মোটর নিউরোন ডিজিজ -এখনো এক চ্যালেঞ্জ

মোটর নিউরোন ডিজিজ -এখনো এক চ্যালেঞ্জ

মোটর নিউরোন ডিজিজ -এখনো এক চ্যালেঞ্জ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২২শে নভেম্বর ২০০৮; পৃষ্ঠা-৩; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
আমাদের শরীর জুড়ে রয়েছে এক সুবিশাল স্নায়ুর জাল। এই স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভস সিস্টেমের জন্য রূপ, রস, গন্ধ, বৈচিত্র্য ও সংঘাতে ভরা এই দুনিয়ায় বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনের দিনগুলি কাটিয়ে থাকি। বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারি। প্রয়োজনে সেই উপলব্ধি বা উত্তেজনায় সাড়া দিয়ে থাকি। একটা ছোট উদাহরণের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা সহজে বোঝা যেতে পারে। যেমন, আপনার পায়ে কাঁটা ফুটলো সেই বেদনা আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে। মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ আসে আপনার পা টাকে সরিয়ে নেওয়ার। এই নির্দেশ সবার প্রথমে আসে পায়ের মাংসপেশীতে, মাংসপেশী নড়াচড়া করে বা সঙ্কুচিত করে কাঁটা বিছানো পথ থেকে আপনার পা-টিকে সরিয়ে ফেলেন। মস্তিষ্ক থেকে পেশীতে যে সব স্নায়ুকোষের মধ্যে দিয়ে নির্দেশ আসে; সেই স্নায়ুকোষগুলিকে বলে মোটর নার্ভ । এই মোটর নার্ভ বা স্নায়ুকোষ নিউরোনের মধ্যে দিয়ে আসা সংকেতটা আসলে বৈদ্যুতিক সংকেত । কোন কারণে এই বৈদ্যুতিক সংকেত না পৌঁছালে বা মোটর নিউরোন কোষগুলি ঠিকমত কাজ না করতে পারলে মাংসপেশীগুলির উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ আপনার ইচ্ছা করছে পা-টিকে সরিয়ে নেবার; কিন্তু আপনি সেটা পারছেন না। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার যে, আমাদের শরীরে যে সব পেশী রয়েছে তাকে মোটামুটি ভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন, যে পেশীগুলিকে আমরা ইচ্ছামতো নড়াচড়া করতে পারি তাকে বলে ভলেন্টারী মাসল বা ঐচ্ছিক পেশী। আর যেসব পেশি আমরা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের বলে ইনভলানটারি মাসল বা অনৈচ্ছিক পেশি। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে বিভিন্ন রকমের স্নায়ু আলাদা আলাদা কাজ করে। কিছু স্নায়ু আছে যারা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে অনুভূতি বা সংবাদ মস্তিষ্কে নিয়ে যায়। এদের বলে অন্তর্বাহী স্নায়ু বা অ্যাফারেন্ট নার্ভ।
আবার কিছু স্নায়ু আছে যারা মস্তিষ্ক ও সুষুম্নকান্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে সংবাদ বা নির্দেশ পাঠিয়ে থাকে। এদের বলে বহির্বাহী স্নায়ু বা ইফারেন্ট নার্ভ। যেহেতু মস্তিষ্ক থেকে উত্তেজনা ও নির্দেশ বহন করে দেহের বিভিন্ন অংশে চালনা করে সেজন্য এদের প্রেরক স্নায়ুও বলা হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন হাত, পা ও অন্যান্য সব কিছু এই নার্ভ দ্বারা পরিচালিত হয় বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর পরিচিতি চেষ্টিয় স্নায়ু বা মোটর নার্ভ নামে।

    স্নায়ুতন্তু তৈরি হয় বিভিন্ন স্নায়ুকোষগুলিতে তৈরি হওয়া নিউরোন, অ্যাক্সন ও ডেনড্রনের মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটা অনেকটা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মতো। ডেনড্রনের মধ্য দিয়ে খবর পৌঁছায় স্নায়ুকোষ বা নিউরানে। সেই সংবাদ নিউরোন থেকে অ্যাক্সনের মধ্যে দিয়ে আরেকটি স্নায়ুকোষ ডেনড্রনে চলে যায়। এইভাবে কোনো সংবাদ বা নির্দেশ ডেনড্রন-নিউরোন-অ্যাক্সন আবার ডেনড্রন নিউরোন-অ্যাক্সন হয়ে মস্তিষ্ক থেকে দেহের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। তারপর সেই নির্দেশমতো পেশিগুলি কাজ করে। মোটর নিউরোন ডিজিজ হলে মস্তিষ্ক বা স্পাইনাল কর্ড থেকে পেশিতে নির্দেশ যাওয়ার এই যে ব্যবস্থা তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে যেসব পেশি আমরা ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সেগুলি আর পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই মোটর নিউরোন ডিজিজ হলে বিভিন্ন মাংসপেশি অচল হয়ে যায়। তবে প্যারালাইসিসের মতো অসাড় হয় না।
রোগের প্রথম দিকে রোগীর হাত থেকে জিনিস পড়ে যায়। বিশেষত শিশি, বোতলের মুখ খোলা, কলের মুখ খোলা এসব ক্ষেত্রে রোগী অসুবিধা বোধ করে। রোগী তাঁর হাঁটাচলায় ভারসাম্যের অভাব লক্ষ্য করে এবং মাঝে মাঝে টাল খায়। আক্রান্ত পেশী আরষ্ঠো হয়ে আসে এবং হেঁচকা টান লাগে। বিশেষত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে রোগীর বড় অসুবিধা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগটি দীর্ঘদিন হয়ে গেলে তাঁর শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
রোগের শেষ পর্যায়ে রোগীর কথাবার্তা, কোন কিছু খাবার চিবানো বা গেলার মতো অবস্থা থাকে না। রোগী পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস-এর সাথে মোটর নিউরোন ডিজিজের মূল ফারাকটা হল পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর যে অংশে পক্ষাঘাত হয়েছে সেই অংশ অসাড় বা অবশ হয়ে পড়ে। সেই অংশে হাত দিলে সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মোটর নিউরোনের ক্ষেত্রে রোগীর আক্রান্ত অংশে সাড় থাকে অর্থাৎ ছুঁলে বা মশা কামড়ালে সে বুঝতে পারে শুধু সে নাড়াতে পারে না। তবে গবেষণা থেকে দেখা গেছে, রোগীর পায়খানা ও প্রচ্ছাবের বেগ নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন কষ্ট হয় না। রোগীর কানে শোনার শক্তি, স্বাদ, অনুভূতি, চোখের দৃষ্টি, মেধা, স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষের মতোই থাকে। শুধুমাত্র সচল অংশ ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে।
রোগ আক্রমণের পর কতদিনে সে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বা রোগ লক্ষণ কতদিনে রোগীকে পুরোপুরি অসুস্থ করে দেবে- সেই সময় কাল এক একটি রোগীর কাছে একেক রকম হয়। ব্রিটিশ মোটর নিউরোন ডিজিজ অ্যাসোসিয়েশন এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে তিন বছরের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ(৫০%) রোগী পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। দশ শতাংশ(১০%) রোগীর ক্ষেত্রে এই সময়টা লাগে দশ বছর। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে রোগ আক্রমণের কুড়ি বছর পর্যন্ত সে মোটামুটি নিজের কাজ নিজে করতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগ উপসর্গ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে; আবার কোন রোগীর ক্ষেত্রে বছরের পর বছর অবস্থা একই রকম থাকে।
মোটর নিউরোন ডিজিজকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাগে ভাগ করেছেন। যেসব স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্ক থেকে স্পাইনাল কর্ডে নিয়ন্ত্রণ বার্তা নিয়ে যায় তারা আক্রান্ত হলে তাকে অ্যামাইওট্রফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস সংক্ষেপে এ.এল.এস বলে। আমেরিকায় এ ব্যাধির নাম লু গেহরিগ’স ডিজিজ। আমেরিকার বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় লু গেহরিগ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগটি নিয়ে ব্যাপক শোরগোল হয়। সেই থেকেই এরকম নাম।
মোটর নিউরোন রোগ নির্ণয় বেশ জটিল। যেহেতু এই রোগ খুব অল্প সংখ্যক মানুষের হয় তাই প্রথম পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে বেশ বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ ডাক্তার বা জেনারেল প্র্যাকটিশনার যখন রোগীকে নিউরোলজিস্টের বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান তখনই রোগের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় সম্ভব হয়। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয়। এই রোগ শনাক্ত করার জন্য অনেক সময় মাংসপেশির বায়োপসি করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রোমাইলোগ্রাফ পদ্ধতিতে মাংসপেশির মধ্যে বিভিন্ন সূচ ফোটানো হয় এবং পেশির মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ তরঙ্গকে মাপজোখ করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রো মাইলোগ্রাফ হল মোটর নিউরোন ডিজিজ নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

সাধারণ ডাক্তারবাবু বা জেনারেল প্র্যাকটিশনার যখন রোগীকে নিউরোলাজিস্টের বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠান তখনই রোগের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় সম্ভব হয়। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা- নিরিক্ষার দরকার হয়। এই রোগ সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে মাংসপেশীর বায়োপসি করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রো মাইলোগ্রাফ পদ্ধতিতে মাংসপেশীর মধ্যে বিভিন্ন সূঁচ ফোটানো হয় এবং পেশীর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ তরঙ্গকে মাপঝোপ করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রো মাইলোগ্রাফ হল মোটর নিউরোন ডিজিজ নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
মোটর নিউরোন ডিজিজ নিয়ে এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক গবেষণা চলছে। তবে এ রোগের প্রকৃত কারণ এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। অর্থাৎ কী কারণে একজন ব্যক্তি এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়, তা এখনও রহস্যঘেরা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই রোগ পুরোপুরি সারিয়ে তোলার প্রযুক্তি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে রোগী যাতে দীর্ঘদিন ভালো এবং তার প্রাথমিক অসুবিধাগুলি যতটা সম্ভব কমিয়ে দেওয়ার জন্য ডাক্তাররা চেষ্টা চালান। চেষ্টা করেন রোগের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে কমিয়ে আনার। রোগীকে প্রয়োজনে লাঠি বা সেই ধরনের হাঁটাচলার উপকরণ দেওয়া হয়, যাতে রোগী নিজে থেকে হাঁটাচলা করতে পারেন। ফিজিওথেরাপির সাহায্যে বিভিন্ন জয়েন্ট বা সন্ধিকে যতটা সম্ভব সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। রোগের শেষ পর্যায়ে কথা বলার অসুবিধা দেখা দিলে স্পিচ থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়ার দরকার হয়।
এই ধরনের রোগীর চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে রোগীর পরিবার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক অবসাদের শিকার হন। এই অবসাদ কাটানোর জন্য রোগীকে তাঁর পরিবার যাতে একলা ফেলে না রাখে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। রোগীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা করলে তিনি মনের দিক থেকে অনেকটা সুস্থ বোধ করবেন। রোগীর বাড়িতে যদি ছোটো শিশু বা নাতি-নাতনিরা থাকে তবে তাদের রোগীর কাছে পাঠান । তার সঙ্গে খেলতে ও কথা বলতে দিন। তাহলে রোগী একলা অনুভব করবেন না। রোগীকে তার রোগ সম্বন্ধে বা রোগের প্রতি-প্রকৃতি ধীরে ধীরে জানিয়ে দিতে হবে। রোগী যাতে নিজেকে একলা এবং ঘরের অপ্রয়োজনীয় বস্তু হিসাবে মনে না করেন, তাই বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করুন। তবে সবক্ষেত্রেই রোগীর মতামতকে মেনে চলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু আলোচনা করতে দোষ কোথায়।
সাধারণভাবে চল্লিশ (৪০) পেরিয়ে যাওয়া মানুষেরা এই অসুখে বেশি আক্রান্ত হন। পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছর বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ তীব্রভাবে দেখা যায়। ব্রিটেনে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মোটর নিউরোন ডিজিজে আক্রান্ত। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা একটু বেশি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ২ জন মানুষের মধ্যে এ ধরনের অসুখের লবণ দেখা যায়। এ রোগের পেছনে কেউ কেউ বংশগত প্রবণতাকে কিছুটা দায়ী করেন। ব্রিটিশ মোটর নিউরোন ডিজিজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ডাক্তার বেলিন্দা কিউপিড জানিয়েছেন, এই রোগের ৯৫ শতাংশ কারণ এখনও অজানা।

রোজকার খাবার থেকেই পরিপাক ও বিপাক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি পাই। শরীরের মধ্যে যে অবিরাম বিপাকক্রিয়া চলছে তার ফলে তৈরি হচ্ছে ফ্রি র‌্যাডিক্যাল। ফ্রি র‌্যাডিক্যালগুলি দেহের বিভিন্ন যৌগের সঙ্গে বিক্রিয়া করে দেহের ক্ষতি করে। ফ্রি র‌্যাডিক্যালের প্রভাবে কোষের পর্দা বা সেল মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি কোষের মস্তিষ্ক বা নিউক্লিয়াসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেকে ফ্রি র‌্যাডিক্যালগুলিকে মোটর নিউরোন ডিজিজের অন্যতম কারণ হিসাবে দায়ী করেন। তাঁরা রোগীকে বেশি পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট খাওয়ার পরামর্শ দেন। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হল এমন  কিছু পদার্থ যা ফ্রি র‌্যাডিক্যালকে নিষ্ক্রিয় করে শরীরকে বিপদমুক্ত করে তোলে। সহজ করে বলতে গেলে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হল যা মৌলিক অক্সিজেন অণুগুলির রোগভোগ বাধানো, বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার কাজকে বাধা দেয়। মৌলিক অক্সিজেন অণু চেষ্টা করে দেহের ভেতরে থাকা বিভিন্ন পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে তার গুণাগুণ ও ব্যবহার পালটে দিতে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট অক্সিজেনের এই ধ্বংসাত্মক কাজকে প্রতিহত করে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট পাওয়া যায় সব রকম রঙিন ও টাটকা শাক, সবজি এবং ফলমূলে। যেমন আম, কাঁঠাল, গাজর, বিট, কালোজাম, পাকা কুমড়ো, টম্যাটো, সব রকমের লেবুতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। আসলে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হল বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও কিছু খনিজ পদার্থ যা দেহের বিভিন্ন যন্ত্রের কাজকে কিছুটা হলেও বাধামুক্ত করে। কৃত্রিমভাবে তৈরি করে এইসব ভিটামিন বা খনিজ ট্যাবলেট ক্যাপসুল আকারে বাজারে পাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা সমীক্ষা চালিয়ে দেখছেন, প্রাকৃতিক খাবারে মোটামুটিভাবে ১০০ শতাংশ কাজ হয়। আর কৃত্রিম ট্যাবলেট ক্যাপসুল কাজ করে শতকরা কুড়ি থেকে পঁচিশ ভাগ। তাই তেমন কোনো অসুবিধা না থাকলে পেটপুরে খান শাকসবজি, ফলমূল, স্যালাড।
স্নায়ুকোষের মধ্যে থাকা গ্লুটামেট বেড়ে যাওয়াকে অনেকে মোটর নিউরোন ডিজিজের কারণ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। গ্লুটামেট হল আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের এক ধরনের রাসায়নিক দূত বা বার্তাবাহক। স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর থেকে বিভিন্ন সংকেত আদান প্রদানের ক্ষেত্রে গ্লুটামেট এক ধরনের ক্যুরিয়ার সার্ভিসের ভূমিকা পালন করে। গ্লুটামেটের পরিমাণ বেড়ে গেলে নার্ভগুলি অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচলিত ভাষায় একে আমরা বলি এক্সিটোটোসিক। মোটর নিউরোন ডিজিজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে ব্যাপক গবেষণা চলছে এবং কিছু কিছু আশার কথাও শোনা যাচ্ছে। বাথ ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুলের একদল গবেষক জানিয়েছেন, তাঁদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য এই রোগের ক্রম অবনতিকে রুখে দিতে অনেকটা কার্যকর হবে। তাঁরা বলছেন, যেসব জিন নতুন রক্তনালি তৈরিতে প্রেরণা জোগায় তারাই আবার কিছু কিছু মোটর নিউরোন ডিজিজের বাড়বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এইসব জিন বদলে যাওয়া বা মিউটেশনের ফলে অ্যানজিওজেনিন নামে এক  ধরনের বিষাক্ত প্রোটিন উৎপন্ন করে যা কিনা মোটর স্নায়ুর স্বাভাবিক কাজ কারবারকে বাধা দেয়।  তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদন ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত হিউম্যান মলকুলার  জেনেটিকসে বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে।
অ্যানজিওজেনিনের ব্যাপার স্যাপার জেনে যাওয়ার ফলে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন মোটর নিউরোন ডিজিজের বারবারন্ত আটকে দেবার। গবেষক দলের অন্যতম সেনাপতি ডাক্তার বসন্তা সুভ্রমণিয়ান বলেন- "আমরা জিনের পাল্টে যাওয়া অণুগুলি চিহ্নিত করে ফেলেছি। আমাদের চেষ্টা চলছে এই অণুর সংখ্যা বৃদ্ধিকে আটকে দেওয়ার ব্যাপারে। আমাদের গবেষণা সফল হলে মোটর নিউরোন ডিজিজে আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ না হলেও তাদের অবস্থার অবনতি হবে না।"
এই ব্যাধিকে আটকে দেওয়ার ব্যাপারে গবেষণায় কিছু আশার কথা শুনিয়েছে নেদারল্যান্ডের এর ইউনিভারসিটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষকরা। তারা ১৩২ জন রোগীর খাদ্য , বাসস্থান ও জীবনযাত্রার পদ্ধতি রোগের বারবৃদ্ধি, বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন। ডাচ গবেষকদের মতে পলি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ই প্রতিহত করতে পারে দুরারোগ্য এই ব্যাধিকে। বিশেষত সামুদ্রিক মাছে, শাকে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অঙ্কুরিত গম,  যব, বার্লিতে থাকা ওমেগা ৬ নামের ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি এই ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর।

ডাচ গবেষকরা আর জানিয়েছেন রোগীর প্রতিদিনকার খাদ্যে এই দুই ফ্যাটি অ্যাসিড যথেষ্ট পরিমাণে থাকলে রোগের বৃদ্ধি যথেষ্ট কমে যায়। তাদের গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অফ নিউরোলোজি নিউরোসার্জারি অ্যান্ড সাইকিয়াট্রি -তে। প্রতিদিনের খাবারে ২৫ থেকে ৩২ গ্রাম পর্যন্ত পলি আন স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকা দরকার এবং ভিটামিন ই থাকা দরকার ১৮ থেকে ২০ মিলিগ্রাম। গবেষক দলের অপর সদস্য ডাক্তার জন ভেলডিঙ্ক জানিয়েছেন- "প্রতিদিন ৩২ গ্রাম করে পলি আন স্যাচুরেটেড ও ২২ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই খাওয়া যায় তবে এই রোগ বিশেষ ছড়াতে পারে না।"
মোটর নিউরোন জিজিজ মানেই জীবনের শেষ হয়ে যায়- একথা সবাই মানতে রাজি নন। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সহস্র প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড় টানেন। অসুখ তাঁদের সুখের ঘরে ভাগ বসাতে পারে না। এমনই একজন হলেন বিশ্ব বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। ২১ বছর বয়সে  তিনি এই ব্যাধিতে  আক্রান্ত হন। বর্তমানে  ওঁর  বয়স ৬৫ বছর। পুরোপুরি  চলৎশক্তিহীন , বাকরুদ্ধ । শুধুমাত্র বাঁ হাতের দুটি আঙ্গুল নাড়াতে পারেন। নিজের হুইল চেয়ারে লাগানো কম্পিউটারের কী বোর্ড টিপে বাক্য তৈরি করেন। সেই বাক্য স্পিস সিন্থেসাইজারে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত হয়। শারীরিক অসুবিধাকে উপেক্ষা করে তিনি এখনও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের পদ। তাঁর লেখা দ্য ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম জনপ্রিয় বিজ্ঞান বই হিসাবে সর্বকালের বিক্রির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।     
এ রোগের রোগীদের তালিকায় আছেন ইংল্যান্ডের ক্যাথি বুরগেস। ক্যাথি নার্স ছিলেন। রোগ সনাক্ত হওয়ার পরেও তিনি নিয়মিত হাসপাতালে যেতেন। রোগীদের সাহায্য করতেন। নিজের রোগ লক্ষণ সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য লিপিবদ্ধ করে গবেষকদের দিতেন। তাদের সহায়তার কাজে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশ মোটর নিউরোন ডিজিজ অ্যাসোসিয়েশনের জন্য বক্তৃতা দিয়েছেন। বহু পাউন্ড তুলেছেন দ্বারে দ্বারে হুইল চেয়ারে ঘুরে। ২০০৩ সালের জুন মাসে ক্যাথির জানালার পাশে বহু গোলাপ ফুটেছে। তার পাশে থাকা গবেষকের হাত ছুঁয়ে ছিলেন ক্যাথি। যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে মুখের কোণে হাসি ফোটালো। আরোষ্ঠ জিভ নাড়িয়ে জড়ানো ভাষায় বললেন- "স্যার,  উই স্যাল ওভার কাম, উই স্যাল ওভার কাম সাম ডে . . . . "। তাকে সমাধিত করে তাঁর শেষ যাত্রার সঙ্গী হওয়া চিকিৎসকেরা হাতে হাত ধরে সেদিন গেয়েছিলেন সেই গান- "উই স্যাল ওভার কাম,  উই স্যাল ওভার কাম সাম ডে. . . . . . ।"
            হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক গবেষণাগারে রাত জাগা চোখ নিয়ে; এক গাল হাসবেন কোনো বিজ্ঞানী। তার আগে পর্যন্ত এ লড়াইয়ের বিরাম নেই। আসলে রোগ বিসুখের সাথে বিজ্ঞানের লড়াইটা এমনই চিরন্তন। বিরামহীন এপিসোড। না; এখানে কোনো ব্রেক নেই। নেই কোনো বিজ্ঞাপন বিরতি . . .।

Join our mailing list Never miss an update