ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-৮- বনসাইয়ের মাটি- ডাঃ পার্থপ্রতিম; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বনসাই চর্চার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি গাছ। আর গাছের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান হল মাটি। অনেকের ধারণা বনসাই করার সময় উদ্ভিদকে ঠিক মতো খাদ্য সরবরাহ করা হয় না। তাই গাছটি অপুষ্টির কারনে ঠিকমতো বাড়তে পারে না। ছোট খাট বনসাই হয়েই রয়ে যায়। এ ভাবনা মোটে ঠিক নয়। বনসাই তৈরীর উদ্ভিদটিকে সবসময় সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি যোগান দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে গাছ তার ঔজ্জল্য হারাবে, বিবর্ণ হয়ে যাবে তার পাতা ও ডালপালা। এ ধরনের রুগ্ন উদ্ভিদকে কখনই সঠিক বনসাই বলা যায়না।
যেহেতু ছোট পাত্রের মধ্যে অল্প পরিমাণ মাটিতে বনসাই তৈরী করা হয় তাই মাটির বিভিন্ন গুনাগুন যাতে ঠিকমতো বজায় থাকে সে বিষয়ে বিশেষ ভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। এ জন্য সেকারনে আলাদা ভাবে মাটি তৈরীর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বনসাই এর মাটি এমন হবে যাতে তার খাদ্যগুন ঠিকমতো বজায় থাকে এবং তা গাছকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। মাটি খুব বেশি আঠালো হবে না আবার এমনও হবে না যাতে মাটিতে জলের পরিমাণ কমে যায়। মাটি যাতে জলের সংস্পর্শে এসে কাদায় পরিণত না হয় তার জন্য উপাদানগুলির মাপ সঠিক হওয়া প্রয়োজন। মাটির ভেতর দিয়ে যাতে সহজে বায়ু চলাচল করতে পারে সে বিষয়েও নজর দিতে হবে।
যে তিনটি পুষ্টির উপাদান উদ্ভিদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম এছাড়া দরকার ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম্র । একটি গাছ সঠিক পুষ্টির জন্য যে সব উপাদান মাটি থেকে সংগ্রহ করে এই অবসরে তা একটু জেনে নেওয়া যাক। এ মৌলিক বিষয়গুলি জানা থাকলে যে কোন উদ্ভিদ প্রেমীর কাজ সহজ হবে।
নাইট্রোজেন- নাইট্রোজেন প্রধান সারের প্রয়োগে গাছের ডালপালা বৃদ্ধি পায়। নাইট্রোজেন উদ্ভিদের জীবনীশক্তির অন্যতম উৎস। উদ্ভিদ দেহে এই মৌলের অভাব হলে পাতার রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। ডালপালা বাড়তে পারে না। শাখাপ্রশাখার অগ্রম্র্র্র্র্রুকুল মরে যায়। গাছের বাড়ন্ত সময় অর্থাৎ বসন্তের প্রথমদিকে ও গ্রীষ্মের শেষ দিকে উদ্ভিদ দেহে নাইট্রোজেন সারের প্রয়োজন হয়।
ফসফরাস- ফসফরাস যুক্ত সার প্রয়োগে গাছের শেকড়, ফুল ও ফল বাড়ে এবং এগুলিতে সতেজতা আসে। উদ্ভিদ দেহে ফসফরাসের অভাব হলে ফুল ও ফল ঠিক মতো হয় না। পাতার রঙ বদলে যায়। পাতায় লালচে লালচে ভাব আসে। পাতা সরু হয়ে ওপর দিকে তির্যক ভাবে থাকে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকে শরৎকাল পর্যন্ত বনসাইতে ফসফরাসের চাহিদা বেশি হয়।
পটাসিয়াম- পটাসিয়ামের সাহায্যে গাছের গুঁড়ি মোটা ও শক্ত হয়। যে সব বনসাইতে ফল ও ফুল আসে তাদের অতিরিক্ত পটাসিয়াম জোগান দেওয়া দরকার। এর অভাবে গাছের বোটা থেকে ফল সহজেই ঝরে পড়ে। পাতায় ছিট ছিট দাগ হয়। গাছের পাতা আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। উদ্ভিদ দেহে সঠিক পরিমাণে পটাসিয়াম না থাকলে শেকড় অকেজ হয়ে পড়ে। ফলে মাটি থেকে সার ও জল সঠিক ভাবে শোষণ করতে পারে না।
ক্যালসিয়াম- ক্যালসিয়াম গাছকে ফসফরাস ও পটাসিয়াম শোষন করতে সাহায্য করে। শেকড়ের সঠিক বৃদ্ধি ঘটায়। ক্যালসিয়ামের অভাবে গাছের নতুন পাতা মরে যায়। অন্যসব পুষ্টি উপাদান থাকা সত্ত্বেও গাছ বাড়তে পারে না।
ম্যাগনেসিয়াম- ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিলে গাছের সবুজ পাতা হলদে হয়ে যায়। এসব ছাড়াও আরো কিছু পুষ্টি উপাদান খুব সামান্য মাত্রায় উদ্ভিদ দেহে প্রয়োজন হয়। পরিমানে অল্প হলেও উদ্ভিদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য এগুলি প্রয়োজন। কৃষিবিদ্যায় এরা ট্রেস এলিমেন্ট বা অণুখাদ্য নামে পরিচিত। এগুলির মধ্যে রয়েছে সালফার বা গন্ধক, আয়রন বা লোহা, জিঙ্ক বা দস্তা, কপার বা তামা আরো কিছু।
সালফার- ফসফরাসের সাথে মিলে উদ্ভিদের পুষ্টি যোগায়। গাছের প্রোটিন তৈরীর ক্ষেত্রে সালফার খুব প্রয়োজন। আয়রন গাছের ক্লোরোফিল তৈরীতে সাহায্য করে। আয়রনের অভাব হলে পাতার শিরাগুলি হলদে হয়ে যায়। ম্যাঙ্গানিজ উদ্ভিদ দেহে নাইট্রোজেন জোগান দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ম্যাঙ্গানিজ সঠিক মাত্রায় না থাকলে ফুল ও ফল আসে না। বোরন উদ্ভিদ কোষ গঠনে বিশেষ ভাবে অংশ নেয়। কপার পাতার ক্লোরোফিল তৈরী করতে সাহায্য করে। মূলত সারের সাহায্যে বনসাই এর মাটিতে এই সব পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা হয়। সার আবার দু ধরনের জৈব সার অজৈব সার। জৈব সার গাছের পাতা, ফেলে দেওয়া ফল-মূল জীবজন্তুর দেহাবশেষ এইসব বিভিন্ন উপাদান পচিয়ে তৈরী করা হয়। আর অজৈব সার রাসায়নিক কারখানায় তৈরী হয়। রাসায়নিক সার বিভিন্ন উপাদানে বাজারে পাওয়া যায়। নাইট্রোজেন ঘটিত সার হল - ইউরিয়া, ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডি.এ.পি) অ্যামোনিয়াম সালফেট, ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেড ইত্যাদি। ফসফরাস রয়েছে সুপার ফসফেট ও রক ফসফেটে। পটাসিয়াম থাকে মিউরিয়েট অব পটাশ (এম ও পি)ও রক ফসফেটে। অভিজ্ঞ কৃষকদের পরামর্শ মতো রাসায়নিক সার বনসাইতে প্রয়োগ করা যায়। তবে এই সারের মাত্রা অতিরিক্ত হলে গাছ ক্ষতি গ্রস্ত হয়। তাই প্রাথামিক পর্যায়ে যারা বনসাই চর্চা শুরু করেছেন তাদের রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে জৈব সারের দিকেই বেশি নজর দেওয়া দরকার।