বহু বছর পর যেতে হলো রাজধানীতে। এ.পি.জে আব্দুল কালাম গোল্ড স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে। ডুয়ার্স থেকে দিল্লী, সূর্যস্নাত বর্ণময় এই যাত্রাপথে মজা, ভালোবাসা, অনুভূতিতে উপচে উঠলো হৃদয়ের পাত্রখনি। মন চাইলো- সেই টুকরো হাসি, টুকরো কথায় প্রিয়জনদের ভাগ দিতে. . .।
দিল্লীর দিনলিপি; পর্ব -২; বিশ্ব সাথে যোগে
ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশানাল এয়ার পোর্টের উপর দুবার চক্কর কাটল ফ্লাইট 6E5061। দিল্লীতে এখন সবুজের সমারোহ। আকাশ থেকে তা বেশ বোঝা যায়। ধীরে ধীরে তা নেমে এল T3 ডোমেস্টিক টার্মিনালে। দেশের রাজধানী বলে কথা। স্বাভাবিক ভাবেই তা বেশ ঝকঝকে তকতকে। সুন্দর সব ভাস্কর্যে মোড়া। কোথাও বড়সড় শঙ্খ পাঁক মারছে। কোথাও সূর্য নমস্কারের বিভিন্ন আসনের মডেল। আরও বহুকিছু।
আগেই ঠিক করেছিলাম চিত্তরঞ্জন পার্কে উঠব। সি. আর পার্কের সেই লজ মালিক গৌরাঙ্গ বাবুকে ফোন করলাম। তিনি বললেন- ‘‘আপনি ওখানে থাকুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে লাইভ লোকেশনটি শেয়ার করে দিন। আপনার নম্বর ড্রাইভারকে দেওয়া আছে।” কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপন পরিয়া গাড়ি নিয়ে হাজির। স্বপন ১২ বছর ধরে দিল্লীতে আছে। মেদিনীপুরের ছেলে। স্বপনের ১ ছেলে ও ১ মেয়ে দিল্লীতেই এক স্কুলে পড়ে। ইংরাজী মাধ্যমের এই স্কুলে বাংলা পড়ানো হয়। স্বপনবাবু একরাশ বিরুক্তি নিয়ে বললেন- একটু ঘুরপথে যেতে হবে। কয়েকদিন হল JNU ছাত্ররা মাঝে মাঝেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। কথা শুনে মনে হল বিক্ষোভরত ছাত্র-ছাত্রীদের এ হেন আচরনে স্বপনবাবু রীতিমত ক্ষুদ্ধ।
আসলে দিল্লীতে গিয়ে একটা জিনিস উপলদ্ধি করলাম। এখানে কারও হাতে তেমন বাড়তি সময় নেই। সবাই যে যার নিজ কাজ নিয়েই ব্যস্ত। আর সব কিছুই যেন সময় বাঁধা। যে কোন মহানগরীতেই তাই হয়। আসলে কলকাতার নিন্দামন্দ করলে বাঙালীদের গায়ে লাগে। চেন্নাই এর ভালোমন্দ নিয়ে যেমন তামিলরা সচেতন, কানাড়ীরা ভাবে ব্যাঙ্গালোরু নিয়ে। দিল্লীতে এমন যারা আছে তারা সংখ্যাই খুবই কম। পরদেশীরাই এখানে বিরাট সংখ্যায়।
স্বপন আমায় পৌঁছে দিল সি আর পার্কের গৌরাঙ্গ লজে। সঞ্জীব এসে আমার ব্যাগ নিয়ে গেল লজে। সঞ্জীব জানতে চাইল- ‘স্যার কি খাবেন?’ কেমন খাবার আপনার পছন্দ। সুগার, হাইব্লাডপ্রেসার আছে কিনা। আরও দু' একটি বিষয়। আমি সঞ্জীবকে বললাম আমি সেই ভাগ্যবান বাঙালী, ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পর যার বিনা ওষুধে প্রেসার ও সুগার স্বাভাবিক। খাওয়ার বিষয়ে কোন বাছবিচার নেই। গো মাংস থেকে পর্ক সবই খেয়েছি। তবে বেশি ঝাল ও টক এ দুটি খেতে একটু অসুবিধা হয়। সেভাবে অস্বাস্থ্যকর না হলে সবই চলে। সঞ্জীব জানতে চাইল আমি অ্যালকোহলিক কিনা। বললাম নন-অ্যালকোহলিক নই; তবে বাইরে একলা এসেছি তাই ওসব আপাতত বন্ধ।
খেয়ে দেয়ে শুয়ে একটু আরাম করছি। ফোনটা বেজে উঠল। মহিলাকন্ঠে ভাঙ্গা বাংলায় বললেন- “ডাক্তারবাবু বলছেন। আমি লাউজ গ্লোবাল সোসাইটি থেকে বলছি। আপনি দিল্লী পৌঁছে গিয়েছেন। হ্যাঁ। Tomrrow কি Program আছে আপনার?” তেমন কিছু নেই, অনেকদিন পর এলাম। দিল্লীটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা রয়েছে। আপনি কি আমাদের Project-এ গিয়ে visit করতে চান। Then you may go along with me। আমি বললাম- কিভাবে যাব? আপনি কোথায় উঠেছেন Location share করুন। কাল সকালে কখন আপনাকে নিতে আসব।
দিল্লীতে বেশ বেলা করে দিন শুরু হয় ও দেরি করে রাত হয়। ভৌগোলিক ভাবে দিল্লী আমাদের ডুয়ার্স থেকে অনেকটা পশ্চিমে রয়েছে। তাই এটাই স্বাভাবিক। মঙ্গলবার বেলা ১০ টা নাগাদ সঞ্জীব এসে খবর দিল স্যার একজন মেমসাহেব ড্রইং রুমে বসে রয়েছে আপনার জন্য। প্রথমে দেখে কিছুটা ঘাবরে গেলাম। সব অর্থেই মেমসাহেব। বিদেশিনী দুধে আলতা ফর্সা ৬ ফুটের বেশি লম্বা, বেশ স্বাস্থ্যবতী। চেহারার দিক থেকে এদেশে যে কোন ছবির নায়িকা হতে পারে। বললেন- Good morning Doctor. Yesterday আমি আপনাকে কল করেছিলাম।’’ লাউজ ? yeh. লাউজের বাড়ি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেট ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়ার সাহায্য প্রাপ্ত একটি Project-এ কাজ করে। শান্তিনিকেতনে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এর উপর একটি কোর্স করেছে। বেশ কিছুদিন সেখানে ছিল। পড়তে না পারলেও বাংলা বুঝতে পারে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বলতেও পারে। বাংলা জানার সুবাদে আমার আতিথেয়তার দায়িত্ব বর্তেছে ওর ওপর। কথা শুনেই বুঝলাম আমার প্রোফাইল ও মুখস্থ করেই এসেছে।
দিল্লীর নয়ডা অঞ্চলে যমুনা নদীর ধারে এখনও বহু মোষের খাটাল রয়েছে। সেখানে মোষ পালকদের স্বাস্থ্য শিক্ষা আরও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করছে লাউজের সংস্থা। Doctor are you liked to visit our project area ? পাল্টা প্রশ্ন করলাম- How long you will be stay there ? আপনি যতক্ষণ থাকতে চান ততক্ষণই থাকবেন। উবেরের ছোট ক্যাব ডেকে আনল লাউজ।
দিল্লীর ক্যাব সার্ভিস খুবই সুন্দর। মুহুর্তের মধ্যেই গাড়ি হাজির। ভাড়াও বেশ কম। নেভিগেশন খুব ভাল। আর সবচেয়ে ভাল মোবাইল নেটওয়ার্ক। সব জায়গায় হাই স্পিড ইন্টারনেট। আমাদের অর্থমন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারমন হয়তো ঠিকই বলেছেন, ক্যাব সার্ভিসের জন্য গাড়ি শিল্পের বিক্রিবাট্টা সংকটে পড়েছে। আমাদের নিয়ে চওড়া রাজপথে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার পেরিয়ে গাড়ি ছুটল যমুনা তীরে। ক্যাবের ভাড়াটা লাউজ জোড় করে দিয়ে দিল। বলল- ‘on behalf of our organization some fund already allotted for your hospitality.’ গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হল। পৌঁছে গেলাম মোষের খাটালে। লাউজকে দেখে সবাই খুশি। বুঝলাম এখানে ও বেশ জনপ্রিয়। সবাইকে নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। এ তল্লাটে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। মোষ পালন করলে কী হবে, জামা কাপড়, সাজ পোষাকে সবাই বেশ টিপটাপ।
উপলদ্ধি করলাম পৃথিবীটা ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সেই অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধের এক দ্বীপ রাষ্ট্র, মহাদেশও। সেখান থেকে এক যুবতী মেয়ে ভারতের এক বস্তির বহু মানুষের আপনজন হয়ে গেছে। বয়স কতই বা হবে ২৮ বা ২৯। এ কাজ করে লাউজও বেশ খুশি। তাঁর টি শার্টের উপর লেখা জানান দিচ্ছে এমনই এক জীবনের স্বপ্ন ছিল তাঁর। যা আজ সত্যি হতে চলেছে। খোঁজ খবর নিয়ে বুঝলাম এ কাজে তাঁর তেমন কোন বড়সড় আর্থিক প্রাপ্তি নেই। হাতে নেই ভোট ভিক্ষার ঝুলি। যাদের জন্য ও কাজ করছে কেউ তার দেশবাসী নয়। ভাষাও সংস্কৃতিগত ভাবে কোন মিল নেই। লাভ লোকসানের পাটিগণিতের তোয়াক্কা না করে হয়ত এভাবেই ছোটে যৌবন বেগ, জীবনের উল্লাসে। আমি যাদের মাঝে কাজ করি তারা সবাই আমার জন্মগত প্রতিবেশী । যে সামান্য কিছু কাজ করেছি তার জন্য বহু পুরস্কার সম্মাননা ও সংবর্ধনা পেয়েছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বড় বড় প্রতিবেদন বেড়িয়েছে আমার কাজ নিয়ে। বহু সাংবাদিক ভাই আমায় নিয়ে অনেক কিছু লিখেছে । সে কারণে আমি যে মাঝে মাঝে কিছুটা আত্ম গর্ববোধ করি -তা অস্বীকার করার নয়। লাউজ হয়ত এসবের তোয়াক্কা করে না। এরা নিজের কাজের আনন্দেই নিজেই মশগুল। তাকে নিয়ে কে লিখল, কে লিখল না, ফ্লাশ লাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হল কিনা মুখ তা নিয়ে কোন ভাবনা নেই। লাউজের কাছে এসে নিজেকে যেন অনেকটাই ছোট মনে হতে লাগল।
ফিরতিপথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছু টোস্ট ও কফি খেলাম। লাউজ আবার স্বাস্থ্যসচেতন। প্যাকেট জাত খাবার ছাড়া খোলাখাবার যেখানে সেখানে খায় না। তাও আবার প্যাকেট খোলার আগে তার গায়ে লেখা ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালোরির হিসেব দেখে নেয়। চিকিৎসক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা ওর কাছে খোলসা করলাম না। ওকে বললাম না এ দেশে প্যাকেটের গায়ে যা লেখা থাকে অনেক ক্ষেত্রেই প্যাকেটের ভেতর তেমনটি থাকে না। এদেশে ফুড ইনস্পেকটাররা নিজের বেতনে তেমন হাত না দিয়ে, দিব্যি বহাল তবিয়তে সাংসারিক ব্যয়ভার চালান।
এর মধ্যে কখন যে ও ম্যাডাম থেকে ভাইজি হয়ে গেছে। আমি হয়ে গেছি ওর ‘সুসু’। ভারতবর্ষের সংস্কৃতের মতো, অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন ভাষা ম্যান্ডোলিন। সে ভাষায় কাকা বা Uncle কে বলে ‘সুসু’। লাউজকে বললাম কথ্য বাংলায় শিশুদের ইউরিনেশনকে আমরা ‘সুসু’ বলে থাকি। শুনে ও তো হেসে কুটিকুটি। ও বললো তাহলে তুমি আমার হাংওয়ো (Pengyau) হতে পারো। হাংওয়ো মানে বন্ধু। আমি বললাম - না বাবা এমন খটমটে শব্দ আমার মুখে আসবে না। তার চেয়ে সুসু- ই ভালো। তাছাড়া আমি তোমার বহু বছর আগেই ধরার বুকে ধরা দিয়েছি। লাউজ গভীর রবীন্দ্র অনুরাগী। সে টানেই শান্তিনিকেতনে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। কবিগুরু সম্বন্ধে আমার ভাবনাগুলি জানতে চাইল। আলাপ ক্রমেই গভীর হল। অনেক মিলের খিল খুলে গেল দুজনার মাঝে। ফিরতি পথে পড়ন্ত বিকেলে দুজনে গাড়ির পিছনের সিটে হাতে হাতে রেখে আবৃত্তি করতে করতে এলাম; ওর জানা সেই কবিতাটি- ‘আজই এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পষিল প্রাণের পর।/ কেমনে পষিল গুহার আধাঁরে / প্রভাত পাখির গান।..............................’ । রাজধানীর গোধূলিতে সূর্য তখন আবীর ঝরাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে। হয়তো কোনো নতুন প্রভাতের কামনায় . . ।