টনসিলে টনটন

টনসিলে টনটন

টনসিলে টনটন; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৫; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
টনসিল হল আমাদের মুখের ভেতরে থাকা লসিকা গ্রন্থি। মোটামুটিভাবে সব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের টনসিল থাকে। তবে টনসিল কিন্তু একজোড়া নয়, তিন জোড়া। গলার মধ্যে, নাকের ভেতর ও জিভের নীচে টনসিল থাকে। এরা আবার লসিকানালি দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। নাকের ভেতরে থাকা টনসিলকে বলে ফ্যারিনজিয়াল টনসিল। এর ডাকনাম অ্যাডিনয়েড। এই অ্যাডিনয়েড বড়ো হলে রোগীর নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাতের বেলায় মাঝে মাঝে নাক বন্ধ হয়ে আসে, তখন সে মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। পরবর্তীকালে আরও বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়।
    জিভের নীচে থাকা টনসিলের নাম লিংগুয়াল টনসিল। তবে এতে সাধারণভাবে তেমন কোনও  অসুবিধা হয় না। কারও কারও ক্ষেত্রে এটি ফুলে যায় ও ব্যথা হয়। গলার ভেতরে ফ্যারিংসের দু-পাশে থাকা টনসিলকে আমরা সাধারণভাবে টনসিল বলি। অর্থাৎ সাধারণভাবে টনসিল বলতে গলার ভেতর জিভের গোড়ায় থাকা ডিম্বাকৃতি লসিকা গ্রন্থি দুটিকেই বুঝি। এর ডাক্তারি নাম প্যালাটাইন টনসিল। সাধারণত জন্মের পর থেকে টনসিলের আকার ধীরে ধীরে বাড়তে আরম্ভ করে। ৬-৭ বছর বয়সে এটি সবচেয়ে বড়ো হয়, তারপর আস্তে আস্তে ছোটো হতে থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ ১২-১৩ বছর বয়সে এটি একদম ছোটো হয়ে যায়।

    পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে হরেকরকম রোগজীবাণু আমাদের মুখের ভেতরে আসে। স্ট্যাফাইলোকক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস, ডিপথিরিয়ার, ব্যাসিলাস আরও অনেক কিছু। তবে সবাই সবসময় মারমুখী থাকে না। কেউ চুপচাপ ছদ্মবেশে তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে। তখন দেখা দেয় নানারকম অসুবিধা। টনসিলে অসুখ এই টনসিলাইটিস। ঠান্ডা, লাগার সঙ্গে টনসিলাইটিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমরা যাকে  প্রচলিত ভাষায় ঠান্ডা লাগা বলি তা মূলত হয় তাপমাত্রার পরিবর্তন থেকে। পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া ঠান্ডা হলেই যে আপনার সর্দি-কাশি হবে তেমন কোনও কথা নেই। তাই যদি হতো তাহলে এস্কিমোদের সারা বছর সর্দি-কাশি থাকত। অন্যদিকে, সাহারার তপ্ত মরুভূমিতে থাকা বান্টু উপজাতির মানুষের কোনও কালেই কফ-কাশি হওয়ার কথা নয়। আসলে দেহের অভ্যন্তরে তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তনে মূলত ঠান্ডা লাগে। ঠান্ডা লাগলে শ্বাসযন্ত্রের ভেতরে থাকা সিলিয়াগুলি অবশ হয়ে যায়। সিলিয়া-র কাজ অনেকটা ঝাঁটার মতো। শ্বাসযন্ত্রের আবরণী কলার কোষগুলির মাথায় সরু সরু চুলের মতো সারি বেঁধে থাকে। সিলিয়াগুলি ঝাপটে ঝাপটে শ্লেষ্মা বা মিউকাসকে দেহের বাইরে বার করে দেয়। সিলিকা যখন অবশ হয়ে যায়, তখন শ্বাসযন্ত্রে মিউকাস বা কফ জমতে থাকে। এতেই ব্যাকটিরিয়া-ভাইরাসের বাড় বাড়ন্ত। তখন তাদের হটাতে রক্তের ভেতর থাকা শ্বেতকণিকাগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। টনসিল আক্রান্ত হলে গলার ভেতর টনটন ব্যথা হয়, ঢোক গিলতে কষ্ট, কথা বলা মুশকিল। এ সময় টনসিলটি;দেখতে হয় লাল টকটকে। টনসিল গ্রন্থির ভেতর যেসব খাঁজ ঢুকে গেছে তাদের খাঁড়ি বলে। বাইরের জীবাণুদের সঙ্গে ভিতরের সৈন্যের লড়াই চলে এই খাঁড়ির খাঁজে খাঁজে। এই লড়াইতে শহিদ হয় দেহের ভেতর থাকা অনেক সৈনিক। শ্ব্তেকণিকার মৃতদেহ, মৃতকোষ আর কিলবিল করা জীবাণু নিয়ে তৈরি হয় পুঁজ। অনেক সময় এইসব খাঁড়ির মুখে এত পুঁজ জমে যে তা জুড়ে গিয়ে সাদা পর্দার মতো দেখায়।

এইসব লড়াইতে কখনও কখনও শত্রু ব্যাকটিরিয়া টনসিলদুর্গ দখল করে নেয়। তারপর দুর্গের প্রাচীর ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। কান, নাক অন্যসব অঙ্গে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় আমরা বলি পেরিটনসিলাইটিস। এ থেকে বিভিন্ন অংশ ফোঁড়া বা পেরিটনসিলার অ্যাবসেস হতে পারে, যার চলতি নাম কুইনসি।
সাধারণত টনসিলাইটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যথা কমার ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন বেশ কার্যকরী। এতে জ্বর, গলাব্যথা কমে আসে। এসব ওষুধ গরমজলে মিশিয়ে গার্গল করা যায়। রোগের তীব্রতা বেশি হলে বেনজাথিন পেনিসিলিন, প্রেডনিসোলন, সালফোনামাইড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শুরু করার আগে থ্রোট সোয়াব ফর কালচার সেনসিভিটি পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া উচিত কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক আপনার গলার ভেতরে থাকা জীবাণুর উপর বেশি কার্যকরী।

হোমিওপ্যাথিকে টনসিলাইটিস মোকাবিলায় বেশ কিছু ভালো ওষুধ আছে। কিছু ক্ষেত্রে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু পাকাপাকিভাবে টনসিলে ঘাঁটি গেড়ে বসে। বারবার টনসিলে ব্যথা হয়। জীবাণু টনসিলের বেড়া টপকে বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণ চালায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ডাক্তারবাবুরা টনসিলের অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। কোনও কাপসিরাপই টনসিলের রোগ নিরাময় করতে পারে না, এসব শুধু ক্ষণিকের আরাম আর অর্থ জলাঞ্জলি।       

Join our mailing list Never miss an update