বহু বছর পর যেতে হলো রাজধানীতে। এ.পি.জে আব্দুল কালাম গোল্ড স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে। ডুয়ার্স থেকে দিল্লী, সূর্যস্নাত বর্ণময় সেই দিনগুলিতে মজা, ভালোবাসা, অনুভূতিতে উপচে উঠলো হৃদয়ের পাত্রখনি। মন চাইলো- সেই টুকরো হাসি, টুকরো কথা প্রিয়জনদের ভাগ দিতে. . .।
দিল্লীর দিনলিপি; পর্ব -১; শুরুর সুরুয়াৎ
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সপ্তাহে চিঠিটা দিয়ে গেল পোষ্ট অফিসের পিওন ভাই। লেফাফার ওপর প্রেরক হিসেবে দিল্লীর ঠিকানা ছাপা। ইংরাজী চিঠিটি বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় - আমরা ২০১৯ সালের এ.পি.জে আব্দুল কালাম গোল্ড স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডের জন্য প্রাথমিক স্তরে সারা ভারতের ৭৫ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছি। আপনি তার মধ্যে একজন। আপনার সামাজিক কাজের বিস্তারিত বিবরণ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমাদের কাছে পাঠানোর অনুরোধ রাখছি।
চিঠিটি ড্রয়ারের এক কোণায় বেশ কিছুদিন পড়েছিল। এর আগে যে এ ধরনের পুরস্কার পাইনি তা নয়; তবে সে সবক্ষেত্রে দলিল দস্তাবেজ পাঠানোর ঝক্কি ঝামেলা ছিল না। এরই মাঝে একদিন বানারহাট স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ভ্রাতৃপ্রতিম জুয়েল স্যার (আসফাক আহমেদ) আমার চেম্বারে এল। অনেক গল্পের মাঝে কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে চিঠিটি দিলাম। জুয়েল জিজ্ঞাসা করল - দাদা সবকিছু পাঠিয়ে দিয়েছেন? বললাম- না ভাই। কি পাঠাবো ? কিভাবে পাঠাবো বুঝতে পারছি না। তাছাড়া এটাতো দিল্লীর ব্যাপার, দেশ জোড়া কর্মকান্ড এখানে পাঠিয়ে কি কোন লাভ হবে? শুধু, সময় নষ্ট।
জুয়েল দেখি বেশ উৎসাহী। দাদা আপনার মত পজিটিভ মানুষ, এভাবে ভাবছেন কেন? দিল্লী তো ভারতবর্ষের বাইরে নয়। আপনাকে নিয়ে অনেকেই তো লেখালেখি করেছে। আমাকে দিন তো, ওসব দেখি। আমার সহকারী পারুলের সাথে কথা বলে কিছু কাগজ পত্রের জেরক্স জুয়েল নিয়ে গেল।
কয়েকদিনের মধ্যেই জুয়েল স্যার কয়েকপাতা লেখা নিয়ে হাজির। ঝর ঝরে ইংরাজীতে আমার বিভিন্ন পাগলামো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ওর কলমে। নিজের সম্বন্ধে এত সুন্দর ইংরাজী প্রতিবেদন এর আগে আমি কখনও দেখিনি। জুয়েলের উৎসাহকে সম্মান জানাতে পরদিনই ওটা ই-মেল করে দিল্লীতে পাঠিয়ে দিলাম। কিছুদিন পর হঠাৎই সুললিত কন্ঠে ফোন এল I am miss saxsena from Delhi. May I talk to me Dr. Partha pratim পারুল ফোনটা ধরে বলল স্যার দিল্লী থেকে আপনার সাথে কথা বলতে চান। আমিও হ্যালো বললাম। মিস স্যাকসেনা যা বললেন তার অর্থ - আপনি আমাদের ১৫ জনের তালিকায় রয়েছেন। আপনার উপরে যদি কোন প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে তবে তার ক্লিপিংস আমাদের পাঠাতে অনুরোধ রাখছি।
যাইহোক, বিষয়টিতে আমিও কেমন মজা পেয়ে গেলাম। পুরোনো ফাইলপত্র ঘেঁটে পারুল, মামনি, প্রিয়াঙ্কা বিভিন্ন সংবাদ পত্রের ক্লিপিংস একত্রিত করল। দেখলাম, আমার কর্মকান্ড নিয়ে বহু প্রতিবেদনই প্রকাশিত হয়েছে বহু পত্রপত্রিকায়। উত্তরবঙ্গ সংবাদের সাংবাদিক অনুপ সাহা (শীর্ষক- ‘এক আলোর পথযাত্রী স্বপ্নেরফেরিওয়ালা’- ২৯ শে জুন ২০০৩), নাসিরুদ্দীন গাজী (শীর্ষক- ‘উত্তরের বায়োস্কোপওয়ালা ডাঃ পার্থপ্রতিম’- ৪ঠা জানুয়ারী ২০১১), মোস্তাক মোরশেদ হোসেন (শীর্ষক- শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চান ডুয়ার্সের রোগ সারাতে এক ডাক্তারবাবু- ১০ই নভেম্বর ২০১১ তারিখে), শুভজিৎ দত্ত (শীর্ষক- ‘প্রচারে অক্লান্ত চিকিৎসক’- ১৮ই আগষ্ট ২০১৬ তারিখে) বেশ বড়সড় নিবন্ধ লিখেছে। ডুয়ার্স সমাচার পত্রিকার রজত জয়ন্তী বর্ষে শারদীয়া সংখ্যায় শিক্ষক সাংবাদিক সুব্রত রায় সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রবন্ধ লিখেছে ‘এক আলো তারার ফেরিওয়ালা’ শীর্ষক-এ। বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য চিকরাশি পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছে আমার ভাবনা চিন্তা নিয়ে। আনন্দবাজার পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা ৭ই এপ্রিল ২০০৪-এ সুবিশাল নিবন্ধ লিখেছে ‘উত্তরের নায়ক’ শিরোনামে। টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক বিপ্লব বসাক তিনিও তার পত্রিকায় আমায় নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন। যতটা পারা যায় এসব কিছুকে একজায়গায় করে যথাসময়ে মেল করলাম দিল্লীতে।
বেশ কিছুদিন পর আবার ফোন মিস স্যাকসেনার -‘I am Miss Saxsena from Delhi on behalf of Global Society for health & Education Association. Sir are you busy now? বললাম ok. dose not matter, you please proceed. Sir Mr. R.K. Nayar our vice president like to talked with you regarding our in coming onward given ceremony. .’ বললাম ok its my pleasure. অনেক কথা হল মিস্টার নায়ারের সাথে। অন লাইন ইন্টারভিউ নয়; অনেকটা আড্ডার মেজাজে কথা হলো। বাচন ভঙ্গির মধ্যে বেশ বিনয়ীভাব তার ইংরাজী উচ্চারণেও দক্ষিণ ভারতীয় ধাক্কা নেই। কথা বলে ভালো লাগল। মিস্টার নায়ার জানালেন পুরস্কার প্রাপকদের শেষ ৫ জনের তালিকায় আমি রয়েছি। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি হবে দিল্লীর ঐতিহ্যশালী কনস্টিটিউশন ক্লাবে ২২শে নভেম্বর শুক্রবার বেলা ২টায় শুরু হবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন রাজধানীর বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। কনস্টিটিউশন ক্লাবের স্পিকার হলে জায়েন্ট স্কিনে পুরস্কার প্রাপকের উপর একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র দেখানো হবে উপস্থিত দর্শকদের। অনুষ্ঠানটি দু'টি পর্বে হবে। প্রথম পর্বে থাকবে Individual Contribution for Economic & Social Development national Seminar. বিষয়ের উপর একটি জাতীয়স্তরে সেমিনার আর দ্বিতীয় পর্বে থাকবে পুরস্কার প্রদান। দু’টি বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হবে। সামাজিক সেবা মূলক কাজের জন্য দেওয়া হবে Vikas Ratan Award ও সামাজিক ও বিজ্ঞান সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে অসমান্য অবদানের জন্য দেওয়া হবে Bharat Ratan Dr. A.P.J Abdul kalam Gold Star Excellence Award। যে ভিডিওটি জায়েন্ট স্কিনে দেখানো হবে, আমাদের টিম সাধারণত পুরস্কার নমিনেটেডদের কাছে গিয়ে সেটি স্যুট করে। তবে আপনি বহু দূরে রয়েছেন আমাদের পক্ষে এত দূর থেকে চারজনের টিম পাঠানো সম্ভব নয়। আপনি যদি আপনার ওখান থেকে এটা করে পাঠাতে পারেন, তবে খুব ভালো হয়।
আপনার কাজ নিয়ে পাঠানো ভিডিওটিতে সম্ভব হলে স্থানীয় কিছু বিশিষ্ট মানুষের মতামত রাখবেন। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম কৌশিক প্রথম থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কাজে আমায় উৎসাহ দিয়ে চলেছে। কৌশিক পেশায় শিক্ষক; নেশায় অনেক কিছু। উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকা ও সিসিএনের সাংবাদিক একসময় ছবি আঁকার স্কুল চালিয়েছে, সুন্দর আবৃত্তি করে। আঞ্চলিক সিনেমা করে পুরস্কৃত হয়েছে। একসময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানের সঙ্গে নাচত। কৌশিক ও ওর স্ত্রী শ্যামলী ভিডিও এডিটিং-এ বিশেষ দক্ষ। কৌশিককে ভিডিও পাঠানোর বিষয়টি জানাতে ও কোমর বেঁধে লেগে পড়ল। সাংবাদিক রাজেশ প্রধান, রমন কুমার ঝাঁ, শুভজিৎ দত্ত, এরা সবাই বাড়িয়ে দিল সহযোগিতার হাত। ক্যামেরার সামনে আমার বিষয়ে কথা বলার জন্য মাননীয় সাংসদ জন বারলা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। জন ভাই বেশ উৎসাহের সঙ্গে অনেক কথাই বলে ফেললেন। যা আমি করি তা বললেন; যা আমি এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারি নি তাও উদাত্ত কন্ঠে বললেন। প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে অডিওভিসুয়্যাল শো করলেও আমার অনুষ্ঠানের তেমন কোন ভিডিও রেকর্ডিং আমার কাছে ছিল না। দীপাবলীর সন্ধ্যায় সব চা বাগানের মত লক্ষীপাড়াতেও উৎসবের উন্মাদনা, তারই মাঝে জন বারলার বাড়ির পাশের আঙিনায় ডেঙ্গু বিষয়ক অডিওভিসুয়্যাল শো করা হবে বলে ঠিক করা হলো। সেখানেই হবে ভিডিও রেকর্ডিং এর কাজ; ডেঙ্গু বিষয়ক সেই শোর শীর্ষক হবে- ‘‘We are under attack’’।
সেদিন আবার ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। এদিকে সন্ধ্যায় জন বারলার পাড়ায় অডিওভিসুয়্যাল শো হবে। আমার ছোড়দি ও ভাগ্নে ছোটন দিনহাটা থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে যাচ্ছে ভাই প্রলয়প্রতিম এর কাছে; মেটেলিতে। আমারও সপরিবারে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে। জন আবার পরদিনই দিল্লী ফিরে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আর ভাইয়ের বাড়ি যাওয়া হল না। স্টেশনে গেলাম দিদির সাথে দেখা করতে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের জানালা দিয়ে নিরন্ন পাকস্থলীর ছোড়দি কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কি সব বিড়বিড় করে বলে চললো। হয়তো রেলকর্তাদের এই বিষয়টি বেশীক্ষণ সহ্য হলো না। সিগনালের আলোটা সবুজ হয়ে গেল। দিদি চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে তাক্ করে কিছু ধান দূর্বা ছিটিয়ে দিল আমার মাথায়। কূ-কূ ডাক দিয়ে উত্তর পানে চলল রেলগাড়িটি।
ভাই কৌশিক ও ভ্রাতুষ্পুত্র অতীশ অডিও ভিসুয়্যাল শো টি পরিচালনা করলো। বিষয়টি ক্যামেরা বন্দী করল আশীষ ও সন্দীপ। জন বারলার ভাই ভিক্টর বারলা আনুসাঙ্গিক ব্যবস্থা সুন্দরভাবে করেছিলেন।
রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসারে আমি জন বারলার দলীয় অনুগামী নই। তবুও জন ভাই আমার জন্য যা করল তা কোন কৃতজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। জনের পরিস্কার কথা- “ আমি বানারহাট থানা এলাকার প্রথম সাংসদ। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন আমি তাদের সাংসদ তো বটেই, যারা আমাকে ভোট দেননি আমি তাদের স্বীকৃত প্রতিনিধি। দাদা আপনি দিল্লীতে জাতীয় স্তরের পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত হয়েছেন সেটা আমার কাছেও যথেষ্ট গর্বের। রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াই তো চিরদিন ছিল- আছে- থাকবে। তবে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা- ভালোবাসা রাজনীতির আগুনে পুড়বে কেন?”
হ্যাঁ দিল্লীতে পৌঁছানোর পরেও জন ভাই আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন নেতা আমলার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে - ‘হামারা গাঁওকে ডাক্তার দাদা’। উচ্চ আধিকারিকের সাথে পার্লামেন্ট হাউস ঘুরে দেখা, , পার্লামেন্ট ক্যান্টিনে পেটপুরে খাওয়া , , , আরও বহু কিছু। সে সব আলোচনায় পড়ে আসব।
স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তির বিশ্লেষণের কিছু ভিডিও ক্লিপিংস রাখতে অনুরোধ করেছিলেন মিস্টার নায়ার। হাতের কাছেই পেয়ে গেলাম ডুয়ার্সের অভিভাবক শ্রদ্ধেয় রাম অবতার শর্মা -কে। আমার মত আরও অনেকের শ্রদ্ধেয় অগ্রজ। চা শিল্পকে হাতের তালুর মত চেনেন। বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখেছেন, সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি। যে কোন সৃজনশীল কাজে নিজে থেকে দু’পা বাড়িয়ে থাকেন। রাম অবতার দাদা ক্যামেরার সামনে আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তার সুললিত ইংরাজী ও হিন্দী এর আগেও বহু মানুষের মন জয় করেছে।
শেষমেষ আমরা ঠিক করলাম ভিডিওটির ভাষ্য হবে হিন্দিতেই। কিছু কথা বললো তরুন সংঘের সম্পাদক ভ্রাতৃপ্রতিম দীপঙ্কর ঘোষ (রাজা)। কৌশিকের নির্দেশ মত আশীষ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছবি তুললো। এদিকে দিন এগিয়ে আসছে, ভিডিও ভাষ্যের জন্য ডাকলাম প্রভাত খবর পত্রিকার সাংবাদিক রমন কুমার ঝা-কে। সাতসকালে সব কাজ ফেলে ভাই রমন হাজির। তাড়াহুড়োর মধ্যে ভাষ্য রেকর্ডিং হল। পরিচালক কৌশিকের সেটা মন মতো হল না। শিক্ষক ও সাংবাদিক রাজেশ প্রধান আবার ভাষ্য পাঠ করলো। শেষমেষ রাত জেগে ভিডিও সম্পাদনার কাজ শেষ করল কৌশিক। পরদিন তা মেল করে পাঠানো হল দিল্লীতে।
আগেই ওরা জানিয়ে ছিল আমার যাওয়া আসার প্লেন ভাড়া ও দু’রাত্রি- তিন দিন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। যদি পুরস্কার পাই তবে বহুদিন পর দিল্লীতে যাওয়া হবে। ভাবলাম এতদিন পর যখন যাব তখন দু-তিন দিন একটু বেশি সময় নিয়ে যাব। একটু ভালোভাবে দেখব রাজধানী নগরটিকে। কিন্তু এই বাড়তি ৩ দিন থাকব কোথায়?
পুজোর ছুটিতে সাংবাদিক ভাই শুভজিৎ সপরিবারে দিল্লী-আগ্রা-বৃন্দাবন ঘুরে এসেছে। শুভজিৎ বলল- ‘‘দাদা দিল্লীতে যদি থাকতে চাও তবে চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকতে পারো। আমিও ওখানেই ছিলাম। একদম বাঙালী পরিবেশ। রাঁধুনি ফোঁড়ন দিয়ে শুক্তো খেতে চাইলে তাও পাবে। সবার ব্যবহার আন্তরিক, মনে হবে যেন বাড়িতেই আছো। আমি লজ মালিক গৌরাঙ্গ বাবুর নম্বর তোমায় দিচ্ছি। তুমি কথা বলে নিতে পারো।’’
ইতিমধ্যে একদিন মিস্টার নায়ার বললেন - ‘Dr. Partha pratim you are the topest in our selection list’ স্বভাবতঃই কৌতুহল হল প্রশ্ন করলাম What is the cause behind of it ? মিস্টার নায়ার যা বললেন তার বাংলা অর্থ- আপনি যে এলাকায় থেকে কাজ করে চলেছেন তা মহানগর থেকে অনেক দূরে। আদিবাসী অধ্যুষিত পিছিয়ে পড়া এলাকা। তাছাড়া আপনি কোন সরকারী বা বিদেশী অনুদানের পিছনে দৌড়ান না। যা কিছু করছেন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। বর্তমানে বহু NGO হয়েছে যারা আদিবাসীদের সামনে রেখে দেশি বা বিদেশী অনুদানে পকেট ভরে উন্নয়ন ও প্রগতির কথা বলে। অনুদানের টাকায় নিজের ঘর সংসার চালায়। বিলাস বহুল জীবন কাটায়। গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেয়। আপনি সেদিক থেকে আলাদা। আপনি বহু সমাজ সচেতনতামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক বই লিখেছেন কয়েকটি। ইন্টারনেট-এ প্রকাশিত হয়েছে আপনার ই বুক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রশংসিত হয়েছে আপনার কর্মকান্ড। এমন ব্যতিক্রমী মানুষকে আমরা কাছে পেতে চাই।
শুক্রবার দিল্লী থেকে ফোনে ওরা জানিয়েছিল- ভারতরত্ন এপিজে আব্দুল কালাম গোল্ডস্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডের জন্য আমি নির্বাচিত হয়েছি। আমি খবরটা পেয়ে প্রথমে কৌশিককে জানালাম। পরদিন রবিবারে শুভজিৎ দত্ত, রাজেশ প্রধান, রমন কুমার ঝা, নন্দু পড়োয়াল বড়সড় খবর করল। উত্তরবঙ্গ সংবাদ, দৈনিক জাগরণ, প্রভাত খবর, জনপথ সমাচার, হিমালয় দর্পন আরও বিভিন্ন পত্রিকায় ছবি সহ প্রকাশিত হল সেই সংবাদ। আমাদের বানারহাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তনীর সভাপতি শৈবাল দাশগুপ্ত (রানাদা) স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রাক্তনীর গ্রুপে পোষ্ট দিলেন। তারপর আসতে লাগল রাশি রাশি অভিনন্দন, লাইক, ইমোজি আরও সব।
অনুষ্ঠানটি হবে দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ বহু মনীষীর স্মৃতি বিজরিত কনস্টিটিউশন ক্লাবে; শুক্রবার ২২ শে নভেম্বর। শেষমেষ ঠিক করলাম সোমবারেই যাব। সেকথাও জানিয়ে দিলাম মিস্টার নায়ারকে। আরও জানালাম আপনাদের বাড়তি আতিথেয়তার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু বৃহস্পতি ও শুক্র এই দুই রাত আপনাদের কাছে থাকব। শনিবার ফিরে আসব। ফেরার ফ্লাইট দুপুর নাগাদ হলে ভালো হয়। সোমবার ১২টার সময় বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। ফ্লাইটে যাওয়ার সবথেকে বড় ঝামেলা হল প্রায় ঘন্টা দুই আগে গিয়ে রিপোটিং করতে হয়। লাগেজ চেক, বোর্ডিং পাস নেওয়া, সিকিউরিটি চেক এসবেতেই অনেক সময় নষ্ট হয়। তাছাড়া আরও বিভিন্ন কারণে আমি ফ্লাইট-টাকে একটু অপছন্দই করি। যাত্রাপথে পাশে থাকা সহযাত্রীর সাথে তেমন আড্ডা, পরিচয় বা গল্পগুজবের সুযোগ নেই। সবার মধ্যে কেমন যেন নাকউচুঁ, হামবড়া ভাব। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই গ্রামে কেটেছে। তাই আমার একটু গা পড়া স্বভাব। দূর জার্নির ট্রেন হলে গল্প গুজবে করে বেশ মেতে থাকি। প্লেনে সেই সুযোগ নেই।
এক জনের জন্যে গাড়ি নিয়ে বাগডোগরা যাব অনেকটা বাড়তি খরচ। ভাবলাম অহেতুক খরচ বাড়িয়ে লাভ নেই। সোমবার সাতসকালে উঠে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে রওনা হলাম। ট্রেন লেট হলে ফ্লাইট ধরতে দেরি হয়ে যাবে। অনেক সময় দার্জিলিং মোড়ে লম্বা জ্যাম হয়। বানারহাটের ছেলে শিলিগুড়িতে প্রতিষ্ঠিত ভ্রাতৃপ্রতিম দেবাশিষ চক্রবর্তী। দেবাকে বিষয়টি জানাতেই ও বলল দাদা তুমি ভেবো না ও ব্যবস্থা হয়ে যাবে; তুমি ট্রেনে আসতে পারো। আশঙ্কা সত্যি হল। ট্রেন যথারীতি ৪০ মিনিট লেট। শিলিগুড়ি জংশনে পৌঁছে দেখি দেবাশিষ নিজের কাজ ফেলে গাড়ি নিয়ে হাজির। দেরী না করে উঠে বসলাম গাড়িতে। দার্জিলিং মোড়ের পথে না গিয়ে, ওভার ব্রিজ ও মাটিগাড়ার অলিগলি দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাকে পৌঁছে দিল বাগডোগরা এয়ারপোর্টে। লাগেজ চেক, সিকিউরিটি চেক, বোর্ডিং পাস নিয়ে ঢুকে পড়লাম লাউঞ্জে।
সেখানে পরিচয় হল হরিনন্দের সাথে। হরিনন্দজী থাইল্যান্ড, কাঠমান্ডু ঘুরে চলছেন দিল্লীর পথে। যথাসময়ে ল্যান্ড করল Indigo 6E 5061। উঠে পড়লাম ফ্লাইটে। দুপুর ১২:১৮ আমাদের নিয়ে আকাশে ডানা মেলল বিশাল ধাতব পাখিটি। মুহুর্তের মধ্যেই ছোট হতে থাকল আমার সাধের চা বাগিচা, নদীনালা- ঝোরা- বনানী সবকিছু।