোন শহরে করছেন সেই অনুসারে এন্ডোস্কোপি করার খরচ বা চার্জ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে আপার জি. আই এন্ডোস্কোপি খরচ মোটামুটিভাবে ১৫০০/- থেকে ২৫০০/- এর মত।