ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-১

ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-১

ঘরের ভেতর মহিরুহ- পর্ব-১;বনসাইয়ের ইতিকথা- ডাঃ পার্থপ্রতিম; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
সে স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটবাড়ি হোক বা বিশাল জায়গা জোড়া হলঘর। টেবিলের এককোণে বা বাতায়ন পাশে একটি-দুটি বনসাই আপনাকে এনে দেবে শ্যামল পরশ। অরণ্যের মর্মর ধ্বনি শুনতে না পেলেও, ঘরের ভেতর বাঁধা পড়া এই মহিরুহ অতীত তপোবনের স্নিগ্ধতা নিয়ে হাজির হবে আপনার চার দেওয়ালের মাঝে। এ যেন বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন ।
বনসাই শব্দটি মূলত জাপানি। যার বাংলা তর্জমা করে বলা যায় অগভীর পাত্রে লাগানো গাছ। বন শব্দটির মানে থালাজাতীয় পাত্র এবং সাই অর্থ গাছ। শোনা যায় টং গুয়েন মিং নামের এক চীনা কবি ও তার সঙ্গে কয়েকজন রাজকর্মচারী রাজকাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে শুরু ক’রে তারাই প্রথম শুরু করে টবে ফুল চাষ। উদ্যানবিদ্যার সালতামামি নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাদের মতে টবে প্রথম ফোটা ফুলটি হল চন্দ্রমল্লিকা।

বনসাইয়ের আদি নাম ছিল পানসাই। পানসাই তৈরির আগে চীনদেশে পান চিং নামের আর এক ধরনের শিল্পের প্রচলন ছিল। থালা বা ট্রেতে ছোট ছোট পুতুল দিয়ে বানানো হত গ্রাম-শহর বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ বা ভূমিরূপ। বিভিন্ন গবেষকদের তথ্য থেকে জানা যায় হ্যান বংশের রাজত্বকালে  ( খ্রিঃ পূঃ ২০৬-২২০খ্রিস্টাব্দ) পান চিং তৈরি শুরু হয়। চীনদেশের প্রচলিত লোককাহিনিতে আছে-জিয়াং ফেঙ নামে এক শিল্পী একটি থালার মধ্যে পাহাড়-পর্বত-পুকুর-নদী-ঘরবাড়ি-বাজারঘাট; প্রায় বিশ্বভুবন তৈরি করতে পারতেন। পান চিং চর্চা শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই পানসাই তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
খ্রিস্ট জন্মের এক হাজার বছর পর লিখিত চীনা সাহিত্যে পানসাই-এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। ১৬৪৪ থেকে চীনে শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ চলছিল। এই কালকে বলে চী ইঙ যুগ। এসময় পানসাই ও পান চিং শিল্পদুটি ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই দুই শিল্পকে একসঙ্গে পেনজিং বলে ডাকা হত। বামনবৃক্ষের র্চচা চীন দেশে শুরু হলেও জাপানিরাই বনসাইকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেয়। সম্ভবত দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা চীন থেকে জাপানে পানসাই নিয়ে আসে। তাদের কাছে পানসাই ছিল ধর্মসাধনারই অঙ্গ। বৌদ্ধ দর্শন যেহেতু প্রকৃতিকেন্দ্রিক তাই বৌদ্ধবিহারগুলিতে পানসাই সমাদৃত হতে থাকে। এছাড়াও জাপানি রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীরা চীনে গিয়ে উপহার ও স্মারক হিসাবে পানসাই নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। শোনা যায় ১৬৪৪ সালে চু শান শিউ নামে রাজপরিবারের আত্মীয় মাঞ্চু রাজাদের কোপ থেকে বাঁচার জন্য চীন ছেড়ে জাপানে আশ্রয় নেয়। চু শান শিউ ছিলেন একজন পানসাই বিশেষজ্ঞ। তিনি যাওয়ার সময় পানসাই সংক্রান্ত তাবৎ লেখাপত্তর ও কিছু আকর্ষণীয় পানসাই নিয়ে যান। এর পর জাপানের রাজা সেইজির পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজকর্মচারী সকলে মিলে পানসাই র্চচা শুরু করে। এসময় জাপানিরা পানসাইকে নাম দেন বনসাই।

প্রথমদিকে এটি সীমাবদ্ধ ছিল অর্থবান অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটি আমজনতার বিষয় হয়ে ওঠে। ক্রমশ এর ক্ষেত্রে, পরিধি ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৭৮ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় জাপানিরা পাশ্চাত্যের সামনে বনসাইকে প্রথম হাজির করে। ১৯০৯ সালে লন্ডনের বিশ্ব শিল্প প্রদর্শনীতে বনসাই সকলের নজর কাড়ে। এরপর থেকেই বনসাই নতুন রূপে দেখা দেয়। জাপানে ‘জাতীয় শিল্পকলা’র সম্মান লাভ করে।
আমাদের দেশেও বনসাই র্চচা নতুন নয়। বৈদিক যুগেও এ ধরনের চেষ্টা ছিল বলে জানা যায়। আজ থেকে চার হাজার বছর আগে লেখা হয় বেদ। সর্বশেষ বেদ হল অথর্ব বেদ। অথর্ব বেদের অন্যতম অংশ হল আয়ুর্বেদ। আয়ুর্বেদকে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুরুয়াৎ বলা যেতে পারে। আয়ুর্বেদের দুটি আকরগ্রন্থ হল চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। চরক সংহিতায় ১১০০টি এবং ১২৭০ রকমের গাছ-গাছড়ার উল্লেখ আছে। ভেষজগুণসম্পন্ন গাছগুলিকে ছোট পাত্রে বাঁচিয়ে রাখা হত। যাতে প্রয়োজন মতো তার ডালপালা, শেকড়, ছাল, পাতা ওষুধের কাজে ব্যবহার করা যায়। লাগাতার ডালপালা, মূল, ডগা কাটার ফলে স্বাভাবিকভাবে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হত। এই ধরনের পদ্ধতিতে গাছ রাখাকে আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে- বামনতনু বিদ্যা। বামনতনু বিদ্যাকে বনসাই চর্চার আদিরূপ মনে করলে বোধহয় ভুল হবে না।
আমরা জানি তথাগত বুদ্ধ এক বটবৃক্ষের তলে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তাই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই গাছকে পবিত্র মনে করে। সন্ন্যাসীরা পাথর ও মাটির পাত্রে এই গাছকে রেখে পূজা উপহার দিয়েছিলেন। অনেকে সেটাকে বনসাই বলে দাবি করেন।

প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকুরের লেখা ‘অবনীন্দ্র চরিতম’-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বর্ণনা পাওয়া যায়-‘আর ছিল বারান্দার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দেওয়াল গিরি এবং একপ্রস্থ মার্বেলের ওপর বসানো তিনটে চিনামাটির টব তাতে জাপানি বৃক্ষের পত্র পুষ্পাশোভিত শোভা......’ এই লেখা থেকে মনে হয় ঠাকুরবাড়িতে বনসাই-এর প্রবেশ ঘটেছিল।
আমাদের দেশে আধুনিককালে বনসাই-এর প্রচলন নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। সঠিক প্রমাণপত্র তেমনভাবে কিছু পাওয়া যায়নি। সত্তর দশকে উমা বেজ নামে এক মহিলা কলকাতায় বনসাই-এর বিষয়ে হাতে-কলমে ট্রেনিং দিতেন। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লিতে ভি পি অগ্নিহোত্রী এদেশের উপযোগী করে বনসাই র্চচা শুরু করেন। সম্ভবত ১৯৬৫ সালে বোম্বাইতে বনসাইপ্রেমীদের প্রথম সংগঠনটি গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন শহরে বনসাই শিল্পের র্চচা শুরু হয়ে যায়। তবে এখনো এটি অভিজাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বয়ে গেছে। দক্ষিণবঙ্গে কিছু কিছু বেকার যুবক বাণিজ্যিকভাবে বনসাই উৎপাদন শুরু করেছে। উত্তরবঙ্গে সেরকম কিছু জানা যায়নি।

Join our mailing list Never miss an update