বাইপাস সার্জারি করতে হলে

বাইপাস সার্জারি করতে হলে

বাইপাস সার্জারি করতে হলে; -ডাঃ পার্থপ্রতিম;১০ জুন ২০০৬; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
আমাদের হৃদযন্ত্রের বাইপাস সার্জারি কোনো নতুন বিষয় নয়, ব্যাপারটা এখন প্রায় জলভাত। তবুও অনেকে এই সার্জারির নাম শুনলেই ভয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বাইপাস নামটি থেকেই বোঝা যায় অপারেশনের ধরন-ধারণ। যানজট এড়িয়ে দ্রুত চলাচলের জন্য অনেক শহরেরই বাইরে দিয়ে বাইপাস রাস্তা থাকে। এই সার্জারিও অনেকটা সেরকম।
    বাবা বা পরিবারের কর্তা বাড়ির সবার জন্য খাবারের জোগাড় করেন। তাঁর বেঁচে থাকার জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন। ঠিক তেমনই হৃদপিন্ড আমাদের সারা শরীরে রক্ত সংবহন করে। হৃদপেশিরও আপন পুষ্টির জন্য রক্তের দরকার। এই রক্ত হৃদযন্ত্রে সরবরাহ হয় করোনারি আর্টারি দিয়ে। বিভিন্ন কারণে এই ধমনিতে রক্ত চলাচলের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তখন শরীরের অন্য অংশ থেকে শিরা কেটে এনে বাইপাস পথ তৈরি করা হয়। এই বাইপাস পথ দিয়ে রক্ত সহজেই হৃদপেশির প্রয়োজনীয় অংশে পৌঁছে যায়। এটাই হল বাইপাস সার্জারির মূল বিষয়।

    করোনারি আর্টারিতে ছোটোখাটো বাধা থাকলে তা বেলুন অ্যানজিওপ্লাস্টি বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে সারানো হয়। তবে বাধা যদি বেশি হয় তাহলে বাইপাস করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না। বাইপাস সার্জারি করার আগে চিকিৎসকেরা রোগীর অ্যানজিওগ্রাফি করে দেখে নেন করোনারি ধমনির কোথায় কি পরিমাণ কোলেস্টেরল বা চর্বি জমেছে। তারপর ডাক্তারবাবুরা আলোচনা করে ঠিক করেন কবে কখন কী পদ্ধতিতে রোগীর বাইপাস অপারেশন করা হবে।
    এই অপারেশনের আগে কয়েকটি বিষয়ে রোগী ও তাঁর পরিজনদের নজর দেওয়া দরকার। প্রথম কথা হল, অপারেশনের কথা শুনে অনেক রোগী ভয়ে সিঁটিয়ে যান। এই ভয় অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে রোগী যদি অপারেশনের ব্যাপারটা বুঝে নেন, তাহলে মন থেকে অহেতুক ভয় কেটে যাবে। তারপর যে বিষয়টি মধ্যবিত্তের সবচেয়ে চিন্তার কারণ হয়, সেই খরচের দিকটাও ঠিকমতো হিসাব নিকেশ করে টাকা-পয়সার বন্দোবস্ত করা দরকার। সরকারি হাসপাতালে এই অপারেশন  করতে খরচ হয় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা। তবে এখন যা সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল তাতে অল্প কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে এই অপারেশনের সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া রাজনৈতিক দাদা বা মন্ত্রীর সঙ্গে দহরম-মহরম না থাকলে অপারেশনের তারিখ পাওয়াও মুশকিল। বেসরকারি নার্সিংহোমে বাইপাস সার্জারি করতে খরচ হয় ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা। কলকাতায় সল্টলেকের আনন্দলোক-এ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকার প্যাকেজ হয়। ওদের ফোন নম্বর ৯৫-৩৩-২৩৫৯ ২৯৩১। এখন অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম বিভিন্ন অপারেশন প্যাকেজ চালু করেছে। এই প্যাকেজের মধ্যে রোগীর অপারেশন, থাকাখাওয়া, ওষুধপত্র, নার্স-আয়া সব খরচই ধরা থাকে। এই প্যাকেজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অপারেশন করাও অনেক ক্ষেত্রে সাশ্রয়কারী হয়। তবে চুক্তিতে সই করার আগে ভালোভাবে দেখে নিতে হবে কোন কোন খরচ প্যাকেজে ধরা আছে, কোনগুলি নেই। আর যে সব খরচ প্যাকেজের বাইরে আছে সেগুলিরও আনুমানিক খরচ সম্বন্ধে ঠিকঠাক খোঁজখবর নেওয়া দরকার। তা না হলে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হতে পারে। রোগী যদি ব্যবসায়ী হন বা তাঁর ওপর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকে, তাহলে কমপক্ষে মাস তিনেকের পারিবারিক খরচপত্র আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রাখা ভালো।
    অপারেশনের পর সপ্তাহ খানেক হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে থাকতে হয়। স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসতে আরো দিন চল্লিশেক সময় লাগে। সে কারণেই বুঝে শুনে ছুটির ব্যবস্থা করে রাখা দরকার। এই অপারেশনের আগে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। অ্যানজিওগ্রাফির কথা তো আগেই বলেছি। তাছাড়া ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ইউরিন টেস্ট, রক্ত পরীক্ষা এইসব রয়েছে। আপনার রোগীর যদি অন্য কোনো অসুবিধা যেমন- টনসিল, দাঁত বা মাড়ির রোগ, লিভারের গন্ডগোল থাকে তাহলে ডাক্তারবাবুকে বিশদে জানাবেন। ডাক্তারবাবুরা যেন সবদিক বুঝে নিতে পারেন।

    এ ধরনের অপারেশনের সময় বিভিন্ন যোগাযোগের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো সঙ্গী পেলে ভালো। সঙ্গীটির যদি চিকিৎসা ও ওষুধ সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। আমাদের দেশে একটা বদ রেওয়াজ আছে। কেউ অসুস্থ হলে দলবেঁধে দেখতে যাওয়া। এতে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর ওপর মানসিক চাপ তৈরি হয়। রোগীও ভেবে বসেন তাঁর অপারেশনটি মারাত্মক। তাই দল বেঁধে না গিয়ে প্রিয়জনরা টেলিফোনে অল্পসল্প খোঁজখবর নিতে পারেন। এই ধরনের অপারেশন সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্কদেরই হয়। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না, আপনি দিব্যি সুস্থ হযে যাবেন, আপনি মরার চিন্তা একদম করবেন না... এ ধরনের কথাও রোগীকে বারবার না শোনানোই ভালো। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। রোগী উল্টে ঘাবড়ে যেতে পারেন। এই অপারেশনে সাধারণত দুই থেকে তিন বোতল রক্ত লাগে। ছয়-সাত বোতল রক্তের ব্যবস্থা আগেভাগেই করে রাখা ভালো। পরিচিত লোকজনদের মধ্য থেকে রক্তদাতা খুঁজে রাখা উচিত। শুধু গ্রুপ এবং আর এইচ ফ্যাক্টর মিললেই হবে না। দাতাদের রক্ত পরীক্ষা করে আগেভাগে জেনে নিতে হবে তাঁদের মধ্যে হেপাটাইটিস, ব্লাডসুগার, এইচ আই ভি-র জীবাণু নেই তো। অপারেশনের আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা জরুরি। নিয়মিত স্নান করবেন, নখ, চুল, দাড়ি ভালোভাবে কাটুন। কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখা খুবই দরকার। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো পায়খানা পরিষ্কারের জন্য পার্গেটিভ বা ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। রাতে শোওয়ার আগে নিয়মিত গার্গল করবেন। ঠিক সময়মতো উপযুক্ত জামা-কাপড় পরতে হবে। অপারেশনের আগে সর্দি-কাশি বাধিয়ে ফেললে জটিলতা বাড়তে পারে।
    বাইপাস নামেই বোঝা যায় এটি সমস্যার সমূল সমাধান নয়। অসুখের মূল সূত্রটি অর্থাৎ করোনারি ধমনির সরু হয়ে যাওয়া অংশ যেমন ছিল তেমনই থাকে। শুধু সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে বাইপাস করা হয়। এই অপারেশনের পর ৩০-৪০ ঘন্টা ইনটেনসিভ কার্ডিও কেয়ার ইউনিটে থাকা প্রয়োজন। তারপর পাঁচ-ছয় দিন হাসপাতালে থেকে রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এই অপারেশনে সাফল্যের হার ৯৮-৯৯ শতাংশ। আমাদের দেশে সাধারণভাবে প্রতি তিনশো জনে একজন রোগী অপারেশনের সময় মারা যান। বুকের ইন্টারনাল ম্যামারি ধমনি বা পায়ের শিরা কেটে এনে সূ² সেলাইয়ের সাহায্যে তৈরি করা হয় রক্ত চলাচলের বিকল্প রাস্তা। আমাদের বুকের খাঁচার দু-পাশে রয়েছে ইন্টারন্যাল ম্যামারি আর্টারি। যা প্রধানত স্তনে রক্ত সরবরাহ করে।
    অপারেশনের পর বাড়িতে যাওয়ার আগে বা বাড়ি পৌঁছোনোর পর বেশ কয়েকটি বিষয় মনে রাখা দরকার। অপারেশনে থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় আপনার সব প্রেসক্রিপশন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রির্পোট ও হাসপাতাল থেকে দেওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেট ঠিকমতো বুঝে নিয়ে ফাইলবন্দী করুন। বাড়ি ফিরে কবে স্নান করবেন, উষ্ণ জলে না শীতল জলে স্নান-সেগুলি ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে জেনে নিন। সেলাইয়ের জায়গায় সাবান লাগানো যাবে কিনা বা লাগালে সেটা কতদিন পরে লাগাবেন তা জেনে নেবেন। ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বর ও মোবাইল নাম্বার নিতে ভুলবেন না। ওষুধ খাওয়ার নিয়মগুলিও ভালো করে নিজের সুবিধা অনুসারে বাংলা বা ইংরেজিতে লিখে রাখলে ভালো হয়। এ ধরনের অপারেশনের পর টয়লেটের প্যানে বসা অনেক সময় খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে রোগীর জন্য ওয়েস্টার্ন স্টাইলের কমোডের ব্যবস্থা ভালো। রোগীর ঘর একতলায় হলে অহেতুক সিঁড়ি ভাঙতে হয় না। শল্য চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে চলাফেরা জরুরি। প্রতিদিন কতটা পথ হাঁটবেন এবং তা ধীরে ধীরে কীভাবে বাড়াতে হবে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন।             

 

Join our mailing list Never miss an update