শোনার লোক পেলে রোগ বিলাস বাড়ে ; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১৮ ডিসেম্বর ২০০৪ উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
টাবুর মা বাবার একমাত্র ছেলে। মাসি- দিদুর নয়নমণি। রাত দশটার সময় টাবুলের ইচ্ছে হল মোমো খাবে। ছোট মামা টিফিন বাক্স হাতে ছুটলেন মোমোওয়ালার বাড়ি। পড়াশোনায় যথারীতি লবডঙ্কা। টিভির কার্টুন চ্যানেলের পোকা। এহেন টাবুলের জ্বর-সর্দি হয়েছে। সারা বাড়ি বিষাদে বিরস। চার-পাঁচজন অভিভাবক পরিবেষ্টিত হয়ে টাবুল ক্লিনিকে হাজির। টাবুলের শারীরিক অসুবিধার কথা বলতে সবাই সরব। পাঁচজনের সমস্বর বাক্ উচ্ছাসে আমার কানমাথা ভোঁ-ভোঁ।
শুধু টাবুল কেন, অনেককেই দেখি পাঁচ-ছ জন আত্মীয়-পরিজন নিয়ে ডাক্তারখানায় হাজির হতে। রোগী যদি খুব অসুস্থ হন বা চলার মতো শক্তি না থাকে তবে অন্য কথা। তা যদি না হয়, তাহলে দলবেঁধে ফুচকা খেতে যাওয়ার মতো ডাক্তারখানায় যাওয়ার কোন মানেই হয় না। রোগীর কষ্ট তাকেই বলতে দিন। তা না হলে বাড়ির যেকোনো একজন কথা বলুন। একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তির কথা শোনা সবার কাছেই বিরক্তিকর। এতে রোগ নির্ণয় সঠিক না হয়ে উল্টোপাল্টা হয়ে যেতে পারে।
কারো কারো মধ্যে দেখতে পাই এক উদ্ভট বাতিক। মনের মধ্যে সবসময় রোগ রোগ ভাব। আমার না বড়ো অসুখ হয়েছে, আমি বোধহয় বেশিদিন বাঁচব না’-এসব কথা পারিপার্শ্বিক লোকদের শোনাতে থাকেন। এই ধরনের বাতিকগুলিকে কখনোই প্রশ্রয় দেবেন না। বেশি সান্তনা দেওয়ার বা বোঝানোর দরকার নেই। আশপাশের সবার উচিত এ বিষয়ে উদাসীন থাকা। মনোবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, শোনার লোক কাছে পেলে রোগবিলাস বেড়ে যায়।
অনেকে আবার বড়ো বড়ো রোগের নাম শুনতে ভালোবাসেন। ঘটনাটি প্রফেসর দাশগুপ্তের কাছে শোনা। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তখনো মুখ্যমন্ত্রী হননি। চিকিৎসক হিসাবে তাঁর বিরাট নামডাক। অধ্যাপকের তখন ছোকরা বয়স, ডাঃ রায়ের অধীনে কাজ করছেন। একদিন দুপুরে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা গাড়িতে মেয়েকে বসিয়ে রেখে ডাঃ রায়ের চেম্বারে হাজির। সে সময়ে বিধান রায় চেম্বারে ছিলেন না। ওদিকে ভদ্রমহিলার চোদ্দ বছরের মেয়ে কানের ব্যাথায় অস্থির। হতাশ হয়ে ডাঃ দাশগুপ্তকেই বললেন একটু দেখে যাওয়ার জন্য। অধ্যাপক দাশগুপ্ত দেখেশুনে বললেন, তেমন কিছু নয়, কানে একটা ফোঁড়া হয়েছে।’ ওষুধ দিয়ে বললেন, তিনদিন পর আবার আসবেন দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।’ সেদিন সন্ধ্যাতেই আবার ভদ্রমহিলা চেম্বারে হাজির। মেয়েটা কিছুটা শান্ত। তখন বিধান রায় ক্লিনিকে উপস্থিত। ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ‘ডাঃ রায় দুপুরে আমি এসেছিলাম, আপনি ছিলেন না, উনি ছিলেন। উনি তো বললেন বেবির কানে নাকি ফোঁড়া হয়েছে। আপনি একটু দেখুন না।’ বিধান রায় সব দেখে শুনে বললেন, এতো খুব বড়ো অসুখ। ওটাইটিস ডিউ টু ফ্রাঙ্ককিউলোসিস।’ নতুন করে ওষুধ লিখে দিলেন। পরে বিধান রায় ডাঃ দাশগুপ্তকে ডেকে বললেন, এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ডাক্তার হবে? মনে রাখবে বড়োলোকদের ফোঁড়া-পাঁচড়া এসব একদম বলতে নেই।’ আসলে ফোঁড়া থেকে কানে ব্যাথা হলে ডাক্তারি ভাষায় আমরা তাকে ওটাইটিস ডিউ টু ফ্রাঙ্ককিউলোসিস বলি।’ হায় এদের কে বোঝাবে? কোনো বড়ো রোগ হওয়া গর্বের বিষয় হতে পারে না। বরঞ্চ আপনি সুস্থ, সবল নীরোগ দেহের অধিকারী এটাই আপনার গর্ব করার মতো বিষয় যে। হ্যাঁ, এই বড়ো বড়ো রোগের নাম শোনার প্রবণতা এখনো অনেকের মধ্যে দেখতে পাই। বিশেষত উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে এটা খুবই প্রকট। যখন বলি, রুবি দেবী আপনার এটা বাতের ব্যথাই মনে হচ্ছে,‘শুনে মুখটা কেমন ব্যাজার করেন। আবার যখন বলি, আপনার রিউম্যাটয়েড অর্থারাইটিস হয়েছে, বেশ খুশি খুশি ভাব। পাড়াপড়শি, আত্মীয়-পরিজনদের কাছে বড়ো মুখ করে বলার মতো রোগ যে!
এখন তো অনেক কথা শোনা যায়। ডাক্তারবাবুরা অসৎ, দুনীর্তিগ্রস্ত, তাঁদের সবসময় টু-পাইস ইনকামের ধান্ধা। প্যাথলজিক্যাল ল্যাব থেকে কমিশন খান। এখান থেকে, ওখান থেকে বহু জায়গা খেতেই পান, খান। তাই অপ্রয়োজনেও হেনতেন পরীক্ষা করান।
মন্ত্রী থেকে শুরু করে সিকি নেতা সবাই সুযোগ পেলেই হল, গলা ছেড়ে গাল পারেন ডাক্তারদের। আবার এমনো দেখি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট না করালে অনেক পেসেন্ট মনঃক্ষুন্ন হন। যেমন সেঁজুতি সাহা তাঁর আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন। সর্দি-কাশি-জ্বর, যথারীতি ভাইরাল ইনফেকশন। ওষুধ খেলে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি সেরে যায়। না খেলে পুরো সাত দিন লাগে সারতে। সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে নিষেধ-বারণ জানিয়ে দিলাম। মন ভরল না। মায়ের আকূল উৎকন্ঠা, ‘ডাক্তারবাবু রক্ত পরীক্ষা করতে হবে না? বললাম, ‘অহেতুক খরচা করে, সূচ ফুটিয়ে লাভ কী? তৎক্ষণাৎ উত্তর, ‘না, না, আপনি খরচের কথা ভাববেন না।’
কত আর বোঝানো যায়! রক্তের টিসি-ডিসি, স্টুল, আর ই এইসব পরীক্ষা লিখে দিলাম। পরদিন প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট দেখে কয়েকটি জেনারেল টনিক প্রেসক্রাইব করলাম। ভাইরাল ফিভার তো ওষুধ ছাড়া আপনিই ঠিক হয়ে যায়, ঠিক তেমনটিই হল। বাড়ির সবাই আহ্লাদে আটখানা।
যে কথাটা বলছিলাম। অনেক রোগী বা তার পরিজনই মনে করেন, দামি দামি টনিক খেলেই চেহারা ফিরে যাবে, তাই যদি হত তবে দেশের সব পয়সাওয়ালা পুরুষরা ঋত্বিক, সলমন এবং মহিলারা প্রীতিজিন্টা, মাধুরী দীক্ষিত হয়ে যেতেন। আপনি ভাবলেন- ভিটামিন টনিক খাচ্ছি তাই একটু বল পাচ্ছি। এই মনোবলই আপনার শক্তির জোগানদার। সত্য কথা বলতে কি টনিক খেয়ে যতটা না রোগীর লাভ হয় তার চেয়েও বেশি লাভ হয় টনিক প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতাদের।
শৈশবের কথা মনে পড়ে। জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই বোন নিয়ে বড়োসড়ো একান্নবর্তী পরিবার। আশি পার করা ঠামমা ছিলেন পরিবারের মাথা। তাঁর কোলে পিঠেই দশজন বাচ্চা-কাচ্চা বড় হয়ে গেছি। মা-বাবার ফুসরত ছিল না আমাদের প্রতি স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়ার। এখন অবস্থা অন্যরকম। মা-বাবার সবেধন নীলমণি ডমি। ডমির বাবা তার বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে ফ্ল্যাট কিনছেন। মার কমান্ডো দৃষ্টি সদাসর্বদা ডমির দিকে। মাসে প্রায় দশ-বারোদিন ক্লিনিকে এসে হাজির হন তিনি। বলতে থাকেন, ‘ডাক্তারবাবু আজ না ডমির তিন-তিনবার হাঁচি হয়েছে। গতকাল চার-পাঁচবার কাশি হয়েছিল।’
হ্যাঁ, এসব নিয়ে ভাবার কোন কারণই নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে বেশিরভাগ অসুখ আপনাআপনিই সেরে যায়। আমাদের দেহের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলি ইমিউনিটি সিস্টেম। অকারণে বা অল্পকারণে বেশি বেশি ওষুধ খেলে ইমিউনিটি সিস্টেস বিগড়ে যেতে পারে।
আজ বিশ্বের বেশিরভাগ চিকিৎসা বিজ্ঞানী একমত, অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা নষ্ট হতে চলেছে। আমরা দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছি যমদুয়ারের অভিমুখে।