আলোর পথযাত্রী স্বপ্নের ফেরিওয়ালা; ২৯ জুন ২০০৩; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
ওদলাবাড়ি, ২৮ জুন: তিনি গায়ক বা অভিনেতা নন, নন রাজনৈতিক নেতা বা ধান্দাবাজির তল্পিবাহক। সোজাসাপটাভাবে বললে তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। নিজে দু’চোখ ভরে স্বপ্ন দেখেন। নিকট পরিজনদের স্বপ্ন দেখান কুসংস্কার মুক্ত পরিবেশ সচেতন এক দেশ গড়ার।
ডাঃ পার্থপ্রতিম নামেই তিনি নিজের পরিচয় দেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটাই তাঁর প্রথম জেহাদ। পেশায় চিকিৎসক এই মানুষটির সঙ্গে তার সাম্প্রতিক ওদলাবাড়ি সফরকালে কথা হচ্ছিল। দীর্ঘক্ষণের সেই একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর সম্বন্ধে জানা গেল বহু অজানা তথ্য। তিনি ডাঃ পার্থপ্রতিম-ফুলবাগানের একজন অভিজ্ঞ মালি, ছবি আঁকা, ছবি তোলা ছাড়াও মাঝে মাঝে দূরবীনে চোখ রেখে রাতভর দেখেন অরুন্ধতী-স্বাতী-সপ্তর্ষীর খেলা। দাদরা, কাহারবা, চৌতাল-ঝম্পকে ভালই তাল মেলাতে পারেন তবলা, খোলে। আবার কখনও বা আপন মনে কম্পিউটারের সামনে বসে তৈরি করেন সুন্দর সব স্লাইড।
তাঁর সবকিছুকে নেশা বললে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁর কাজের উৎস। ডাঃ পার্থপ্রতিমের লেখা স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্র-পত্রিকায়। তাঁর লেখা হৃদরোগ সংক্রান্ত বই ‘হৃদয়ের কথা” বহু মানুষের মন জয় করেছে। এক সময় সম্পাদনা করেছেন ‘পাসপোর্ট’ পত্রিকায়।
কৈশোর থেকেই বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বহুবার অংশ নিয়েছেন পূর্ব ভারত ও সর্বভারতীয় বিজ্ঞান শিবিরে । প্রশংসিত হয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির কাছে। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের আর্থিক সহায়তায় ‘দ্য ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশান অব সায়েন্স’-এ বিজ্ঞান সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম চর্চার ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে পরপর দু’বছর ডাঃ পার্থপ্রতিম ছিলেন সর্বভারতীয় বিজ্ঞান ক্লাব সন্মেলনের মুখ্য আহ্বায়ক। ১৯৯১ সালে নাগপুরে আয়োজিত ‘ইকোলজি অ্যান্ড স্পিরিচুয়ালিটি’ জাতীয় বিতর্ক সভায় পূর্ব ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নেন। এছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে পঃ বঃ সরকারের হয়ে প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে অসামান্য অবদানের জন্য এই মানুষটি ইতিমধ্যেই ঝুলিতে পুরেছেন এন সি ই আর টি-র মেধা পুরস্কার, জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পুরস্কার। পঃ বঙ্গ সরকারের যুব কল্যাণ দপ্তরের ‘ক্রিয়েটিভ অ্যাওয়ার্ড’, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বিজ্ঞান পুরস্কার। ভারত সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রক তাঁকে ব্যক্তিগত বেতার যোগাযোগ কেন্দ্র ব্যবহারের বৈধ স্বীকৃতি দিয়েছে। বহুবার অংশগ্রহণ করেছেন আকাশবাণীর বিজ্ঞান অনুষ্ঠানে, কখনো প্রযুক্তির ইতিকথা, কখনো বা পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য নিয়ে কথিকা আলোচনায় ইথারে ভেসেছে তাঁর কণ্ঠস্বর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাটিয়ে এখন মাটির টানে পাকাপাকি ঘর বেঁধেছেন স্বভূমি বানারহাটে। বর্তমানে বিজ্ঞান চেতনা প্রসারে ডাঃ পার্থপ্রতিম বেছে নিয়েছেন ‘আকাশ’কে। চল্লিশে পা দেওয়া এই চিরসবুজ মানুষটি চিকিৎসক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে ছুটে যান গ্রামগঞ্জে, স্কুল-ক্লাবে। কালার ট্রান্সপেরেন্সি প্রোজেক্টারের সাহায্যে চার দেওয়ালের মাঝেই তৈরি করেন ‘আকাশ ভরা, সূর্য-তারা’। কখনো ভয়েজার-২ মহাকাশযানে আপনাকে নিয়ে যাবেন শনি’র বলয়ের একদম কাছে, কখনো নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনে, আবার কখনো মহাশূন্যে দাঁড়িয়ে দেখবেন মমতাময়ী মাটির পৃথিবীকে, আরো বহু কিছু....। সঙ্গে থাকে আকাশ বিষয়ক আবহসঙ্গীত এবং ডাঃ পার্থপ্রতিমের সুললিত ভাষ্য।
ডাঃ পার্থপ্রতিমের ভাষায়- ‘আকাশের বিশালতা ধ্বংস করতে পারে আমাদের মনের সব দীনতা, মলিনতা, লোভ-লালসাকে।’ তাই আকাশকে হাতিয়ার করে তিনি খুন করতে চান সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাকে। সকলকে শোনাতে চান বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি তিনি বিনা পারিশ্রমিকে করেন। তাঁর কথায় ‘দূর আকাশের গ্রহ নক্ষত্র নয়, মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় তার আর্থ সামাজিক অবস্থান ও কর্মের দ্বারা।’ যে দেশের জননেতারা পাঁজি-নক্ষত্র দেখে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন, জন্ডিস-মহামারীতে হাসপাতালে নয়, ভিড় বাড়ে মায়ের থানে। সেখান এই ধরনের কাজের ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে উজ্জ্বল চোখ দুটিতে শপথের ঝিলিক খেলে গেল, চিবুকে সংকল্পের কাঠিন্য এনে বললেন -‘ইভেন ইফ টুমরো ইজ দ্য লাস্ট ডে অব দ্য ওয়ার্ল্ড, টুডে উই উইল প্ল্যান্ট এ ট্রি’। যে কথা তবেই মানায়।