ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব- ৩- বনসাই-এর গাছ নির্বাচন- ডাঃ পার্থপ্রতিম; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
এই শিল্পের মুখ্য বিষয় যেহেতু একটি গাছ তাই বনসাই তৈরির ক্ষেত্রে গাছ নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বনসাই-এর গাছ বলতে গাছের প্রজাতির কথাই বলছি। যে কোনো দ্বিবীজপত্রী তরু বা গুল্ম বনসাই তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে বর্তমানে কেউ কেউ একবীজপত্রী যেমন-তাল, খেজুর, নারিকেল এসবেরও বনসাই করছেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে যারা বনসাই র্চচা শুরু করতে চান তাদের প্রচলিত গাছ নিয়েই একাজে হাত দেওয়া উচিত। বিশেষত উত্তরবঙ্গে যে ধরনের গাছ স্বাভাবিকভাবে বন বাদাড়ে হয়ে থাকে বা অল্প যত্নে যেসব বেঁচে থাকতে পারে সেগুলি দিয়েই হাতেখড়ি করা ভালো। অশ্বথ, বট, পাকুড়, তেঁতুল, শেওড়া এগুলি হল এ অঞ্চলের বনসাই শুরু করার সবচেয়ে ভালো গাছ। বনসাইয়ের জন্য সেইসব প্রজাতির গাছ বেছে নেওয়া উচিত যার মধ্যে নীচের গুণগুলি রয়েছে-
(১) গাছ হবে কষ্টসহিষ্ণু। ডাল ও শেকড় ছাঁটাছাঁটি, ডালকে আঁকাবাঁকা করানোর ধকল সহ্য করতে পারবে।
(২) যেসব গাছে সহজেই বয়সের চিহ্ন ফুটে ওঠে। যেমন-ঝুরিনামা, কোটর এগুলি দেখা যায়।
(৩) গাছের ছাল বা বাকল হবে খসখসে। গাছের দুটি শাখা-প্রশাখার মাঝে থাকা স্থান বা পর্ব ছোট হওয়া দরকার।
(৪) যদি সপুষ্পক উদ্ভিদ হয় তবে ফুল ও ফল ছোট হতে পারে।
(৫) ছত্রাক ও বিভিন্ন রোগপোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করার শক্তি গাছের থাকা দরকার।
(৬) মাটির উপর উন্মুক্ত শেকড় যারা বেশি ছড়ায় সেই ধরনের গাছ দিয়ে আকর্ষণীয় বনসাই করা সম্ভব।
উত্তরবঙ্গে বনসাই তৈরির কতগুলি গাছ হল-বট, বৈজ্ঞানিক নাম-ফাইকাস বেঙ্গলিনসিস। পাতা বড় হওয়া সত্ত্বেও এর ঠাসমূল বা পপ রুট গাছটির বয়স বোঝাতে সাহায্য করে। তাছাড়া মাটির ওপর ভেসে ওঠা শেকড় বনসাইটিকে নান্দনিক করে তোলে।
অশ্বথ- বৈজ্ঞানিক নাম-ফাইকাস রিলিজিওসা। পোড়ো বা ভাঙা দেওয়ালে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে। এইভাবে সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকা পুরানো গাছ সংগ্রহ করে অল্প সময়েই আকর্ষণীয় বনসাই করা যায়। তাছাড়া বীজ বুনে গাছ তৈরি করা যেতে পারে।
রাবার- বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস ইলাস্টিকা। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে এটি ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। বৃষ্টিভেজা আর্দ্র পরিবেশ রাবার গাছের পক্ষে খুবই অনুকূল। এ গাছ থেকে ঝুরি নামে বলে বনসাইটি দেখতে সুন্দর লাগে। তবে পাতা বড় হওয়ার কারণে এই গাছকে খুব ছোট বনসাই করা যায় না।
করমচা-বৈজ্ঞানিক নাম কোরিসা করন্দাস। পাতা ও ফল ছোট, দেখতে খুব বাহারি। গাছে মোটামুটি সারা বছর পাতা থাকে। করমচা ফল দিয়ে জিভে জল আনা আচার চাটনি তৈরি করা হয়। বীজ বা গুটি কলমের সাহায্যে চারা তৈরি করা যায়। করমচার বনসাইতে ফল এলে তা খুব মনোরম হয়ে ওঠে।
তেঁতুল-বৈজ্ঞানিক নাম ট্যামারিনডাস ইন্ডিকা। তেঁতুলের পাতা গুঁড়িগুঁড়ি হওয়ার জন্য খুব সহজেই একে বনসাই করা যায়। তাছাড়া এই গাছ বেশ কষ্টসহিষ্ণু। বাঁচেও অনেক বছর।
বকুল-বৈজ্ঞানিক নাম মিমোসপস এলেঙ্গি। সুগন্ধের জন্য এটি বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। কাব্য-সাহিত্যে বকুলের বেশ উল্লেখ পাওয়া যায়। রৌদ্র- ছায়া জায়গাতে বকুল ভালোভাবে বাড়ে। গাছে সারা বছর পাতা থাকে বলে বনসাই হিসাবে এর আলাদা কদর।
পাকুড়-বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস বেঞ্জামিনা। বট, অশ্বথের মতো এটিও পোড়ো বাড়ির আনাচে-কানাচেতে দেখা যায়। বনসাই র্চচা শুরু করার ক্ষেত্রে এটি খুবই ভালো।
গাই অশ্বথ-বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস রুমফাই। এ গাছের পাতা পানের মতো দেখতে। এর ফল অনেকে সবজি হিসাবে খান। অন্য গাছের ওপর এ গাছ হতে দেখা যায়। আমি কাঠবাদাম গাছের কোটর থেকে গাই অশ্বথের গাছ সংগ্রহ করে বনসাই করেছি। সেটি এখন বেশ সুন্দর হয়েছে। বিভিন্ন ধকল সহ্য করতে পারে বলে এ গাছ বনসাই হিসাবে খুব জনপ্রিয়।
কথবেল- বৈজ্ঞানিক নাম ফেরোনিয়া লিমোনিয়া । ছোট কালচে সবুজ পাতার জন্য গাছটি সুন্দর দেখায়। গাছের প্রধান শেকড় কেটে দিলে গাছটি ধীরে ধীরে বাড়ে। তাই বনসাই হিসাবে এটি খুব উপযুক্ত।
কামিনি- বৈজ্ঞানিক নাম মুরাইয়া এক্সোটিকা । সাদা সুগন্ধী ফুল মন মাতিয়ে দেয়। রবীন্দ্র সাহিত্যে বহু জায়গায় এর উল্লেখ আছে। পাতাগুলি ছোট গোল গোল ও চকচকে । গুল্ম জাতীয় গাছ হওয়া সত্ত্বেও ভালো বনসাই হয়।
শ্যাওড়া- বৈজ্ঞানিক নাম স্ট্রেরলেয়াস এসপার। গাছের পাতা গোল ও ছোট। ডালপালাগুলি খুবই স্থিতিস্থাপক হলদি বাড়ি পার্কে এক শিল্পী এই গাছ দিয়ে সুন্দর সুন্দর মডেল বানিয়েছে। ডালপালা ইচ্ছামত বাঁকানো যায় বলে এদিয়ে পরিকল্পিত বনসাই তৈরী সম্ভব।
আমলকী- বৈজ্ঞানিক নাম ফাইল্যানথাস ইমব্লিকা। ভেষজ গুনের জন্য একসময় যথেষ্ট পরিমাণে এই গাছ ছিল। তেঁতুল গাছের মতো ঝিরঝিরে পাতা থাকার জন্য বনসাই করার ক্ষেত্রে বেশ সুবিধা রয়েছে।
কাগজফুল- এর আর এক নাম বোগেনভেলিয়া বা বাগান বিলাস। নিক্টেজিনেসি গোত্রের এ গাছের অনেক প্রজাতি রয়েছে। বিভিন্ন রঙ বেরঙের বাহারি ফুল পুষ্পঋতুতে গাছটিকে ভরে দেয়। উত্তরবঙ্গের আবহাওয়াতে অল্প যত্নে গাছটি বেশ ভালো বাড়তে পারে। সপুষ্পপক বনসাই করার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের বেশ কদর রয়েছে।
ছাতিম- বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালস্ট্রনিয়া স্কলারিস। ছাতিমের প্রতিটি পত্রসন্ধিতে পাঁচটি বা সাতটি পাতা থাকে। কবিগুরু তাই এর নাম রেখেছেন সন্তপর্নী । এই গাছকে ঝোপালো বনসাই করা যায়। বট অশ্বথের মতো না হলেও এ গাছেও ঠেসমূল নামে। ছাতিমের বাঁকা বা হেলানো বনসাই দেখতে বেশ ভালো লাগে।
এগুলি ছাড়াও আরো বহু প্রজাতির গাছ রয়েছে যা দিয়ে সুন্দর বনসাই করা যায়। পরবর্তীতে সে সব নিয়ে আবার আলোচনা হবে।