হাতের কাছেই হোমিওপ্যাথি- আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি

হাতের কাছেই হোমিওপ্যাথি- আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি

হাতের কাছেই হোমিওপ্যাথি আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১২ ডিসেম্বর ২০০৯; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
মুখ থেকে শুরু হওয়া আমাদের পৌষ্টিকনালি বৃহৎ অন্ত্র হয়ে শেষ হয় পায়ুদ্বারে। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির বৃহৎ অন্ত্র বা লার্জ ইন্টেসটাইন ১.৫ থেকে ১.৮ মিটার লম্বা। খাদ্যবস্তুর শেষ অবশেষ এখানে ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা থাকে। বৃহৎ অন্ত্রের শেষ অংশটি হল রেক্টাম তথা পায়ু। রেক্টামের দেয়ালে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি বা মিউকাস মেমব্রেন থাকে। এই মেমব্রেন থেকে শ্লেষ্মা তথা আম নির্গত হয়। বৃহৎ অন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেনে জীবাণুর আক্রমণ হলে আমাশা বা ডিসেন্ট্রি দেখা দেয়। আমাদের দেশে মোটামুটি তিন ধরনের আমাশা দেখা যায়-
১)ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি :- এটা সিজিলা ব্যাসিলাস নামের এক জীবাণুর আক্রমণে হয়ে থাকে। দিনে রাতে প্রায় ৩০-৪০ বার পায়খানা হয়। মলের সাথে আম ও রক্ত থাকে। সঙ্গে থাকে জ্বর, নাভির কাছে প্রচন্ড ব্যাথা, কখনো কখনো বমি করে। এই ধরণের আমাশা খুব মারাত্মক আকার নেয়। মল পরীক্ষা করলে সিগা ব্যাসিলাই পাওয়া যায়। এধরণের রোগীকে অনেক ক্ষেত্রেই ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ দিতে হয় বা হাসপাতালে ভরতি করতে হয়।
২) অ্যামেবিক ডিসেন্ট্রি :- এককোষী প্রাণী অ্যামিবা বৃহৎ অন্ত্রে বাসা বাঁধলে এ ধরণের আমাশা হয়ে থাকে। এ রোগের লক্ষণগুলি আগের মতোই, তবে রোগকষ্ট বা তীব্রতা অনেক কম থাকে। উপসর্গ কমে গেলেও কিছুদিন নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। তা না হলে অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি অনেক সময় পুরাতন বা ধারাবাহিক আকার নেয়।
৩) জিয়ার্ডিয়াসিস :- জিয়ার্ডিয়া ল্যাম্বলিয়া নামের এক আণুবীক্ষণিক প্রাণী এই রোগ ঘটায়। পাহাড়ি আর্দ্র পরিবেশে এ রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। মূলত পানীয় জল ও খাদ্যের মাধ্যমে এই জীবাণু অন্ত্রে ঢুকে পড়ে।
 

   রোগের প্রকারভেদ যাই হোক লক্ষণ অনুসারে সঠিক হোমিও ওষুধ দিতে পারলে আরোগ্য সম্ভব। যে ওষুধগলি সচরাচর ব্যবহৃত, সেগুলি হল-
    অ্যাকোনাইট ন্যাপ- আমাশয় আক্রমণের প্রথম অবস্থায় এই ওষুধটি খুবই কার্যকরী। বিশেষত যখন দিনের বেলায় গরম ও রাতের দিকে ঠান্ডা পড়ে, সেই সময়কার আমাশা, জ্বর, সর্দি, কাশিতে প্রথম দু-দিন অ্যাকোনাইট ন্যাপ দিলে অনেক ক্ষেত্রে আর কোনো ওষুধের দরকার পড়ে না। রোগীর মধ্যে অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, তৃষ্ণা থাকলে প্রথমেই অ্যাকোনাইট ৩ এক্স বা ৩০ শক্তি প্রয়োগ করবেন।
    অ্যালোজ- খুব কোঁথানি, মলত্যাগের সময় পেটের মধ্যে প্রচন্ড ব্যথা, রোগী যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে। ব্যথাটি মূলত নাভির চারদিকে বা তলপেটের ডানদিকে হয়। মলত্যাগের পর ব্যথা কমে আসে। বৃহৎ অন্ত্রে গড়গড় শব্দ হয়। রোগী, মনে করে তাঁর পেটের ভেতর কিছু যেন এপাশ-ওপাশ হচ্ছে। প্রস্রাবের চেষ্টা করলে রোগীর বাহ্যের বেগ আসে। অ্যালোজ-এর রোগীর কষ্ট কিছু খাওয়ার পর বেড়ে যায়। বিশেষত ভোরের দিকে পায়খানা চাপে। উপসর্গের তীব্রতা অনুসারে অ্যালোজ ৩ এক্স বা ৩০ মাত্রা তিন থেকে ছয় ঘন্টা পরপর দেওয়া যায়।
 

   আমাশয় রোগে মার্কুরিয়াস সল এক বহু ব্যবহৃত ওষুধ। মলের সঙ্গে গাঢ় বাদামি, কালো বা সবুজ রঙের শ্লেষ্মা মিশে থাকে। মলে তেমন রক্ত থাকে না। বাহ্য যাওয়ার আগে পেট ব্যথা ও কোঁথানি থাকে। পায়খানার সময় মলদ্বার জ্বালা করে। রোগীর মুখ থেকে পচা গন্ধ বের হয়। রোগীর মনে হয় তার তলপেট যেন ঠান্ডা হয়ে আছে। উপসর্গগুলি রাতের দিকে বাড়ে। শিশুদের বারবার মলত্যাগে মলদ্বার হেজে গেলে মার্ক সল প্রয়োগে বেশ উপকার পাওয়া যায়। উপরের উপসর্গের মতো, তবে বাহ্যে যদি মলের তুলনায় রক্তের ভাগ বেশি থাকে সেক্ষেত্রে মার্কুরিয়াস সল এর পরিবর্তে মার্কুরিয়াস কর ৩০ বা ২০০ শক্তি প্রয়োগ করলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। সবুজ ফেনা ফেনা মল, পেট ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যে অরুচি গা বমি বমিভাব থাকলে ইপিকাক ভালো ওষুধ। যে রোগীর জিভ পরিষ্কার ও জল পিপাসা থাকে না তাদের ক্ষেত্রে ইপিকাক বেশ কার্যকরী। টকফল, কাঁচাফল বা সিন্নি প্রসাদ খাওয়ার পর, গ্রীষ্মের শেষে পেট গোলমাল হলে প্রথমেই ইপিকাক দেওয়া যায়।
    দুর্গন্ধময় বাহ্য অসাড়ে বেরিয়ে যায়, পেট ফাঁপা, পেটের ভেতর জ্বালা, আমরক্ত মেশা জলের মতো বাহ্য হয়। পেটে বায়ু জমে, রোগীর সর্বাঙ্গ ঠান্ডা, নাড়ি দুর্বল ও অনিয়মিত এসব ক্ষেত্রে কার্বো ভেজ ৩ এক্স বা ৩০ এক-দুঘন্টা পরপর প্রয়াগে রোগীর প্রাণ বাঁচতে পারে। বিশেষত ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রিতে রোগীর কঠিন অবস্থা হলে কার্বোভেজ নিম্নশক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
    যে কোনো আমাশয়ে সুন্দর কাজ করে কুর্চি মাদার টিংচার। এটি মূলত আয়ুবের্দিক ওষুধ। তবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতেও খুব ব্যবহৃত। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলারিনা অ্যান্টিডিসেন্টেরিকা। দুপুর ও রাতে খাওয়ার পর ১০ ফোঁটা ওষুধ হাল্কা গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে নতুন ও পুরাতন সব ধরনের আমাশয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। পেট  কষে ধরা, নাভির চারদিকে অসহ্য ব্যথা, সামান্য রক্ত ও আম যুক্ত মল, মলত্যাগের সময় প্রস্রাবদ্বারে জ্বালা, পেট টিপে ধরলে ব্যথার উপশম-এই সব ল²ণে কলোসিন্থ ৩০ কয়েকমাত্রা খেলে রোগী উপকার পায়।

    পেট খুব ফোলা, খুব ঘন ঘন বাহ্য, সঙ্গে কালোরক্তের ছিট সহ আমযুক্ত মল। মলত্যাগের পর জল পিপাসা পায়, রোগীর গলা শুকিয়ে আসে। পেটে, মলদ্বারে, প্রস্রাবদ্বারে লঙ্কাবাটা লাগার মতো জ্বালা। কিছু খেলেই অসুবিধা গুলি বেড়ে যায়। বর্ষাকালের আমাশয়ে বা যাঁরা বেশি লঙ্কা খান তাঁদের পেটের রোগে ক্যাপসিকাম ৩০ শক্তি খুব ভালো কাজ করে।
    আমাশয় মূলত জীবাণুঘটিত রোগ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে এ রোগের রমরমা। কিছুটা ভৌগোলিক অবস্থান দায়ী, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগের শিকর রয়েছে আরও গভীরে। অপুষ্টি, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাব, দূষিত পানীয় জল, অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতস্যাতে পরিবেশ-এ রোগের উর্বর জমিন। এই অবস্থার পরিবর্তনে পঞ্চায়েত, প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সকলকেই আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই হবে প্রকৃত মা মাটি মানুষের জয়। আগেরবার অম্বল নিয়ে লিখেছিলাম। একটা কথা সেবারে বলা হয়নি। তা হল বমি তেতো ঢেঁকুর ওঠে, পেটজ্বালা পায়খানা পরিষ্কার না হওয়া এইসব লক্ষণে রোবিনিয়া মাদার টিনচার খেলে বেশ উপকার পাবেন। ১৫ থেকে ২০ ফোঁটা ওষুধ আধ কাপ হালকা গরম জলে মিশিয়ে রাতে শোয়ার আগে খেলে সকালে পেট পরিষ্কার হবে। সারাদিন গ্যাস অম্বলের উৎপাত কম থাকবে। অন্যদিকে খাওয়ার পর পেট ভার, পেট টিপলে রোগী ব্যথা পায়, কোষ্ঠবদ্ধতা রোগ লক্ষণে নাক্সভমিকায় উপকার পাওয়া যায়। নাক্সভমিকা রাতে শোয়ার আগে খেলেই বেশি কার্যকরী।      

Join our mailing list Never miss an update