ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-১০;বনসাইয়ের ভঙ্গিমা- ডাঃ পার্থপ্রতিম
বুৎপত্তি গতভাবে অগভীর পাত্রে লাগানো গাছ হলেও; টবে লাগানো গাছ মানেই বনসাই নয়। এমন কী মহীরুহ জাতের গাছও টবে লাগালেই তা বনসাই হয়ে যায় না। কৃষিবিজ্ঞান থেকে নান্দনিক স্তরে উত্তরণ ঘটলেই তবেই তা বনসাই হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। টবে গাছ লাগিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলে তার ওপর বিভিন্ন ভঙ্গিমা স্থাপন করা হয়। এই ভঙ্গিমা স্থাপনের মধ্যে দিয়েই একজন বনসাই শিল্পী তার শিল্পমনের স্বাক্ষরটি দর্শকের সামনে সুস্পষ্ট করে তোলেন। একখন্ড পাথর যখন প্রকৃতির বুকে পড়ে থাকে তখন তার তেমন কোন শিল্পমূল্য নেই। কিন্তু যখন কোন ভাস্কর তার ছেনী হাতুড়ির সাহায্যে তার উপর কল্পিত অবয়ব ফুটিয়ে তোলেন তখন তা অনুপম শিল্প মূর্ছনায় ভরে ওঠে। এভাবেই মূর্ত হয়েছে জন বার্নাড ফ্লানাগান-এর ‘দ্যা আলি বার্ডস বা হোরাশিও গ্রানওফ এর ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ টবে লাগানো গাছ হল সেই প্রস্তর খন্ড। এর ওপর যখন শৈলী স্থাপন করা হয় তখন তা তিল তিল করে বনসাই হয়ে ওঠে। এই শিল্পের অন্যতম দর্শন হল প্রকৃতির স্মৃতিচারণ। মহাকালকে ক্ষুদ্রকলেবরে বেঁধে ফেলবার প্রয়াস। বয়ে যাওয়া সময়ের ধারাপাত, প্রাচীনত্ব, রহস্যময়তা টবের উদ্ভিদটির মধ্যে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলে তবেই সেটি বনসাই হয়। নচেৎ তা ‘টবের গাছ’ হয়েই রয়ে যায়।
আসলে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষ মন মনন মানসিকতায় অনুভব করেছে অরণ্য বনানীর মাধুর্য প্রকৃতির বুকে ওঠা মহিরুহকে সে অসীম ধৈর্য নিষ্ঠা অধ্যাবসায় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। বনসাই চর্চার সময় সেই অভিজ্ঞতা লব্ধজ্ঞান ভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে মূর্ত করে তোলো হয় । তাই বনসাই শৈলী শুধু শিল্পকেই চেনায় না চেনায় শিল্পীকেও। শ্রষ্টার মেজাজ ব্যক্তিত্ব ঘরানা ও জাত তার সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবিম্বিত হয়। যা সমজদার দর্শকের চোখে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বনসাই প্রেমীরা পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বনসাই শৈলীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন। স্টাইলের এই শ্রেণীবিভাগকরায় জাপানিরাই পথিকৃৎ। এইসব শৈলীর প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে অনুজ বা শৈলী নিয়ে এমন আমরা একটু বিস্তারিত আলোচনা করবো-
ঋজু ভঙ্গিমা - এই বনসাইয়ের মূল কান্ডটি হবে একদম খাড়া। গাছের কান্ড টবের মাটির সাথে প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোনে থাকবে । কান্ড থেকে ডালগুলি পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত হবে। গোড়ার দিকে ডালের সংখ্যা কম আগার দিকে ডালের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ যত উপরে ওঠা যাবে ততই দুই শাখার মধ্যবর্তী দুরত্ব কমতে থাকবে । গাছের গুড়ি হবে নিচে মোটা ও ওপরে ধীরে ধীরে সরু । গাছের উচ্চতা ও গুড়ির মাপ ৬:১ হলে বনসাইটি দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগে। অর্থাৎ উচ্চতা যদি ৬ ইঞ্চি হয় তবে মাটির সংলগ্ন কান্ডের গোলাই হবে এক ইঞ্চি। উপরের দিকে শাখা প্রশাখা গুলি যাতে অতিরিক্ত ঘন সন্নিবিষ্ঠ না হয়ে যায় সে দিকে দৃষ্টি রাখা দরকার। সব ডালপাতা যাতে ঠিকমতো আলো বাতাস পায় সেটাও দেখতে হবে পূর্ণাঙ্গ বনসাইটিকে দেখে মনে হবে যেন সোজা দন্ডের উপর একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ বসানো আছে। আয়তাকার বা ডিম্বাকার টবে ঋজু বনসাই দেখতে ভালো লাগে। টবের অগভীরতা চার পাঁচ সেন্টিমিটারের বেশি না হওয়াই ভালো। বীজ থেকে চারা গাছ তৈরী করে তারপর এই স্টাইলের বনসাই করার চেষ্টা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শিমূল কদম বাওয়ার (অ্যাডেনসানিয়া ডিজিটাটা) ছাতিম ঝাউ (থুজা ওরিয়েন্টালিম ) গাছ দিয়ে সুন্দর খাড়া বনসাই তৈরী করা যায়। জাপানিরা এই শৈলীকে চোক্কন বলে।
প্রায় ঋজু ভঙ্গিমা - এই বনসাইয়ের কান্ড উর্ধ্বমুখী হবে তবে তা সোজা নয় আঁকাবাঁকা ইংরাজি অক্ষরের মতো মাটির সঙ্গে কান্ডটি সবসময় সমকোন নাও থাকতে পারে কান্ডে বারবার বাঁক তৈরীর ফলে গাছের আপাত উচ্চতা অনেক কমে যায়। যদিও কান্ডের প্রকৃত দৈর্ঘ্য একই থাকে। ডালপালার বিন্যাস ঋজু ভঙ্গিমার মতোই তবে কান্ড যে দিকে বাঁক নেবে তার বিপরীত দিক থেকে গাছের শাখা বের হলে বনসাইটি নান্দনিক হয়ে ওঠে। গাছের শাখা প্রশাখা আঁকাবাঁকা করার পদ্ধিতিকে বনসাই চর্চায় ট্রেনিং বা তামিল বলে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে যখন আলোচনা করবো তখন বোঝা যাবে এভাবে ডাল বাঁকানো খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। সাধারণ গাছ ছাড়াও ক্যাসুরিনা ইকুইজেটিফলিয়া দিয়ে এ ধরনের বনসাই সুন্দর ভাবে তৈরী করা যায়। জাপানিরা এই ভঙ্গিমাকে বলেন মোয়েগী। এই শৈলীর বনসাই দেখতে হবে বাঁকা দন্ডের ওপর বসানো বিষমবাহু ত্রিভূজের মতো।