‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’ এবং একটি অভয়বাণী; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২০ এপ্রিল ১৯৯৩,মঙ্গলবার; বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত
চারদিকে জলের ছড়াছড়ি। হলদিয়া বন্দর চলে গেছে দুই ফুট জলের তলায়। উত্তর ও দক্ষিণ দুই মেরুপ্রান্তের সব শুভ্র-স্বচ্ছ তুষার গলে তরল। প্রশান্ত মহাসাগরের কিরবাতিতুভাল-চৌঙ্গা ও ভারত মহাসাগরের মালদ্বীপ, বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা সম্পূর্ণ সমুদ্রবক্ষে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবিরাম ঝড়-ঝঞ্ঝা। মারা পড়েছে নাম জানা-না-জানা অসংখ্য পশুপাখি।
না-না, এসব বর্তমান ঘটনার বর্ণনা নয়। ভবিষ্যতের আশঙ্কা মাত্র। হ্যাঁ, বিষয়টি নিয়ে গত এক দশক ধরে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ সোরগোল পড়ে গেছে। পৃথিবীর উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাড়ছে প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকট। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে আবহাওয়াবিদেরা ‘গ্রিন হাউস এফেক্ট’কে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে রয়েছে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস। সূর্য থেকে আসা স্বল্পতরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি এর ভেতর দিয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছায়। কিন্তু এরা পৃথিবী থেকে বিকিরিত তাপকে বাইরে যেতে বাধা দেয়। এই ঘটনাই হচ্ছে গ্রিন হাউস এফেক্ট। গ্রিন হাউস গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড প্রধান। কাঠ, কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন- আগামী শতাব্দীর মাঝামাঝি পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪.৫ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। ফল হিসাবে মরুপ্রান্তের বরফ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৯ থেকে ১.৫ মিটার বৃদ্ধি হবে।
এসব চিন্তাভাবনা করে, ১৯৮৮ সালের ২৭ জুন ৪৮ টি দেশের বিজ্ঞানী ও পরিকল্পনাবিদরা ভয়-ভয় মন নিয়ে কানাডার টরেন্টা শহরে মিলিত হয়েছিলেন, সমাধানের পথ খুঁজতে।
কয়েকদিন আগে ব্রিটেনের বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী প্রফেসর এস ফ্রিড সিংনার কিছুটা খুশির খবর শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলের বাষ্পীভবনের হারও বৃদ্ধি পাবে। কারণ বাষ্পীভবনের হার তাপমাত্রার সাথে সমানুপাতিক। এজন্য আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হবে। মেঘ যে শুধু পৃথিবী থেকে বিকিরিত তাপকে বাধা দেয় তাই নয়। সূর্য থেকে আসা আলোকরশ্মির ৭০ শতাংশ মেঘের দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, পরিবেশে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সেই কারণেই অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড অক্সিজেনে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাপক সিংনার এ ঘটনাকে ‘ন্যাচারাল থার্মোস্ট্যাট বা প্রাকৃতিক তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ আখ্যা দিয়েছেন।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়ারনমেন্টাল প্রোগ্রামের (UNEP) পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করে দেখেছেন- গাণিতিক নিয়ম অনুসারে পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে উত্তাপবৃদ্ধির মাত্রা সে তুলনায় খুবই কম। অবশ্য আর একটি ভাবনার বিষয়, উত্তর গোলার্ধের চেয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বেশি। পৃথিবীর দক্ষিণদিকে বেশিরভাগ অঞ্চল সামুদ্রিক, স্থলভূমি সামান্য। বায়দূষণের উৎপত্তি ও প্রভাব সাধারণভাবে স্থলভাগেই প্রবল। কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির মাত্রা উত্তর গোলার্ধেই বেশি। তাহলে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য গ্রিন হাউস এফেক্ট কতটা দায়ী বা একমাত্র দোষী কি না।
সিংনার ও তাঁর সহকর্মীরা জোর গলায় বলেছেন- ‘গ্লোবাল ওয়ারমিং ফেরিয়া’ বা পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধিতে এতটা আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রকৃতি তার ধর্ম অনুযায়ী বড় রকমের পরিবর্তন প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তাপমাত্রা কখনই এমন বেড়ে যাবে না যে, তা জীবের বসবাসের অযোগ্য হবে। যাক! সিংনার সাহেব কিছুটা অভয়বাণী শোনালেন।