ঘরের ভেতর মহিরুহ-পর্ব-১১; বনসাইয়ের ভঙ্গিমা -২- ডাঃ পার্থ প্রতিম
ঝুলন্ত ভঙ্গিমা - উত্তরবঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় বহু গাছকে খাড়া পাহাড়ের গা থেকে ঝালরের মতো ঝুলতে দেখা যায়। তাকে অনুকরণ করেই এই বনসাই তৈরী হয়েছে। এই স্টাইলের বনসাইকে উঁচু টেবিল বা টুলের ওপর রাখা হয়। কান্ড সহ গাছটি টবের নিচে ঝুলতে থাকে। এক্ষেত্রে টবটি হবে গভীর; গোলাকার বা ষড়ভূজাকার হতে পারে। প্রথম থেকে বাঁকানোর চেষ্টা না করে কান্ড চার পাঁচ সেন্টিমিটার খাড়া রেখে তারপর ঝুলন্ত ভঙ্গিমা দিলে গাছের ভারসাম্য বজায় থাকে। যে দিকে গাছটি ঝুলে থাকে তার বিপরীত দিকে ডাল রেখেও অনেক সময় গাছটিকে ভারসাম্য দেওয়া হয়। জাপানি ভাষায় একে বলে কেঙ্গাঁই। জুনিপার (জুনিপেরাস প্রসট্রেটা), পাইন (পাইনাসলনগিফোলিয়া), বুগেনভেলিয়া, জবা, পাতিলেবু সোইট্রাস অর্যান্টিফেলিয়া ) এইসব বিভিন্ন গাছ দিয়ে ঝুলন্ত বনসাই করা যায়।
প্রায় ঝুলন্ত ভঙ্গিমা - এটা অনেকটা ঝুলন্ত ভঙ্গিমার মতোই তবে গাছটি তত বেশি ঝুলবে না। টবের গভীরতা হবে ১৩ থেকে ১৬ সেন্টিমিটারের মধ্যে। টবের রঙ হবে গাছের সঙ্গে মানানসই। গাছটি যাতে কোন অবস্থাতেই টবের কানা স্পর্শ না করে ; সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। উদ্ভিদটির যদি যুক্ত কান্ড থাকে তবে একটি শাখা উর্ধ্বমুখী অন্যটি ডান বা বামে ঝুলে থাকবে। জাপানিরা এই ভঙ্গিমাকে বলে হ্যান কেঙ্গাই। ঝুলন্ত ভঙ্গিমার গাছগুলি ছাড়াও আরো বহু গাছ দিয়ে এই শৈলীর বনসাই করা যায়। তবে সবটাই নির্ভর করে আপনার রুচি পছন্দ শিল্প চেতনার ওপর।
বায়ুতাড়িত ভঙ্গিমা - যেখানে বছরের অধিকাংশ সময়ে কোন একদিক থেকে জোরে বাতাস বইতে থাকে; সেখানে এই ধরনের প্রাকৃতিক গাছ দেখা যায়। শঙ্করপুরের সমুদ্র সৈকতে ও চিল্কা হ্রদের পাশে পাহাড়ের চূড়ায় এ ধরনের গাছ দেখেছি। বায়ুতাড়িত ভঙ্গিমার বনসাই বেশ মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। গাছের কান্ডটি ডান বা বাম দিকে বেঁকে থাকে। গাছ যে দিকে বেঁকে থাকবে ডালপালা গুলিও সেদিকেই থাকবে। শাখা প্রশাখা গুলি হবে সোজা ও ছন্নছাড়া রকমের। অনেকে আবার বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে গাছের গায়ে তুষারপাত ও ঝড় ঝাপটার চিহ্ন ফুটিয়ে তোলেন । এইসব চিহ্ন ফুটিয়ে তোলার পদ্ধতিকে বনসাই শাস্ত্রের ভাষায় ‘জিনিং’ বলে। গাছের গোড়ার দিকে ডালগুলি বড় থাকবে উপরদিকে তা ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকবে। হেলানো দিকের শেকড়গুলি উন্মুক্ত ও প্রকট হওয়া দরকার। এই মূল শক্তপোক্ত না হলে গাছের ভারসাম্য ঠিকমতো বজায় থাকে না। তাই ডিম্বাকার টবের একধারে গাছটি লাগাতে হবে। জাপানিরা একে বলেন ফুকিনাগাশি ।
সম্মার্জনী ভঙ্গিমা - এই আকৃতিতে কান্ড হবে খাড়া । গাছের ডালপালাগুলি কান্ডের ওপর গোলাকারে ছড়ানো থাকবে। হঠাৎ করে দেখলে বনসাইটি উলটানো ঝাঁটার মতো মনে হয়। ডালগুলি মূলকান্ডের সাথে ইংরাজি ‘ঠ’ অক্ষরের মতো কোণে উর্ধ্বমুখী হয়ে থাকবে, কান্ড গোড়ার দিকে মোটা ও উপরে ধীরে ধীরে সরু হবে। প্রতিটি শাখা প্রশাখাও এমন হওয়া দরকার।
গাছকে তামিল দেওয়ার সময় নজর রাখতে হবে যাতে কোন ডাল অন্য ডালের ওপর দিয়ে না যায়। বনসাইটি সবদিক দিয়ে দেখতে যাতে একই রকম লাগে সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। ছোট চারাগাছ দিয়ে সম্মার্জনী ভঙ্গিমা শুরু করা ভালো। ডালপালা শাখা প্রশাখার অগ্রমুকুল কাঁচি দিয়ে ক্রমাগত ছেঁটে ওপরের আগাটিকে ঘন সন্নিবিষ্টকরা হয়। জাপানি ভাষায় এই শৈলীকে বলে হোকিদাচী।