বানারহাটে গড়ে তোলা হোক পর্যটন কেন্দ্র; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; বৃহস্পতিবার ৪ কার্তিক ১৪০৫; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বর্ষা রাতের শেষে চা বাগিচার সবুজ গালিচায় আছড়ে পড়া সোনা রোদের আভা, অদূরেই মাথা তোলা হিমালয়, যৌবনমদে মত্ত পাগলা ঝোরা, অলস পায়ে হেঁটে চলা বুনো হাতির দল- এ সবই ডুয়ার্সের পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ।
হ্যাঁ, এ সবের বাইরেও বানারহাটে রয়েছে আরও বহু আকর্ষণ। যা শুধু ভ্রমণবিলাসীদের নয়, ছাপোষারও মন কেড়ে নেবে। শিলিগুড়ি জংশন থেকে আসা মিটারগেজ ট্রেনে চা বাগিচার কোলে ছোট্ট সুন্দর বানারহাট রেল স্টেশন।
বানারহাট থেকে নয় কিলোমিটার দূরে সীমান্ত গ্রাম চামুর্চি। চামুর্চি থেকে হাঁটাপথে পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় মহাকাল মন্দিরে। পাহাড়ে ট্রেকিং করা যাদের নেশা, এ পথ তো তাদের কাছে স্বর্গরাজ্য। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে পাহাড়ের গুহার ভেতর নেমে এসেছে পাথরের তৈরি লম্বা লম্বা শিবের জটা। এগুলি আবার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জটা থেকে অবিরাম টুপটাপ ঝড়ে পড়ছে জলবিন্দু। এই জলে রয়েছে কিছু দুরারোগ্য চর্মরোগ আরোগ্য ক্ষমতা। ভূবিজ্ঞানীদের পরিভাষায় এ গুহাকে বলে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট কেভ। চুনাপাথর বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সঙ্গে পাহাড়ি আম্লিক জলের রাসায়নিক ভাঙাগড়ার খেলা চলে এই আঁধারঘেরা গুহায়। মহাকাল পাহাড়ের পাশেই চলেছে ডলোমাইট সংগ্রহের খাদ খনন, এর নিচেই দেখতে পাবেন ছোট সিমেন্ট ও সার কারখানা।
চামুর্চীর অদূরেই রয়েছে ভুটানের জেলা শহর সামসী। রাজকীয় সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকলেই এক সব পেয়েছি-র দেশ। আকাশ পানে হাত বাড়ানো বৌদ্ধ প্যাগোডার চূড়া, নাম জানা-না জানা জংলি ফুলের ঝাড় ভিনসেন্ট ভ্যান গগের ‘দ্য আইরিসেস’কেও হার মানায়। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুন্দর মিউজিয়ামে পাথরের বুকে এঁকে যাওয়া কালের ছাপ আপনাকে মুগ্ধ করবে। বানারহাটকে গোল্লাছুটের খুঁটি করে ঘুরতে পারেন ডায়না ও রেতি ফরেস্ট এলাকায়। ডায়না নদীর তীর ধরে উত্তরে হেঁটে যাওয়া আর দূরে তাকিয়ে দেখা- ‘যেথা আকাশ মাটিতে কানাকানি।’ প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র যোগাড় করে বিন্নাগুড়ি সেনানিবাসও ঘুরে আসতে পারেন। তেলিপাড়া চা কারখানার কাছেই ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা প্রস্রবণ তৈরি করেছে আংরাভাসা নদী। তেলিপাড়া ড্রাগ ফার্মে এখন বিদেশি সহায়তায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে চলছে কারনেশন ফুল ও মাশরুম চাষ। বন বিভাগের তৈরি বানারহাট শিল্প উদ্যান ছোটোর মধ্যে সুন্দর। শীতের দুপুরে কমলার স্বাদ ও ঘ্রাণ আপনার বলাকা মনকে নিয়ে যাবে দূর অজানার স্বর্গীয় কল্পলোকে।
বানারহাটে পাওয়া যাবে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, মহলি, বরাইক প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক মিশ্র সংস্কৃতি। এদের ঐতিহ্য ও সুকুমারত্ব সকলের মন কেড়ে নেবে। সারল্য, নীতিবোধ, অল্পে সুখী হওয়ার মানসিকতা, নির্লোভ উদারতা সব মানুষকে বিশ্বাস করার স্বাভাবিক প্রবণতা, মনে হবে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ সুকুমার করার চর্চা সংগঠিত হয়েছে এদের মন-হৃদয়-অনুভবে।
পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে গড়ে তুলতে হবে ট্যুরিস্ট লজ, ডরমিটারি। সেই সঙ্গে কন্ডাক্টেড ট্যুর, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, চামুর্চি থেকে মহাকাল পর্যন্ত গাড়ি চলাচলের রাস্তা, ডায়না এবং রেতি ফরেস্ট বনবাংলো। এ কাজে উদ্যোগী হতে হবে স্থানীয় পঞ্চায়েত, ব্যবসায়ী সমিতি, প্রশাসন ও বিভাগীয় মন্ত্রী মহোদয়কে। তা হলেই হবে স্থানীয় বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও ভ্রমণ বিলাসীর মনোরঞ্জন।