রাম রাম . . .

রাম রাম . . .

রাম রাম . . . -ডাঃ পার্থপ্রতিম।  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
বর্ষা শেষের নীল আকাশ। তাতে মেঘের তুলো ভেলা। ডায়না-রাঙ্গাতি নদীপারের কাশবন জানান দিচ্ছে মা আসছেন। পূজো মানেই হই-হুল্লোড়, নিত্যদিনের রুটিন ভাঙা। আর পেট পুজো? সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে হ্যাঁ, লাগাম ছাড়া ভূরিভোজে পেটের অসুখ, শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়। গা- বমি বমি, চোওয়া- চোওয়া ঢেকুর, ছোটো ঘরটিতে বারবার ছুটে যাওয়া- এসব উপসর্গ পূজোর সব আনন্দকে একেবারে মাটি করে দিতে পারে। তাই খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে একটু বিধিনিষেধ মেনে চললে আখেরে লাভই হয়।
    না-না, আমি ততটা বেরসিক ডাক্তার নই যে এমন দিনে চাওমিন-মোমো-ফ্রিসফ্রাইয়ের কাফেগুলিতে ১৪৪ ধারা লাগিয়ে দেব। ওই যে দূরে, একটু আবডালে, সেগুনতলায় দাঁড়িয়ে প্রিয়তমার সঙ্গে খাও না একটা করে এগরোল। না, মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। রানীনগর বা ঝাজাঙ্গির লাইন হোটেলে- 'তবুও দুজনে কূজনে কূজনে' . . . শাহি পনিরের সঙ্গে আলু পরোটা তেমন কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।
 

   পেটপুজো নিয়ে মনে মনে একটি ছক কষে নিন। এ কদিন বাইরে খাওয়ার কথা থাকলে বাড়িতে কম করে খান। পূজোর ভূরিভোজ সাধারণত সন্ধ্যার পর হয়ে থাকে। রেস্টুরেন্ট- হোটেলে কপোত-কপোতির ভিড় জমে ওঠে। যাঁদের মনের কোণে এই পরিকল্পনা রয়েছে তাঁরা সকাল থেকে একটু সংযমী হন। দেখবেন সন্ধ্যায় জোরালো আমেজ পাবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে অন্তত ৩-৪ গ্লাস জল খেয়ে নিন। লেবু-জল হলে আরো ভালো। তারপর জল মুড়ি বা চিঁড়ে ভেজানো লেবু চিনি দিয়ে হালকা টিফিন করুন। মধ্যাহ্নভোজে একটু মেপে-টেপে খান। খিচুড়ি খেয়ে পেট টইটম্বুর করবেন না। পূজোর দিনগুলিতে পরিমাণ মতো জল খান। শরীরে জলের ঘাটতি হলে দেহের ত্বক জৌলুস হারায়। প্রসাধন বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
    আমাদের সাবেকি বাঙালিখানা খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। তেতো দিয়ে শুরু টক-চাটনিতে শেষ। উচ্ছে, করলা, নিমপাতা এসব তেতো জাতীয় খাবারের ভেতরে যে অ্যালকালয়েড থাকে তা পিত্তথলি থেকে পিত্তরস নিঃসরণে সাহায্য করে। খাবার হজম করার ক্ষেত্রে পিত্তরস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, দেহের অম্ল-ক্ষারের সঠিক  ভারসাম্য রক্ষা করে। শেষ পাতে টক-চাটনি মুখের লালাগ্রন্থি থেকে লালারস  নিঃসরণ ঘটায়। লালারসের টায়ালিন উৎসেচক শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য (ভাত)-কে পরিপাকে সাহায্য করে। এছাড়াও লালা বাইকার্বোনেট ফসফেট ও মিউসিন বাফার হিসেবে কার্যকর থাকে। খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খান। কোনো খাবার যদি অপছন্দের হয় তবে তা খাবেন না। অপছন্দের খাবার সহজে হজম হতে চায় না। কারণ সেই একই, লালাগ্রন্থি গুলি নিষ্ক্রিয় থাকে।
    আনন্দমুখর দিনে বাড়তি যদি ভাজাভুজি খেতেই হয়, তবে তা অল্প তেলে ভাজবেন। এই কাজে ননস্টিক ফ্রাইপ্যান  ব্যবহার করতে পারেন। আমরা যখন খাবার খাই তা গ্রাসনালী বা ইসোফেগাসের মধ্যে দিয়ে পাকস্থলী বা স্টমাকে পৌঁছায়। ইসোফেগাস ও পাকস্থলী বা স্টমাকে পৌঁছায়। ইসোফেগাস ও পাকস্থলির মুখে থাকে একটি দরজা যাকে বলে স্ফিংটার। এই দরজা ঢিলেঢালা হয়ে গেলে পাকস্থলির মধ্যে থাকা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড গ্রাসনালীতে উঠে আসে। মুখ টকে যায়, গলা-বুক জ্বালা করে, বমি বমি লাগে একে আমরা ডাক্তারি ভাষায় গ্যাস্টো ইন্টেস্টিন্যাল রিফ্লাক্স ডিজিজ বলি। যারা একটু মোটা-গোদা, গোলগাল তাদের এই অসুখ বেশি দেখা যায়। এ ধরনের অসুবিধা যাদের আছে তাঁরা ভাজাভুজি একেবারেই এড়িয়ে চলুন।

  পূজোর দিনগুলিতে মনের মাঝে কোনো চাপ বা টেনসন রাখবেন না। হবুবর আদিত্যের সঙ্গে মল্লিকা যদি একটু বেশি ঢলাঢলি করে, তা ভেবে রাতের ঘুম কামাই করার দরকার নেই। তাতে পরিপাকের গোলমাল দেখা দিতে পারে। ঘুমের সঙ্গে হজমের নিবির সম্পর্ক আছে। মেন্টাল স্ট্রেসে মস্তিষ্কের অ্যামিনো অ্যাসিড সিন্থেসিস করার ক্ষমতা কমে আসে। মাছ, মাংস, ডিম সহজে পরিপাক হতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে চাপা টেনসন, ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার দায়ভার মা দুর্গার ওপরেই ছেড়ে দিন। নিজে জাস্ট ফুর্তিতে থাকুন। কোনো কারণে রাত যদি জাগতেই হয় তবে সকালে উঠেই ডাব খান। এরপর এক গ্লাস লেবু জল। এতে ক্লান্তি ও হজমের গোলমাল দূর হবে।
    যাঁরা কিছুদিন আগে ম্যালেরিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জার হাত থেকে ছাড়া পেয়েছেন তাঁদের মুখে অনেক খাবারই বিস্বাদ লাগে। এসব রোগীর পথ্য হবে সুস্বাদু-সুগন্ধি ও সহজপাচ্য।
    আনন্দের মধ্যে যখন তখন আপদ-বিপদ আসতে পারে। আগে থেকে তৈরি থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ। যাঁদের প্রায়ই অম্বল, গলা বুক জ্বালা হয় অবস্থা সামাল দিতে রেনিটিডিন, ম্যাগনেসিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড জাতীয় অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট রাখতে পারেন। বারবার পাতলা পায়খানা হলে প্রথমেই পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়, তার পরিবর্তে এনজাইম গোত্রের ওষুধ খান। গাড়িতে বা নাগরদোলায় চড়লে যাঁদের বমি বমি লাগে তাঁরা ডমপেরিডন, প্রোমিথাজিন খেতে পারেন। অতিরিক্ত হাঁটাচলায় শরীর, হাত-পা ব্যথার কষ্ট লাঘবে ইকোস্পিরিন। সঙ্গে সর্দি, হাঁচি যদি পূজোর খুশিকে মাটি করতে চায়, তবে সেটিরিজন আরাম দেবে। রোদে ঘুরে ঘুরে মাথা ধরলে অ্যাসপিরিন, ইকোস্পিরিন (৭৫/১০০), ডিসপিরিন, প্যারাসিটামল চলতে পারে। এবার পূজোয় আর এক উপসর্গ দেখা দিয়েছে চোখ ওঠা বা কনজাংটিভাইটিস। পরিষ্কার লবণজলে বারবার চোখ ধুলে এ উপসর্গ কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে যায়। তবুও যাঁরা ওষুধ ব্যবহার করতে চান ক্লোর‌্যামফেনিকল বা সালফাসিটামাইড চোখের ড্রপ লাগাতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধের রাসায়নিক গোত্র জানানো হল। বিভিন্ন কোম্পানি বাণিজ্যিক নামে এগুলি বাজারে ছেড়েছে। আর অ্যান্টিসেপটিক অ্যাডেসিভ ব্যান্ডেজ অবশ্যই কাছে রাখুন। গায়ত্রীর পায়ের ফোস্কা থেকে ছোটনের আঙুল কাটা-সবেতেই কাজে লাগবে।
 

    উৎসবের আঙিনায় যাঁরা একটু অন্যরকম মৌতাত নিতে চান-তাঁদের কারণ সেবায় বারণ করার তেমন কোনো কারণ নেই। আর বেশি বারণ শুনছেই বা কে? তবে রয়ে সয়ে। দিনদুপুর বা অধিকরাতে নয়, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই মেহফিল শুরু করুন। বিপিনবাবুর সুধা পানের অন্তত এক ঘন্টা আগে হালকা কিছু খেয়ে নিন। তবে ভাজাভুজি বা এমন কিছু খাবেন না, যাতে গ্যাস অম্বল হতে পারে। টোস্ট, বিস্কুট, শুকনো মুড়ি হলে ভাল। তাড়াহুড়ো নয়। বেশি পরিমাণে জল, সোডা বা কোলা মিশিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিন অমৃতপাত্রে। অডিও সিস্টেমে বাজুক- কেনেজির ব্রেথলেস বা ইয়ানির তাজ। জগজিৎ-চিত্রার গজলও চলতে পারে। শুধু সুরা হলে তো চলবে না, এই শরতে সুরের আমেজও তো চাই। মাত্রাটা দু-তিন পেগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।
    যাঁদের হৃদযন্ত্রের গোলমাল বা উচ্চরক্তচাপ আছে তাঁরা যদি এই আসরে একান্তই বসতে চান, তবে রাম-কে সঙ্গি করতে পারেন (না, দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্রের কথা বলছি না।) আর পকেট পারমিট করলে রেড ওয়াইন খান। এই ওয়াইন আঙুর থেকে তৈরি। আঙুরের খোসার ভেতর থাকে রেসভেরাট্রল নামের জৈব যৌগ। এই রেসভেরাট্রল রক্তের হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বাড়িয়ে ও লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কমিয়ে হৃদয়কে সুরক্ষা দেয়।
    যে কোনো ধরনের অ্যালকোহল রক্তে হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের মাত্রা বাড়িয়ে হার্টকে সবল করে। অন্যদিকে অ্যালকোহল স্নায়ুতন্ত্রের কাজ শিথিল করে বলে ক্লান্তি কেটে যায়, ঘুম ভালো হয়। তবে যে কথাটি আগেও বলেছি-সব কিছু মাত্রার মধ্যে থাকা দরকার। ‘বেয়ারা, চালাও ফোয়ারা তিন এক্স-এরই স্যাম্পেন রা-আ-ম’ এইরকম গাইলে কিন্তু চোখে সরষে ফুল দেখবেন।

Join our mailing list Never miss an update