ব্যাধির নাম সোরিয়াসিস
-ডাঃ পার্থপ্রতিম। উত্তরবঙ্গ সংবাদ এ সুস্থু থাকুন বিভাগে প্রকাশিত।
প্রথমে মাথার কিছু কিছু জায়গায় চামড়াটা কেমন মোটা মোটা মনে হতে লাগলো। ভাবলাম খুসকি হয়েছে। তারপর কনুই, পা ও দেহের বিভিন্ন জায়গায় লাল উঁচু মতো দেখায়, ঢাকা থাকে আঁশে। প্রথমে তেমন গা করিনি। পরে অনেক ডাক্তার, ওষুধ, মলম, টোটকা করলাম কোনোটাতেই তেমন ফল হল না। হ্যাঁ এভাবেই শুরু, বলছিলেন সেঁজুতি সাহা।
প্রথম দর্শনেই চিনতে ভুল হল না রোগটি-সোরিয়াসিস। ত্বকের যতরকম রোগ ব্যাধি আছে তার মধ্যে এটাকে সারিয়ে তোলাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন। গ্রিক শব্দ সোরা মানে চুলকানি। সেখান থেকেই এসেছে সোরিয়াসিস কথাটি। তবে এ রোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুলকানির তেমন উপসর্গ থাকে না। যে কোনো বয়সেই রোগটি হতে পারে। বিশেষত যৌবনে পা দেওয়ার সময় এটি শুরু হতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগটি কমে গিয়ে কয়েক বছর পর আবার ফিরে আসে।
ডার্মাটোলজিস্ট বা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়া এই ব্যাধির প্রকৃত কারণ কে বা কোন্ ধরনের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। এ রোগের পিছনে এখনো জীবাণু তারও হদিস পাওয়া যায়নি। অ্যালার্জি বা পুষ্টির ঘাটতি থেকে এ রোগ হয় না। অসুখটা ছোঁয়াচে নয়। তবে বংশগত কোনো প্রভাব এ রোগে আছে কিনা তাও জানা যায়নি।
সোরিয়াসিস ব্যাপারটা ঠিকমতো বোঝার আগে আসুন আমাদের ত্বকের গঠনটা ভালোভাবে জেনে নিই।
আমাদের ত্বকে প্রধানত তিনটি স্তর থাকে। বাইরের স্তরটির নাম এপিডার্মিস। এই স্তরটি ছোটো ছোটো চ্যাপ্টা কোষ দিয়ে তৈরি কাগজের মতো পাতলা। এখানে কোন রক্তনালী বা জালক থাকে না। ডার্মিস থাকে এপিডার্মিসের নীচে। রক্তজালক, ঘামের গ্রন্থি, স্নায়ুপ্রান্ত, রোমের গোড়া, অনৈচ্ছিক পেশি- এসব কিছুই এখানে থাকে। ত্বক বলতে এই ডার্মিসকেই বোঝায়। একদম ভেতরে রয়েছে সাবকিউটেনিয়াস স্তর। চর্বি জাতীয় পদার্থ থাকে বলে এটি নরম গদির মতো।
বহিঃত্বক বা এপিডার্মিসের মধ্যেও আবার বিভিন্ন উপস্তর রয়েছে। সবচেয়ে বাইরে বাইরে থাকে স্ট্রাটাম কর্নিয়াম। এটি মূলত মৃত কোষ দিয়ে গঠিত। মৃতকোষ কেরাটিন নামের এক জটিল প্রোটিন থাকে। এ স্তর কতটা মোটা বা পাতলা হবে তা নির্ভর করে দেহের কোথায় আছে তার ওপর। যেমন- হাতের তালুতে এবং পায়ের পাতায় সবচেয়ে মোটা হয়।
স্ট্রাটাম কর্নিয়ামের নীচেই রয়েছে স্ট্রাটাম জার্মেনেটিভাম। এটি বহিঃত্বক বা এপিডার্মিসের সক্রিয় অংশ। মাতৃকোষ বা মাদার সেল থাকে এখানেই, যা ক্রমাগত নতুন কোষ তৈরি করে তাকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। নতুন কোষের আয়ু ২১ থেকে ২৮ দিন। কোষ মরে যাওয়ার পর দেহের বাইরে থেকে ঝরে পড়ে। তবে কোষের মৃতদেহ আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। এরা আণুবীক্ষণিক।
আমরা যখন গায়ে সাবান মাখি তখন লক্ষ লক্ষ মৃত কোষ ময়লার সঙ্গে মিশে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। সোরিয়াসিসের বাড়ি-ঘর এই স্ট্র্যাটাম জার্মেনেটিভাম। স্বাভাবিকভাবে একটি বুনিয়াদি কোষের আয়ু তিন থেকে চার সপ্তাহ। কিন্তু সোরিয়াসিস হলে তা কমে আসে। কোষগুলি খুব তাড়াতাড়ি মরতে থাকে আর আঁশের মতো ঝরে পড়ে। এসময়ে কেরোটিন সংশ্লেষণের গোলযোগ দেখা দেয়। এটাই এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
দেহের যে কোনো স্থানেই এ ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। তবে কনুই, হাঁটু এবং মাথার চামড়ার বেশি দেখা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে সারা শরীর জুড়েই এই অসুখ ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে যেহেতু ত্বকে তেমন কেনো গভীর ক্ষত তৈরি হয় না বা কোনো অবস্থাতে পুঁজও জমে না, রোগী তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবেই করতে পারেন। তবে রোগ পুরোনো হলে, বিশেষত গরম ও বর্ষায় গা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
সেরিয়াসিস পুরোপুরি সারানো কঠিন হলেও বিভিন্ন চিকিৎসায় একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ও আলকাতরাযুক্ত মলম পাওয়া যায়। খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ার আগে এ মলম ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এছাড়া ইমোলিয়েন্ট, ডায়াভোনেক্স, অ্যামাইনো বেনজোইক অ্যাসিড মলম, ইউরিয়া ও কোলটার মলম। এইসব মলম ব্যবহারের আগে দেহের কোনো এক জায়গায় দিন সাতেক লাগিয়ে দেখতে হবে যে অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া বা অ্যালার্জি হচ্ছে কিনা। যদি তেমন কোনো অসুবিধা না হয় তবে শরীরের যে সব স্থানে সোরিয়াসিস হয়েছে সেখানে সেখানে লাগাবেন। কর্টিকা স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম লোশনও একইভাবে লাগানো যায়। অনেক ডাক্তারবাবু রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশনও দেন। সোরালেন, সাইক্লোপোরিন, রেটিনয়েড, মেথোট্রেক্সেট এবং এট্রিটিনেট নামের ওষুধ ব্যবহারে সোরিয়াসিসের দারুণ ফল পাওয়া গেছে। তবে এগুলির যথেষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চর্মরোগের কোনো ওষুধ ব্যবহার করা একদমই উচিত নয়।
আয়ুবের্দিকে চালমুগড়া ও গর্জনতেল মালিশে কিছুটা উপকার হয়ে থাকে। যদিও খাবারের সঙ্গে এ রোগের তেমন কোনো সম্পর্ক সঠিকভাবে জানা যায়নি, তবুও সোরিয়াসিসের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন তাঁরা রেডমিট, ডিম, মাখন, পনির, মাছ, দুধ কয়েক মাস না খেয়ে দেখুন। উপকার পেলেও পেতে পারেন। অতিবেগুনি রশ্নি বা আলট্রা ভায়ালেট রে দিয়েও কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া গেছে। উন্মুক্ত সূর্যের আলো মোটামুটিভাবে সব ধরনের চর্মরোগর পক্ষেই উপকারী। তাই সম্ভব হলে প্রতিদিন কিছুটা সময় খালি গায়ে রোদে বসে থাকুন।
হোমিওপ্যাথিতে এ রোগের চিকিৎসায় বেশ ভালো ফল পাওয়া গেছে। হোমিওপ্যাথি মূলত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা। রোগীর বয়স, চেহারা, রোগ হ্রাস-বৃদ্ধির সময় রোগীর মানসিক পরিস্থিতি এইসব কিছু বিচার করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়।
মোটা, থলথলে, ফর্সা, চেহারা রোগীর যদি কোষ্ঠবদ্ধতা থাকে তবে গ্রাফাইটিস প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকরী। রোগী খুব শীতকাতুরে, বিমর্ষ হলে সেরিনাম দেওয়া যেতে পারে। যাঁরা বেশি মানসিক উৎকণ্ঠা, অস্থিরতার শিকার, শুকনো বড়ো বড়ো আঁশের মতো ত্বক গা থেকে খসে পড়ে, নীচের নরম লাল চামড়া বেরিয়ে আসে, তাদের আর্সেনিকাম আয়োডাম দেওয়া হয়। রোগ পুরোনো হয়ে গেলে সালফার ও থুজা দেওয়া হয়। এইভাবে রোগের লক্ষণ অনুসারে রাস টক্স, পেট্রোলিয়াম, মার্কুরিয়াস সাল, হাইড্রোকোটাইল- এসব প্রয়োগ করা যেতে পারে। শরীরের বাইরে অ্যাসিড ক্রাইসোফেনিক ও গ্রাফাইটিস মলম দিয়ে ভালো ফল পেয়েছি। এই ওষুধ দুটিকে মাদার টিনচার নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়েও লাগানো যায়।
সোরিয়াসিসের চিকিৎসায় ওষুধগুলির ৫০ মিলিসিমাল পোটেন্সি বা ৫০ হাজার মাত্রিক মাত্রা প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। তবে সঠিক মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ করার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার।
ফের বলছি, এ রোগে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করতে হয়। তাই রোগীকেও ধৈর্যের পরীক্ষায় পাস করতে হবে। ঘন ঘন ডাক্তার বদলাবেন না। ক্ষতি হবে। হাস্যকর এবং দুঃখদায়ক এটাই যে স্বাধীনতার ৫৭ বছর পরেও এদেশে অনেকে সোরিয়াসিসকে ছোঁয়াচে ভাবেন। পরিজনরা এসব রোগীকে এড়িয়ে চলেন। দীর্ঘদিন ভুগতে ভুগতে রোগী অনেকসময় হতাশা ও মানসিক অবসাদের শিকার হন। এ অবস্থা কাটাতে সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। রোগীকে বোঝাতে হবে- দুঃখ, বেদনা, হতাশা শেষ কথা হতে পারে না।