ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-২

ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-২

ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-২; বনসাই শিল্প ও দর্শন; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বনসাই একটি শিল্প। বর্তমানে এই শিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। যেভাবে পাবলো পিকাসো ক্যানভাসের বুকে রং-তুলি দিয়ে ‘দ্য ওল্ড গিটারিস্ট’কে জীবন্ত করেছেন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো খোদাই করেছেন ‘পিটা’ মর্মর মূর্তি, যেভাবে ভীমসেন যোশী দেশরাগ শোনান সুরের মুর্ছনায়, ঠিক সেভাবেই একজন শিল্পী তার উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিল তিল করে তৈরি করেন একটি আকর্ষণীয় বনসাই। তবে বনসাই তৈরির ক্ষেত্রে উদ্ভিদবিদ্যার জ্ঞানের চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় শিল্পীমন ও প্রকৃতির প্রতি মমত্ব। শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বনসাই অন্যসব শিল্পকলাকে বহু যোজন পেছনে ফেলে দেয়। তার অন্যতম কারণ এখানে প্রধান উপকরণ নির্জীব বা জড় পদার্থ নয়; এক জীবন্ত প্রাণ। যেহেতু বনসাই সজীব উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠা শিল্প তাই জীবনের নিয়ম মেনেই এর বৃদ্ধি ঘটে, বিকশিত হয় ও জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যসব শিল্পীদের কাজ একদিন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়। যেভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের আঁকা ‘সান ফ্লাওয়ার’ বা ‘দ্য পটেটো ইটারস’। কিন্তু বনসাই শিল্প কোনোদিনই শেষ হয় না। জাপানে এমন কিছু বনসাই আছে যার পরিচর্যা চার-পাঁচ পুরুষ ধরে হয়ে চলেছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বনসাই দুনিয়ার সবচাইতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা শিল্পকর্ম।

   সার্থক শিল্পের মধ্যে দিয়ে যেমন শিল্পীর একটা নিজস্বতা, আপন বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, বনসাইয়ের গতি-প্রকৃতি, ডালপালার বিন্যাস, ভারসাম্য ও সংহতি খুঁটিয়ে দেখলে বনসাইবিদের নিজস্বতা সমাজদারের চোখে ধরা পড়বে। মকবুল ফিদা হুসেনের ছবি দেখে যেমন আমরা সহজেই শিল্পীকে চিনতে পারি সেভাবেই পিচার চ্যানের তৈরি করা বনসাইটি শিল্পীর পরিচয় বুঝিয়ে দেয়। একটি উন্নতমানের শিল্প মহিমামন্ডিত চিত্রকলা বা ভাস্কর্যের মূল্য যেমন অপরিসীম। তেমনই একটি সার্থক বনসাইও অমূল্য হয়ে ওঠে। বনসাইয়ের মূল্য তার কাঁচামাল বা উপকরণ দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না। কারণ এরসঙ্গে মিশে থাকে এক প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পীর দীর্ঘদিনের শ্রম, সাধনা, ভালোবাসা ও অধ্যবসায়। তাই সবদিক দিয়েই বনসাই মূল্যাতীত।

বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পের মধ্যে নিহিত থাকে একটি দর্শন বা ফিলোজফি। শিল্প যখন দর্শনহীন হয়ে পড়ে তখন তা শিল্প থাকে না, নিছক বিনোদন হয়ে যায়। বনসাই র্চচার মধ্যে রয়েছে এক নিগূঢ় দর্শন। এই ধরিত্রীর বুকে আমাদের বেঁচে থাকা। এই মমতাময়ী মাটির পৃথিবী থেকেই আসে আমাদের দেহের আরাম, প্রাণের শান্তির উপাদান। প্রতিক্ষণে প্রকৃতির অপার স্নেহ বর্ষিত হচ্ছে এই জীবনের ওপর। বনসাই র্চচা হল সেই মাতৃরূপী প্রকৃতির প্রতি মানব সন্তানের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার প্রতীক। মরু বিজয়ের কেতন ওড়ানো মোহন প্রাণের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন। বনসাই শিল্প স্বর্গের ঈশ্বর ও মর্ত্যের প্রকৃতির মধ্যে মেলবন্ধনের বাস্তব অবয়ব। উপনিষদের ভিত্তিতে বলা যায়-পুরুষ ও প্রকৃতির সম্মিলিত রূপ। চীন ও জাপানে শিল্পীরা বনসাই তৈরি কনের শঙ্কু বা কোণ আকৃতিতে। এর উপরের অংশ হল ঈশ্বর, মাঝে মানবসমাজ ও নীচে ধরনি। এ যেন প্রাচীন ভারতীয় বেদান্তের সেই সৎ-চিৎ-আনন্দের রূপক। এসব তো নতুন কিছু নয়। সর্বত্রব্যাপী বিপুল ক্ষমতাশালী, অমর-অক্ষয় দেব-দেবীদের ছোট্ট প্রতিমা কল্পনা করে আমরা আমাদের ভক্তি পূজা-অর্চনার মাধ্যমে নিবেদন করে এসেছি। বনসাই র্চচা পালন প্রকৃতির প্রতি সেই পূজা অর্ঘ্য ধৈর্য-নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অসীমকে সীমার মাঝে বেঁধে ফেলবার প্রয়াস।

Join our mailing list Never miss an update