করোনা - আপনাকে যা করতে হবে

করোনা - আপনাকে যা করতে হবে

করোনা - আপনাকে যা করতে হবে; -ডাঃ নীলাদ্রি বোস। পাতিপুকুর টি বি হাসপাতাল; দমদম ও ডাঃ পার্থপ্রতিম।
    এখন চতুর্থ পর্যায় লকডাউন চলছে। শুধু এ রাজ্য বা দেশে নয়। বিশ্ববাসীর আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু করোনা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বজুড়ে এমন আতঙ্কের পরিমন্ডল এর আগে এতো ব্যাপকভাবে হয়েছিল কিনা তা ইতিহাসবিদরা খুঁজে পাচ্ছেন না। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে সাড়া পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে। একদিকে যেমন চলছে করোনা প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা। এরই পাশাপাশি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতেও চলছে এ রোগ প্রতিরোধের বিভিন্ন সুলুক-সন্ধান।
    একটি কথা মনে রাখতে হবে- বর্তমানে যে লকডাউন চলছে মাসের পর মাস এ পরিস্থিতি চলতে পারে না। আমাদের দেশের যা সমাজ ব্যবস্থা তাতে রুটিরুজি ও বেঁচে থাকার তাগিদে কম বেশি সবাইকেই বাড়ির বাইরে আসতে হবে। বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে। আর এটাও নয় যে করোনার এই প্রাদুর্ভাব কোন এক সোনালী সকালে হঠাৎ করে বিশ্ব থেকে উবে যাবে। তাই আমাদের সকলকেই করোনার সাথে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকা শিখতে হবে। না, বলছি না-‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা. . . ’ তবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে আপনাকে, নিজেকে। আসুন সে পদ্ধতিগুলি ঠিক মতো জেনে নি।   

    ভারত সরকারের আয়ুষমন্ত্রক ইতিমধ্যেই ৫ টি চিকিৎসা পদ্ধতিকে এ বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত করেছেন। আয়ুবের্দিক, হোমিওপ্যাথি, ইউন্যানি, সিদ্ধা ও যোগাভ্যাস এই পদ্ধতিগুলি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সুষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারে; সে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শ্রীপদ ওয়াই নায়েক। চারটি বিশেষ আয়ুবের্দিক ওষুধের ফর্মুলেশন যাচাই করে তা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষামূলক কাজ ইতিমধ্যেই সাফল্য পেয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে বেশ কিছু নিদান দিয়েছে ভারত সরকারের আয়ুষ মন্ত্রক। করোনা যেহেতু ভাইরাস ঘটিত অসুখ তাই প্রচলিত মতে এই ব্যাধি রুখে দেওয়ার জন্য টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগই অন্যতম প্রতিরোধ পদ্ধতি বলে অ্যালোপথিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে উল্লেখিত। ভাইরাস সংক্রমণে কে অসুস্থ হবে কে অসুস্থ হবে না তা ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন হয়। চিকিৎসা পদ্ধতিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথায় যাকে আমরা বলি প্যাথোফিজিওলজি। প্রাকৃতিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম যার যত সবল, সে তত সুস্থ ভাবে এই অসুখকে প্রতিরোধ করতে পারে। মানুষের এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বহু প্রাচীন কাল থেকেই আয়ুর্বেদে বিভিন্ন ভেষজের ব্যবহার হয়ে আসছে। আয়ুর্বেদিক মতে বিভিন্ন রোগের উৎস হিসেবে পাঁচটি কারণকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলি হল বায়ুজ, পিত্তজ, কফজ, ত্রিদোষজ ও কৃমিজ। দেহের ভেতর অবস্থানকারী বাতাস সঠিকভাবে কাজ না করলে বায়ুজ রোগ দেখা দেয়। দেহের ভেতর থাকা বিভিন্ন রসনিঃসরণ গ্রন্থি, যেমন- প্যানক্রিয়াস, লিভার, গলব্লাডার পাকস্থলী বা স্টমাকে থাকা গ্যাসট্রিক গ্ল্যান্ড এরা ঠিকমতো কাজ না করলে যে অসুবিধা দেখা দেয় তাকে পিত্তজ বলে।
আমাদের শরীরের ভিতরে থাকা বিভিন্ন শ্লেষ্মা ঝিল্লি থেকে যে শ্লেষ্মা বা কফ নিঃসরণ হয় তাতে অসুবিধা দেখা দিলে তাকে কফজ বলা হয়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে বায়ু, পিত্ত ও কফ এই রোগের তিনটি কারণ একই সাথে রোগীর মধ্যে দেখা দেয়। তখন তাকে বলে ত্রিদোষজ। বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণে যে সব অসুখ হয় তাকে বলা হয় কৃমিজ।
    করোনা মূলতঃ আপার ও লোয়ার রেসপিরেটারি ট্রাক বা উচ্চ ও নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের অসুবিধা; তাই আয়ুবের্দিক মতে এটা কফজ ও কৃমিজ। অর্থাৎ কফ ও কৃমি থেকে উৎপত্তি হওয়া অসুখ।
    আয়ুষ মন্ত্রক করোনা আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলোকে আবার বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা যায়। যেমন- কিছু রয়েছে সাধারণ পদক্ষেপ। কিছু রয়েছে আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধের ওষুধ গ্রহণ। আবার কিছু আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি অবলম্বন। যেমন- সাধারণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দিনে বারবার গরমজল খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। করোনা যেহেতু আপার রেসপিরেটারি ট্রাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে অর্থাৎ নাক- মুখ এগুলো দিয়েই প্রবেশ করে সে কারণে মাঝে মাঝে উষ্ণ গরম জল চমুক দিয়ে খেলে যদি কোন ভাবে ভাইরাস ঢুকেও থাকে তা গ্রাসনালী দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়। আমাদের পাকস্থলীর মধ্যে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও বিভিন্ন উৎসেচক থাকার কারণে ভাইরাস সেখানে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না।

    দ্বিতীয় হল প্রতিদিন নিয়মিত যোগাসন, প্রাণায়াম ও ধ্যান করতে হবে। রান্নার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু মশলা যেমন- হলুদ (Turmaric), জিরা (Cumin)  , ধনিয়া (Corian), রসুন (Garlic) এগুলি বিশেষ পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও শ্বাসযন্ত্র সংক্রান্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন সকালে দশ গ্রাম বা ১ চামচ চ্যবনপ্রাশ খেতে হবে। তবে যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা সুগার ফ্রি চ্যবনপ্রাশ খাবে। চ্যবনপ্রাশ খাওয়ার পরে এককাপ গরম দুধ খাওয়া যেতে পারে। দিনে ২ বার চা না খেয়ে ভেষজ চা খান। এই ভেষজ চা বহু প্রাচীন কাল থেকেই নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি রোগে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যারা ইসকন মন্দিরের রেঁস্তোরাতে গিয়েছেন, তারা এই চায়ের সাথে পরিচিত। এটা চায়ের মতো করেই পরিবেশন করা হয়। তবে চায়ের চা পাতার পরিবর্তে এই চা তৈরীতে বিভিন্ন ভেষজ উপাদান ব্যবহৃত হয়।
    অনেক ক্ষেত্রে এই ভেষজ উপাদানগুলি সেদ্ধ করে ক্কাথ (Decoction) তৈরী করা হয়ে থাকে। ভেষজ উপাদানের মধ্যে রয়েছে তুলসী (Basil), দারুচিনি (Cinnamon), গোলমরিচ (Black Pepper), শুন্থি বা শুকনো আদা বা Dry Ginger  । এছাড়া কিশমিশ (Raisin)  এর সাথে স্বাদের জন্য আপনাদের পছন্দমত তাজা লেবুর রসও মিশিয়ে নিতে পারেন। মেশাতে পারেন তালমিছরি বা Juggery। এই হার্বাল-টি দিনে ২ বার খেলে কফ জাতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সহজ হয়। এর সাথে খেতে পারেন গোল্ডেন মিল্ক বা সোনালী দুধ। নাম শুনে চমকে যাওয়ার কিছু নেই। একগ্লাস বা ১৫০ মিলি সাধারণ গরম দুধের সাথে আধা চামচ বা ৫ গ্রাম খাঁটি হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে নিলে এই গোল্ডেনমিল্ক তৈরি হয়ে যাবে। সম্ভব হলে প্রতিদিন একবার বা দুবার এই দুধ খান।

    এর পাশাপাশি কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে করোনা বা কোভিড-১৯ আপনার থেকে দূরে থাকবে। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় নাকের ফুটোয় অল্প পুরোনো ঘি ও তিলের তেল বা Sesame, কিছু না পেলে নারকেল তেল লাগাতে পারেন। প্রতিদিন অন্তত ১ বার ১ চামচ নারকেল বা তিলের তেল মুখে নিয়ে কুলকুচি করবেন। তারপর তা থু-থু করে বাইরে ফেলে দেবেন, গিলবেন না। ২-৩ মিনিট পর গরম জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করে নিতে পারেন।
    কাশি ও গলাব্যাথা দেখা দিলে পুদিনাপাতা ও জোয়ান (Caraway)  গরম জলে দিয়ে তোয়ালে বা গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে শ্বাস নিতে পারেন। লবঙ্গের গুঁড়ো মধুর সাথে মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার খেলে গলার অসুবিধা দূর হয়। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে আমরা ধাপে ধাপে সে বিষয়ে আলোচনা করবো। আপনারা আপনাদের মতামত জানান। আসুন কোমর বেঁধে নেমে পড়ি; এ লড়াই জিততে হবেই . . .।

Join our mailing list Never miss an update