“ মেলা বই- বইমেলা ”

“ মেলা বই- বইমেলা ”

“ মেলা বই- বইমেলা ”; -ডাঃ পার্থপ্রতিম। ৩১তম জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলা ; ১৭-২৩ শে ডিসেম্বর ২০১৯ স্মরণিকায় প্রকাশিত
     বই নিয়ে মেলার ইতিহাস প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো। জোহান্স গুটেনবার্গ (Johannes Gutenberg)  ছাপা প্রযুক্তির আবিষ্কারের পরে পরেই ছাপা বই বাজারে আসতে শুরু করে। তার কয়েক দশক পরেই ইউরোপে বইমেলার সূচনা। প্রথমে বইমেলা শুরু হয়েছিল স্থানীয় কিছু পুস্তক বিক্রেতাদের প্রচেষ্টায়। বাণিজ্যিক আদান প্রদানের নিরিখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা জার্মানীর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট। ১৭০০ শতাব্দীতে এই মেলা ইউরোপে জনপ্রিয় বইমেলা হিসাবে জায়গা করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মেলা বহু বছর বন্ধ ছিল। ১৯৪৯ সাল থেকে আবার এই মেলা নতুন রূপে যাত্রা শুরু করে। শুধু প্রকাশক নয়, বই বিক্রির এজেন্ট, লাইব্রেরীয়ান, শিক্ষাবিদ, বইয়ের অলংকরণে যারা থাকেন, অনুবাদক, ফিল্ম প্রডিউসার, বইয়ের চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, সকলের কাছেই এই মেলাটি বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয়।
    সাধারণ বইপ্রেমীদের থেকেও এটি বেশি আকর্ষণীয় প্রকাশনা সংস্থার কাছে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার প্রকাশকেরা তাদের প্রকাশিত বইয়ের কপিরাইট, পাবলিকেশনস লাইসেন্স এই নিয়ে বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক চুক্তি হয় এই মেলাতে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে ফ্রাঙ্কফুর্টের বাণিজ্যমেলা ময়দানে এই মেলা বসে। পাঁচদিনের এই বইমেলা প্রথম তিনদিন প্রকাশক ও লেখকদের জন্যই নির্ধারিত। শেষের দু’দিন সাধারণ দর্শক ও পুস্তক প্রেমীদের জন্য এই মেলা উন্মুক্ত করা হয়। প্রায় একশোটির বেশি দেশ থেকে তিনলক্ষ দর্শক এই মেলায় আসে। স্টলে সংখ্যা সাতহাজারেরও বেশি।
    এবার আসা যাক ভারতের বিভিন্ন বইমেলা প্রসঙ্গে। দিল্লিতে দু’টি বইমেলা হয়। দিল্লী বুক ফেয়ার এবার পঁচিশ বছরে পা দিল। আগষ্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে চলে এই বইমেলা। প্রায় ৫ লক্ষ দর্শক, পুস্তকপ্রেমী এই মেলা উপভোগ করে। ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহ থেকে আরও একটি বইমেলা হয় এই প্রগতি ময়দানেই। যার নাম ‘নিউ দিল্লী ওয়ার্ল্ড বুক ফেয়ার’। ভারত সরকারের ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের এই মেলাটি এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে বৃহত্তম বইমেলা। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে জয়পুরের আম্বেদকর চকের এস.এম.এস স্টেডিয়ামে বইমেলা হয়।
    বুক সেলার্স এন্ড পাবলিশার অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইন্ডিয়ান (Book Seller’s and Publishers Association of South Indian)  ডিসেম্বর মাসের ১০ দিন ব্যাপী চেন্নাইতে বইমেলার আয়োজন করে। ১১ই ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারী  পর্যন্ত হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষের অন্যতম হায়দ্রাবাদ বইমেলা। ব্যাঙ্গালোর বুক সেলার্স এবং পাবলিশার অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবছর ব্যাঙ্গালোর প্যালেস গ্রাউন্ডে নভেম্বর মাসে বইমেলার আয়োজন করে থাকে। এই মেলায় ১ লক্ষ দর্শক আসেন এবং কয়েক কোটি টাকার বই কেনা-বেচা হয়। কেরালা সরকারের সাংস্কৃতিক বিভাগের উদ্যোগে তিরুবানন্দপুরম শহরে বসে ত্রিবান্দম বইমেলা। যা কেরালার অন্যতম বই বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহারাষ্ট্র সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে পুনে শহরে প্রতিবছর সাধারণত অক্টোবর মাসে পাঁচদিনব্যাপী পুনে বইমেলা বসে। পুনে শহরের পত্রকার নগরের কামায়ণী ময়দানে এই মেলা স্থানীয় মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। গুড গভর্নেন্স ইন্ডিয়া ফাউন্ডডেশন এর উদ্যোগে প্রতিবছর জানুয়ারী মাসে ব্রান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সে মুম্বই আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজিত হয়ে আসছে।
    এবার আমাদের রাজ্যে আসা যাক। জনসমাগম ও দর্শকের নিরিখে কলকাতা বইমেলাই বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা। ১৯৭৬ সালে এই বইমেলা শুরু হয়। নাম কলকাতা পুস্তক মেলা। ইংরেজিতে (Calcutta Book Fair)। প্রথমে স্থানীয়ভাবে শুরু হলেও আস্তে আস্তে এর কলেবর বাড়তে থাকে। ১৯৮৪ সালে এই মেলা আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি পায়। এখন মোটামুটিভাবে জানুয়ারী মাসের শেষ বুধবার থেকে ১২ দিন ধরে এই মেলা চলে । অনেক মাঠঘাট পেরিয়ে বর্তমানে এই মেলাটি এসেছে কলকাতা পুরসভার তৈরি মিলনমেলা প্রাঙ্গনে। মেলাটি আন্তর্জাতিক হলেও এখানে বাংলা বইয়ের দাপট বেশি। তবে ইংরেজি, হিন্দি, ঊর্দু, সংস্কৃত অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় বইপত্র হাজির হয় এই মেলায়। পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশ বিদেশের বইও। বিভিন্ন দূতাবাসের স্টল বা প্যাভিলিয়ন তাদের দেশের নির্বাচিত বইগুলি নিয়ে হাজির হয়। প্রকাশকেরাও তাদের নতুন বই নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এই মেলায়। কথায় বলে বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। এখন অনেকেই বলেন কলকাতা বইমেলা বাঙালীর চতুর্দশ পার্বণ। বইয়ের পাশাপাশি থাকে ছবি, তথ্য প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরো কত কি। এই মেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন অন্যতম আকর্ষণ। বাণিজ্যিক স্বার্থের বাইরে ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা তাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতিকে তাদের মতো করে তুলে ধরে। কলকাতা বইমেলার এক ছোট্ট টেবিল মুষ্টিবদ্ধ হাত উদ্দোলিত করে লিটিল ম্যাগাজিনের দল। তাতে সাজানো বিভিন্ন সংখ্যা, আপোশহীন সাহিত্য আন্দোলনে এক ভিন্নমাত্রাবহন করে।
    ১৯৭৬ সালে এই মেলার উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজ্যপাল এ.এল ডায়াস। তারপর অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এই মেলার উদ্বোধক হয়েছেন- অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, অর্মত্য সেন, সাহিত্যিক মুলুকরাজ আনন্দ, ড্যানিয়েল পেনাক, আলেক্সজেন্ডার ম্যাক কল স্মিথ আরো অনেকে।
    ভারতে বড়োসড়ো বইমেলার আয়োজনের ইতিহাস খুব পুরানো নয়। ষাট-এর দশকে মুম্বাই চার্চ গেটের ময়দানে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট (NBT)  প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করে। এরপর দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাইতে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট জাতীয় বইমেলার আয়োজন করলেও; কলকাতার বিষয় বিভিন্ন কারণে তারা উৎসাহ দেখাননি। কলকাতার ইউ.এন্ড.ধর এন্ড সন্স প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার বিমল ধর ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৭৪ সালে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি বইমেলার আয়োজন করেন। এর পরেই শুরু হয়ে যায় কলকাতায় বড়ো মাপের বইমেলা করার তোড়জোড়। ১৯৭৫ সালে কলকাতার ১৪টি প্রকাশনা সংস্থা ও পুস্তক বিক্রেতা সংস্থা একজোট হয়ে গড়ে তোলেন পাবলির্শাস অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। এই গিল্ডের উদ্যোগেই ১৯৭৬ সালে ৫ই মার্চ কলকাতা পুস্তক মেলা শুরু হয়। এই মেলা চলেছিল ১৪ই মার্চ পর্যন্ত। এখন যেখানে মোহর কুঞ্জ উদ্যান রয়েছে ঠিক সেখানেই সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল চার্চ; বিড়লা তারামন্ডলের উল্টোদিকে এই মেলা প্রথম বসে। সহযোগিতা এসেছিল বিভিন্ন স্তর থেকে। মেলার মাঠের ভাড়া মুকুব করে দেন কলকাতার ডিসি হেডকোয়ার্টার অর্চিষ্মান ঘটক। মেলার প্রবেশদ্বারের নকশা তৈরি করেছিলেন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। প্রথম মেলাটিতে সেভাবে কলকাতার সব প্রকাশকেরা যোগ দেননি। কিন্তু বিরাট সংখ্যক দর্শক এই মেলা দেখতে যায়। তার পরের বছরেই ১৯৭৭ সালে কলকাতা দ্বিতীয় বইমেলায় প্রায় ১ লক্ষ ৯৬ হাজার দর্শক আসে। বইও বিক্রি হয় ১ কোটি টাকার বেশি। তারপর থেকে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশক ও বিক্রেতার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলে। প্রথম মেলার সভাপতি ছিলেন জিজ্ঞাসা প্রকাশনার কর্ণধার শ্রীশ কুমার কুন্ডা। গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুশীল মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলমতের মানুষ যুক্ত ছিলেন এই মেলার আয়োজক হিসাবে।
    ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ কলকাতা বইমেলার আগে ডিসেম্বরে মাসের শেষদিকে দশ বারো দিন ধরে আরো একটি বইমেলার আয়োজন করে। এই বইমেলা ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত প্রতিবছরই হয়। এই বইমেলাটির নাম ছিল পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা। লোকমুখে মেলাটি সরকারি বইমেলা নামে পরিচিত ছিল। দুর্মুখেরা বলত এটি ‘লালু’ বইমেলা। এই বইমেলায় বামপন্থী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি ও প্রকাশকদের আস্ফালন ছিল প্রচন্ড। এখানেও ভিনরাজ্যের কিছু প্রকাশককে নিয়ে আসা হত। তবে যাইহোক জনমানসে এই মেলার তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে বঙীয় প্রকাশনা সংস্থা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সে সময়কার যুবকল্যাণ ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিদেশি কায়দায় একটা ছোট বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। তবে ১৯৭৪ সালে সরকারী বইমেলা মুখ থুবড়ে পড়ার পর কলকাতা বইমেলা পূর্বভারতের একমাত্র বড়ো বইমেলা হয়ে ওঠে। সরকারও এই বইমেলাকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়।
    সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর কথায়- ‘মেলা মানেই ঝামেলা’। কলকাতা পুস্তক মেলা এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৯৭ সালে বইমেলা সেদিক থেকে স্মরণীয়। সেবছর বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স। মেলার উদ্বোধক করেছিলেন স্বনামধন্য ফরাসি সাহিত্যিক জাঁক দেরিদা। সে বছর আগুন লেগে পুরো মেলা পুড়ে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে যতীন শীল নামে এক গ্রন্থপ্রেমী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। প্রচুর টাকার বই পুড়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতিও হয় অনেক কিছুর।
    কলকাতা ময়দান কলকাতার ফুসফুস বলেই পরিচিত। নগরের কংক্রিট জঙ্গলে এখানেই রয়েছে সবুজের সমারোহ। কিন্তু একের পর এক মেলা ও উৎসবের ফলে ময়দানের সেই সবুজ অনেকটাই কমতে শুরু করে। দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে -এই অঞ্চলের আকাশ বাতাসে। কয়েকটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ময়দানে মেলা করা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে তাদের আপত্তি জানায়। হাইকোর্ট এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তাদের চিন্তাভাবনা জানতে চান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতে জানিয়ে ছিলেন ইর্স্টান মেট্রোপলিটন বাইপাসের ধারে এক সুসংগত মেলা প্রাঙ্গন তৈরি করে সেখানেই সব মেলাকে স্থানান্তরিত করা হবে। তারপর ২০০৫ সালে এক আবেদনের ভিত্তিতে ময়দানে বইমেলা করার অনুমতি আদালত থেকে মেলে। একই ঘটনা ঘটে ২০০৬ সালে; সেবার আদালত জানিয়ে দেয় আর এরপর থেকে ময়দানে বইমেলা করা যাবে না।
    ২০০৭ সালে গিল্ড আবার ময়দানে বইমেলা করতে চায়। সে বছর ‘ময়দান বাঁচাও’ নামে এক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ময়দানে বইমেলা করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। কলকাতার উচ্চ আদালত ময়দানে বইমেলা নিষিদ্ধ করে। তারপর বিভিন্ন কয়েকটি জায়গায় ফেরার পর মিলনমেলা প্রাঙ্গনে আবার জোরকদমে কলকাতা পুস্তকমেলা শুরু হয়।
    কালি, অক্ষর, দিস্তা দিস্তা কাগজ, ছাপাখানায় বই তার আবার মেলা! বিষয়টা কি একটু বেমানান? সহজ উত্তর ‘না’। লেখকের কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনা ভিত্তিক পর্যবেক্ষণলব্ধ উপলব্ধি, অনুভূতি, বা দৃষ্টিভঙ্গি ঐ ছাপার অক্ষরে বইয়ে প্রকাশিত হয়।  কোন লেখকের সেই উপলব্ধি বা দৃষ্টিভঙ্গি ঐ বইয়ের মধ্যে পরিস্ফুট হয়, যখন ঐ বইটি কোন অনিসন্ধিৎসু পাঠক পড়েন তখন সেই দৃষ্টিভঙ্গি বা উপলব্ধি সেই পাঠকের মনে আঘাত করে। সেই আঘাতে পাঠকের মন আন্দোলিত হয়। ফলশ্রুতিতে যুক্তি-তর্ক আলোচনার ভিত্তিতে নতুন চিন্তা, চেতনার বিস্তার ঘটে। এক কথায় বলতে গেলে জ্ঞান বা বোধের সঞ্চালন হয়। সমাজে যদি এই বোধের সঞ্চালন সচল ও স্বাভাবিক থাকে তবেই এগিয়ে চলে সভ্যতা। এটি যদি না ঘটে তাহলে সমাজ-সভ্যতা সংস্কৃতির পেছনের দিকে চলবে; যা মোটেও কাম্য নয়। তরবারি কিংবা বন্দুক দিয়ে হয়তো লেখক-লেখিকাকে মারা যায়; নতুন চিন্তা, ভাবনা প্রণেতাদের টুঁটি চেপে ধরা যায়। কিন্তু একটি বই- তার মধ্যে প্রস্ফুটিত চিন্তা, চেতনা, আবেগ, বোধকে কোন অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা যায় না। আমাদের দেশের আগুন ঝরানো স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কাজী নজরুল ইসলাম যখন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখলেন; তখন ব্রিটিশ সরকার ঐ পত্রিকা বন্ধ করেও বিদ্রোহী কবিতার যে আহ্বান তাকে রোধ করতে পারেন নি।
    কবিগুরু বঙ্গভঙ্গের সময় একের পর এক গান, কবিতা, প্রবন্ধ লিখে গেছেন। তার চিন্তা, চেতনার আবেগে যুবসমাজকে আন্দোলন থেকে নিরস্ত্র করতে ব্রিটিশরা পারেন নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কবিগুরুর প্রতিবাদী লেখনী যখন ‘আফ্রিকা’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল; তখন সারা পৃথিবী জুড়ে সাধারণ মানুষ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী মুক্তির লড়াইতে নতুন মাত্রা এনেছিল। সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী কোন রাষ্ট্রশক্তি হয়তো বই পুড়িয়ে দিতে পারে; কিন্তু বই থেকে উৎসারিত জ্ঞান, বোধ, প্রজ্ঞা, আলো -দাবিয়ে রাখা যায় না। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। এক সময়ের পৃথিবীর একছত্র অধিপতি হিটলার বার্লিনে জার্মান দার্শনিক, কবি, শিল্পীদের অবিস্মরনীয় সৃষ্টি, বইগুলি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বইগুলিতে প্রকাশিত চিন্তার সঞ্চালনকে স্তদ্ধ করতে পারেন নি।
    সরকার বা  ক্ষমতাসীন দলগোষ্ঠীর বিরাজ ভাজন হয়েছেন বহু লেখকই। নিষিদ্ধ হয়েছে তাদের গ্রন্থ। শাসক বা শোষকের ক্ষমতার আস্ফালনে দেশত্যাগী হয়েছে বহু লেখক-লেখিকা। বহুযুগ আগে থেকে শুরু হওয়া এ ধারা আজও নিত্যবহমান। ১৭৮৯ সালে প্রকাশিত মারকুয়িস দি স্যাডির উপন্যাস ‘দি ১২০ ডেইজ্ অফ সাডাম’, ১৭৫৯ সালে প্রকাশিত ওনারি দি বালজাক এর ‘ডল স্টোরিস’, ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলের লেখা ‘কমিউনিস্ট মেনোফেস্টো’ নিষিদ্ধ হয়। এই তালিকা বহু দীর্ঘ করা যেতে পারে। যখনই কোন গ্রন্থ কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে তখনই বেরিয়ে এসেছে ক্ষমতাসীনের লুক্কায়িত নখদন্ত। আসলে গ্রন্থ বা পুস্তক অবসর বিনোদনের উপকরণ নয়। এটা অনেকক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে জনজাগরণের হাতিয়ার। মানুষের ব্যতিক্রমী ভাবনা, শ্রেণী চেতনা, বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিশান হয়ে মাথা তুলেছে দু’ই মলাটে বন্দী কাগজের দস্তাবেজ। বইমেলার সুনীল আকাশে সেই হাজার নিশানের সন্মিলিত কলতান।  
    বই অজানাকে জানতে সাহায্য করে, দূরকে করে আপন। জীবনের ভিত্তিভূমি শুধু ঠিকই করে না; বই নতুন পথ, নতুন মতের দিশা দেয়। বেশি টাকা দামের সুদৃশ্য বাঁধাইয়ে মোড়া বই ঘরের  ক্রেতাদুরস্ত আলমারী ভরাট করবার জন্য নয়- বই থেকে আহরিত জ্ঞানের আলোকে নিজের ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবন গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে আলোচনার  অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। কোনটা ভালো- কোনটা মন্দ, কোনটা সাদা- কোনটা কালো, কে শত্রু- কে মিত্র এটা চেনার জন্যই তো বইমেলা নামক  চিরনবীন উৎসবের  আয়োজন।
    বইমেলার অনেক রূপ। একগাল দাঁড়ি কাঁধে ঝোলা নিয়ে ইতঃস্তত ঘুড়ে বেড়ানো আধুনিক কবি; তার সঙ্গে ফুচকা-এগরোল-কফির স্টল। তার পাশে শীতের হিমেল সন্ধ্যায় দারিদা-ফুকো নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রাগৈতিহাসিক বাক্যালাপ। কিন্তু এই চেনা ছকের বাইরেও একটা নিজস্ব ছন্দ আছে বলেই বইমেলা এত প্রাণবন্ত! আজকে পশ্চিমবঙ্গের জেলা, মহকুমা, ব্লক, মফস্বল, আধা মফস্বল শহরেও বইমেলা একটা পরিচিত ঘটনা। বৎসরান্তে অন্যান্য উৎসব। তবে আরম্ভর, উৎসাহ, জাঁক জমকের মাঝেও বই এখনও আমাদের ভাবায়। বইমেলার স্টলে-স্টলে থরে-থরে সাজানো বইগুলোতে, ছাপার অক্ষরে লেখাগুলোর ভেতরে হয়তো এক চিরন্তন শক্তি লুকিয়ে আছে। মহাপ্রলয় ছাড়া যে শক্তির হয়তো বিলয় নেই। সেই ‘লীন’-শক্তিকে কার্যকরী শক্তির রূপ দিতেই তো বইমেলার আয়োজন।

Join our mailing list Never miss an update