সেই সোনালী দিন, আর রূপালি রাত; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৭৩ তম সার্ব্বজনীন দুর্গাপূজা, ২০০৮; বিপ্লব পাল সম্পাদিত; কাশফুল পত্রিকায় প্রকাশিত
এ এক মহাপার্বণ। মহামিলনের ক্ষণ। নিত্যদিনের নিক্তি বাঁধা লাভ লোকসানের হিসাব ভেঙ্গে অকারণে বিলিয়ে দেওয়ার দিন। পাঁচ কেজি আলু কেনার পর যে দোকানি একটা আলু ফাউ দেয় না, সেও যেন দেদার উদার। আমাদের বিপ্লব টু পাইস-ফাদার মাদার, নবমী নিশিতে নিজে থেকেই ফিল্টার উইলসের প্যাকেট খুলে এগিয়ে দেয়।
ছোট্ট বেলার নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা না ভাসার আগেই মনের মাঝে রঙিন রঙিন মেঘবালিকা ভিড় জমাতো। ইন্দুবাবুর গ্যারেজে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির বিষ্ণু পাল। গরুর গাড়ি চেপে আসত বাঁশ আর গাদা গাদা খড়। সুতলিতে বাঁধা খড় বাঁশ। সুতলিতে বাঁধা খড় বাঁশ হয়ে উঠতো বিগ্রহের অবয়ব। তারপর পড়তো মাটির প্রলেপ। সকালে মাখনবাবুর স্কুল ছুটির পর সবার ডেস্টিনেশন ইন্দুবাবুর গ্যারেজ, তখনও ঠিকমত আদল আসেনি। কল্পনার রঙিন সাজে সাজিয়ে দিতাম মাটির প্রতিমাগুলিকে।
চা বাগান থেকে আনা হতো ত্রিপল, আংরাভাষা থেকে বাঁশ। নান্টুকাকু, জ্যোর্তিময় দা, নিতাইদা এবং আর সকলে হাত লাগিয়ে প্যান্ডেল তৈরী করা হত। ডেকরেটর কালচার তখনো শুরু হয়নি। প্রতিমা আসার আগেই মঞ্চের উপর চলতো নাটকের মহড়া। অমল স্যার, সুভাষ স্যার ও মন্ডল মাস্টারের যে কী ব্যস্ততা! বিসর্জনের পরদিন থেকেই তো শুরু নাটকের পালা। অসিতদা কোন দিনই পার্ট মুখস্থ করতে পারতো না। অমল স্যার নাটকের চরিত্রের সঙ্গে নিজের অজান্তেই একাত্ম হয়ে যেতেন দু’চোখে তার শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ গড়ার স্বপ্ন। এদেশী ‘মহেশ’ থেকে ওদেশী ‘লিচিং’ প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ তার কণ্ঠস্থ।
সে সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা। মহালয়ার দিন সকালে পিতৃতর্পন করতেন পাড়ার ডাক্তারকাকু। সবাই তাকে জি এম ও বলে চিনতেন। নাম এস. এন.রায়। আগে চা বাগানের গ্রুপ মেডিকেল অফিসার ছিলেন। সে আমলেই কেমেষ্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করে পরে; আবার এম বি বি এস হন। বিজ্ঞান থেকে ইংরাজি, সংস্কৃত সব শেখাতেই তার অবাধ বিচরণ। তার মুখেই শুনেছি উপনিষদের সেই কথাগুলি।
‘আনন্দরূপমমৃতং যদবিভাতি....’ উৎসব মানেই আনন্দমেলা। উৎসবের দিনে অমৃতরূপে তিনিই প্রকাশ পান, যে সত্য নিত্য আমাদের অন্তরে বিরাজমান। আনন্দ একলা হয় না, সক্কলকে লাগে।
আনন্দান্ধ্যের খম্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে,
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি,
আনন্দং প্রয়ন্ত্যাভি সংবিশন্তি।.....
ডাঃ এস. এন.রায় ভোটপত্রে গাই বাছুর, না জোড়া বলদে ছাপ দিতেন, তা আমার জানা নেই। তবে নির্লোভ, বিলাসিতাহীন জীবনযাত্রা ও যুক্তিবাদী জীবন দর্শনে তাকে ঘোর কমিউনিস্ট বলেই মনে হত। এখন যখন লিউ চি-র ‘হাই টু বি এ গুড কমিউনিস্ট’ বইটি পড়ি তখন ডাঃ রায়, অমল স্যারের মুখ দুটি বারবার চেখের সামনে ভেসে ওঠে। সময় তটিনী তাদের প্রতি সহৃদয় হয়েছে। ধান্দাবাজির মার্কসবাদীরাজ এদের দেখতে হয়নি। আগেই তাঁরা প্রয়াত হয়েছেন।
‘‘হাম দো হামারা দো” এই নিউক্লিয়াস পরিবার তখন ছিল না। জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো নিয়ে বিরাট এক্কান্নবর্তী পরিবারের যুগ সেটা। আশি ছুঁইছুঁই ঠামমা ছিল পরিবারের মাথা। মহালয়ার আগে বাচ্চুকাকুর কোঅপারেটিভ থেকে লংক্লথের থান কেনা হতো। সবার একই রঙের শার্টপ্যান্ট বানিয়ে দিতো ধীরা কাকু। পাড়ার দাদারা সে সময় মজা করে বলতো বোস কোম্পানির জার্সি। তবে সেটা পরে যে আনন্দ পেতাম, তা আজ জে হ্যামস্টার ফেব্রিকে পাই না। দিদিরা পূজায় পেত একই দামের শাড়ি। তবে রঙ বাছায়ের স্বাধীনতা তাদের ছিল।
পূজোর অন্যতম আকর্ষণ ছিল পূজোর গান। এ উপলক্ষ্যে বাংলা গানের নতুন রেকর্ড বের হতো। বাড়িতে একটা মারফি রেডিও ছিল। সেটা ছিল ভালভ্ সেট। ভেতরে তার বিভিন্ন আলো জ্বলতো, তখন ট্রানজিস্টার বাজারে আসেনি। ঘরের বাইরে ছিল বিরাট এরিয়াল। চলতো বড় প্যাক ব্যাটারিতে। বাবা, কাকু ছাড়া একমাত্র বড়দির পারমিশন ছিল সে রেডিও চালানো ও বন্ধ করার। বড়দি তখন হায়ার সেকেন্ডারিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। আমরা সবাই বড়দির কাছে আবদার করতাম। ছোট্ট বাক্সটি ঘিরে বসতাম সকলে। কড় কড় শব্দের মধ্যে দিয়ে গান ভেসে আসত ইথার মাধ্যমে। দাদা দিদির সে কী আনন্দ। কৃষ্ণচন্দ্রের ‘..ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে...।’ কুন্দললাল সাইগলের ‘আমারে ভুলিয়া যেও মনে রেখো মোর গান / যেদিন রব না আমি দিন হলে অবসান..’। গানগুলি শুনতে শুনতে গোবনকাকু বুদ হয়ে যেতেন। সে সময় হাঁচি-কাশি বা কথা বললে মাথায় গাট্টা অবধারিত।
আগে পূজোর প্রস্তুতি চলতো বহু আগে থেকেই। অসম থেকে মনুকাকা, কলকাতা থেকে কালাদা এ সময় বাড়ি আসতো। সে দিনগুলিতে সকাল, বিকাল, রাতে কি খাওয়া হবে, তা নিয়ে বিরাট আলোচনা হোত। সেজকার জন্য মা পাঁচফোড়ন দেওয়া কলাইবড়ি ভালোভাবে শুকিয়ে রাখতো। অষ্টমীর সকালে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল হবে, না ঘুঘনি হবে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতো। ভাদ্রের রোদে তেতে উঠতো পুরানো কাসুন্দির হাঁড়িটি। পরিবারের সকলের মুখে মুখে শারদ উৎসবের পরিকল্পনা।
পূজোর ক'দিন আগে ডাকঘর বন্ধ থাকে। তাই আগেই কিনে আনা হতো গাদাগাদা পোস্টকার্ড, খাম, চাঁদনির ওপর ভার ছিল সুন্দর অক্ষরে তাতে ঠিকানা লেখার। ঠাকুর বিসর্জনের পর চলতো চিঠিতে প্রণাম জানানোর পালা। পড়শির বাড়ি ঘুরে ঘুরে গুরুজনদের প্রণাম করতাম। আজ বলতে আর বাধা নেই সেটার মধ্যে যতটা না শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল পেট পূজার আকর্ষণ। আজ কেমন যেন সব বদলে গেছে। সব মায়েদের মুখে একই অসুবিধার কথা ‘ডাক্তারবাবু, লিটন না কিছুই খায় না।’ চিঠি চাপাটির দিন গিয়েছে, কোলাকুলিতে তেমনভাবে আন্তরিকতার ছোঁয়া পাই না। এখন তো এস এম এস-এ প্রণাম অঞ্জলি হয়ে যাচ্ছে। বিজয়ার কোলাকুলি এখন প্রায় লুপ্ত প্রায় পদ্ধতি। কয়েক শতক বাদে নবীন প্রজন্মকে এগুলি বোঝানোই মুশকিল হয়ে যাবে। আসলে আমরা তো আর সেনবাবু আর দত্তগিন্নি নই। এখন মিস্টার সিয়ান, মিসেস ডট।
আগে সবাই মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখতাম। কে কটা ঠাকুর দেখলো তার প্রতিযোগিতা চলতো। এখন দেবীমূর্তি নয়, দেখতে যাই প্যান্ডেল, উদ্যেক্তারও বুঝে গেছেন। ছোট্ট মাটির মূর্তিকে কোনমতে নমঃ নমঃ করে, সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বসিয়ে রাখেন মোম-দেশলাই, কুমড়োর বিচির...মডেল। সেই বিগ্রহই এখন প্রণাম-নমস্কার পায় কথায় বলে ‘আসলের সুদের দাম বেশি।’ আর প্যান্ডেল সেও তো থিমের গ্রাসে। মাটির ভাঁড়, কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, কনডোম হরেক উপকরণ তার। আলোকসজ্জা স্তম্ভিত করার মতো কারগিল যুদ্ধ, ধনঞ্জয়ের ফাঁসি, ওয়ার্ল্ড কাপ পুরানো হয়ে গেছে। এবার লেটেস্ট সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। প্যান্ডেলের সামনে যদি ভালো পোশাকের ভদ্রলোকদের হাতাহাতি করতে দেখেন তবে উত্তেজিত হবেন না। হতে পারে উদ্যোক্তারা সংসদ অধিবেশনকে এবারের থিম করেছেন।
কাজের চাপে বা অতিথি আপ্যায়ন করতে করতে সব মন্ডপে যদি যেতে না পারেন ক্ষতি নেই। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল পূজো পরিক্রমা নিয়ে আপনার ড্রয়িংরুমে হাজির। বৈদ্যুতিন বাক্সটি শহরের নামিদামি পূজো প্যান্ডেল আপনাকে দেখিয়ে ছাড়বে। এর বাইরেও রয়েছে লোকাল নেটওয়ার্ক। স্থানীয় পূজো কভার করার দায়িত্ব এরা এখন কাঁধে তুলে নিয়েছে। ইনফরমেশন টেকনোলজির অগ্রগতি কেড়ে নিয়েছে মন্ডপে মন্ডপে ঘোরার আনন্দটাও। দুর্গাপূজা এখন বাঙ্গালির সম্বৎসরের বৃহৎ শিল্প বাণিজ্য প্রোজেক্ট। পাড়ার ক্লাব তাই দারুণ ব্যস্ত। সত্যিই এটা এখন বাণিজ্যভূমি। নামি পূজার গেট এবার কারা করবে ম্যাকডোয়েল রাম, পেপসিকোলা? চলছে তার টানাপোড়েন। সুযোগ বুঝে স্পন্সরারদের কাছে দর হাঁকছে পূজা কমিটি।
পূজোর আগেই মহালয়া এনে দিত এক অন্য সুবাস। রেডিওটা ঝেড়ে মুছে রোদ্দুরে দিয়ে ফিটফাট করে রাখা হত। লাগানো হতো নতুন ব্যাটারি। কালাদা বড় টেবিল ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে রাখতো। শিউলি ফোঁটা ভোরে প্রাণে অনুরণন তুলতো সেই অমোঘ মন্ত্র- ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা নমঃ...’ ব্রহ্মান্ডের সবকিছুর মধ্যে যে বিরাজমান তাকেই নমস্কার। আইনস্টাইন সাহেবের থিয়োরি আর রিলেটিভিটি আবিষ্কারের প্রায় চার হাজার বছর আগেই সেই একই ভাবনার প্রতিফলন। ভাবলে অবাক হতে হয়। আজ এসব মিস করলে কোনো ক্ষতি নেই। বিভিন্ন স্যাটালাইট চ্যালেন জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা দিয়ে দুর্গতিনাশিনী এপিসোড তৈরি করছে। ক্যাসেট-সিডি কোম্পানির দৌলতে নামমাত্র পয়সার বিনিময়ে সারা বছর যখন খুশি শুনতে পারেন মহিষাসুর মর্দিনী।
পূজোর সময় চা বাগিচাগুলিতে চলে আদিবাসী নাচ। গানের পালা। ওরা বলে যাত্রা। মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়ে যেত মহড়া। মাদল, ধুমসা, সানাইয়ের ঐকতান বুকের ভেতরে অজানা উন্মাদনার বোল তুলতো-ঝুমুর গিজা গিজগা নিতা, রঙিন কাগজের ঝালর দিয়ে সাজানো হত মঞ্চ। যাত্রা উপলক্ষ্যে মেলা বসে। হরেক রকম খেলনা, মিষ্টি। সঙ্গে বসে জাহাজ-চিড়িয়া-ঝান্ডির জুয়া বোর্ড। স্থানীয় ভাষায় বলে ‘ঢিস’। গোল চামড়ার ব্যাগে হাতের ঝাঁকুনিতে ঘুরতে থাকে ঘুটি। ভাগ্য যাচাইয়ের আজব চক্র। জুয়া মদের আসর আজও রমরমিয়ে চলে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে লোক সংস্কৃতিগুলি। ভিডিওর দৌলতে আদিম ছন্দকে গ্রাস করছে শাহরুখ-ঋতিকের ব্রেক-ব্রেকলেস ডান্স। এখন ঐতিহ্যের নাচ নাচতে আদিবাসী ছেলে-ছোকরাদের প্রেস্টিজে লাগে। মনে পড়ে, রূপালি জ্যোৎস্নামাখা নবমী নিশিতে রাতভোর নেচেছিলাম স্বর্গছেড়ার সেঁজুতির সঙ্গে। বদলে গেছে অনেক কিছুই। পূজো ঘিরে সেই সোনালি দিন আর রূপালি রাত অনেক দূরে। সত্যই কী এই শারদ উৎসব আগের চেয়ে বর্ণহীন, উত্তাপহীন হয়ে পড়েছে? না কী সবকিছু ঠিকঠাক বেশ চলছে? হয়তো বা সেদিনের সেই কিশোরের আজ আর কৈশোর নেই। সময়ের রেলগাড়ি তাকে নিয়ে চলছে বার্ধক্যের অভিমুখে।