আইসক্রিমের ইতিকথা

আইসক্রিমের ইতিকথা

আইসক্রিমের ইতিকথা; ডাঃ পার্থপ্রতিম; রবিবাসরীয় ৭ জুলাই’ ৯১; পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬; আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত
ঘটনাটি হঠাৎই ঘটে গেল। বড়দিনের মাঝরাতে নাচগান শেষ করে যে যার বাড়ি ঘিরে গেছে। ভোরের আলো ফুটতেই গির্জার প্রহরী এসে দেখতে পেল- এক অতিথির ফেলে যাওয়া একজগ মধু মেশানো দুধ, লনের ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গেছে। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। খেতে বেশ চমৎকার লাগল।
    আইসক্রিমের প্রচলন নিয়ে এমন একটি মজার গল্প অনেক আমেরিকান বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের শোনান। সে সত্যি মিথ্যে যাই হোক।

    আইসক্রিম তৈরির কলাকৌশল যে চীনেরাই প্রথম রপ্ত করেছিল তার যথেষ্ট প্রমাণপত্র আছে। ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার চীনে এসে জমানো ফসলের রস মেশানো দুধ খেয়েছিলেন। সে সময়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে ক্রীতদাসেরা কাঠের গুঁড়োর মধ্যে করে বরফ শহরে নিয়ে আসত। রোমান সেনাপতি কুইনটাস্ মাক্সিমাস যার ডাক নাম শুটান, তাঁর লেখাতেও চীনের আইসক্রিমের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১২৯৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের লোকেরা আইসক্রিম বানানোর পদ্ধতি জানতো না। পর্যটক মার্কোপোলো পিকিং-এ এক ভোজ সভায় শেষপদ হিসাবে আইসক্রিম খান। তিনি এটি তৈরির কলাকৌশল পিকিং থেকে ভেনিসে নিয়ে আসেন।
    ফ্রান্সের ডিউক ডি’ ওরালিন অর্থাৎ যিনি পরে হেনরি দ্বিতীয় বলে পরিচিত, তিনি ১৫৩৩ সালে ইতালির ক্যাথরিন ডি মিডিসকে বিয়ে করলেন। মিডিসির সঙ্গে যে সব অনুচরী-অনুচর ফ্রান্সে এসেছিল, তার মধ্যে একজন আইসক্রিম বানানোর কলাকৌশল জানত। ১৬৮৫ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম চার্লস ফ্রান্সের চতুর্থ হেনরির মেয়েকে বিয়ে করেন; তিনি যৌতুক হিসেবে একজন আইসক্রিম বিশেষজ্ঞকে লন্ডনে নিয়ে আসেন। এভাবেই আইসক্রিম ইংলিশ চ্যানেল পার হয়।
    এরপর ইংল্যান্ড থেকে এই খাবার অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথমদিকে আমেরিকায় পৌঁছে যায়। আমেরিকানরা প্রথম থেকেই এটি নিয়ে মাতামাতি শুরু করে। ১৮৪৬ সালে আমেরিকান মহিলা নানসিজন আবিষ্কার করেন হাতে ঘোরানো ফ্রিজ। এর পর ১৮৫১ সালে এক ডেয়ারি মালিক জেকব ফুসেল বাল্টিমোরে তৈরি করেন পৃথিবীর প্রথম আইসক্রিম কারখানা। প্রথম বছরেই আমেরিকাতে চারশো গ্যালন আইসক্রিম বিক্রি হয়। ঊনবিংশ শতাব্দের শেষ দিকে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় আরও পঞ্চাশ লক্ষ গ্যালন। এখন আমেরিকায় বছরে একশো কোটি গ্যালন আইসক্রিম তৈরি হয় যা বিশ্বের আর সব দেশগুলির মোট উৎপাদনের সমান। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইসের মেলায় এক ভেন্ডার চালের গুঁড়ো ও ময়দার নলের মধ্যে আইসক্রিম পুরে বিক্রি করতে থাকে। এভাবে বাজারে এল আইসক্রিম কোণ বা শঙ্কু আকৃতির আইসক্রিম।

    আমেরিকার আইয়াতে এক খাবারের দোকানে ঢুকে একটি ছেলে চিন্তায় পড়ে গেল, সে চকলেট খাবে না আইসক্রিম খাবে? দুটোই খাওয়ার মতো পয়সা তার কাছে তখন ছিল না। তার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকেই দোকানদের মাথায় এল এক নতুন পরিকল্পনা। তিনি ১৯১৯ সালে বাজারে নিয়ে এলেন চকোলেট আইসক্রিম ‘এক্সিমো-পি’। ওয়েলস্টনের হার্ভার্ড জনসন কোম্পানি তাদের ওষুধের দোকানে তিনটি ভিন্ন সুগন্ধের আইসক্রিম বিক্রি করতে শুরু করে। এদের দেখাদেখি আর এক বিক্রেতা সাত রকম সুগন্ধি আইসক্রিম ক্রেতাদের হাতে তুলে দেয়। ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বার্টন বাঙ্কিন ১৯৫০ সালে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়- ‘আমরা আপনাকে মাসের প্রতিদিনই নতুন স্বাদ ও সুগন্ধের আইসক্রিম খাওয়াব।’ এখানেই শেষ নয়, বারব্যাঙ্কের এক ল্যাবরেটরি আইসক্রিমে মেশানোর জন্য পাঁচশো রকমের ফ্লেভার তৈরি করে। তার মধ্যে এপিকট ব্র্যান্ডি থেকে তরমুজ পর্যন্ত আছে। এইসব হাজারো স্বাদ ও সুগন্ধের আইসক্রিম থাকলেও, স্ট্রবেরি, চকলেট, ভ্যানিলা, ক্যাডবেরিই পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়।   

Join our mailing list Never miss an update