কারণ সেবায় বারণ কেন?

কারণ সেবায় বারণ কেন?

কারণ সেবায় বারণ কেন? ডাঃ পার্থপ্রতিম; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত

মাঝে মধ্যে নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে হাতে তুলে নিতেই পারেন পানপাত্র, দুটো পেয়ালার দুবার। যদি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় মদ্যপান করেন তবে জরা-ব্যাধির চাবিকাঠি অনেকটাই আপনার হাতের মুঠোয় এসে যাবে। মৃত্যু দরজায় কড়া নাড়লে, আপনি তাকে মুখের উপর বলে দিতে পারবেন, পরে এসো ভাই। এমনটি  বলছেন নামজাদা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা
    অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষক টিড্ডা গোল্ডফিংগার এক মজার প্রতিযোগিতা করেছেন। মেমোরি কুইজ। কার কত স্মৃতিশক্তি তারই পরীক্ষা নিরীক্ষা। প্রতিযোগীদের শিক্ষার মান, সামাজিক মর্যাদা এসব একই রকম রেখে দুটি দলে ভাগ করেন। একদল হল, যাঁরা নিয়মিত মদ্যপান করেন। অন্যদল, যাঁরা ওপথ মাড়ানই না। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নিয়মিত মদ্যপায়ীদের স্মৃতিশক্তি অনেক সবল।
    আমাদের দেহের বিভিন্ন রক্তনালির মধ্যে লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এল ডি এল জাতীয় কোলেস্টেরল জমা হয়। ফলে ধমনির ভেতরটা সংকুচিত হয়ে যায়, রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। এই অসুবিধা আমরা স্বাভাবিকভাবে টের পাই না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। হার্ট অ্যাটাক, সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস, সেরিব্রাল হেমোরেজ এবং আরও বহু বিপদ ডেকে আনে এই অ্যাথেরোসক্লোরোসিস। মদে বেশি পরিমাণে হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন তথা এইচ.ডি.এল রক্তনালির সরু হয়ে যাওয়াকে প্রতিহত করে। সে কারণে মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা অসংখ্য রক্তনালির মধ্যে দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের হার বেড়ে যায়। শরীরের মোট অক্সিজেন চাহিদার এক চতুর্থাংশ খরচ হয় মস্তিষ্কে। আর কোষে অক্সিজেন পোঁছানোর কাজ করে রক্ত সংবহনতন্ত্র। মগজে রক্তপ্রবাহ বাড়লে তরতাজা হয়ে ওঠে গ্রে ম্যাটার। যা কিনা স্মৃতি-বোধ-বুদ্ধির অন্যতম কারখানা। শুধু স্মৃতি-বুদ্ধি বাড়াতে নয়। নিয়মিত সুরাপানের আরও অনেক সুফল রয়েছে। দেহের অতিরিক্ত ক্যালোরি খরচ করতে মদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় পেগটিতে শেষ চুমুক দেওয়ার পর নব্বই মিনিট পর্যন্ত দেহের ক্যালোরি খরচ হতে থাকে। সে কারণে মদ্যপানের পর আপনার ঠান্ডা বা শীত অনুভূতি কমে। রাম, হুইস্কি, ব্রান্ডিই নয়, বিয়ারের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। সমীক্ষা থেকে জানা গেছে- যাঁরা নিয়মিত পান করেন, বিপিনবাবুর কারণ সুধা-র কৃপায় তাঁদের পেটে চর্বি তথা অ্যাবডেমিনাল ফ্যাট তুলনামূলকভাবে কম জমে।

    ব্রিটিশ গবেষকেরা দেখেছেন মেপে মেপে মদ্যপান করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ ইমিউনিটি পাওয়ার বেড়ে যায়। বিশেষত, হিলিকোব্যাকটার পাইলোরি সংক্রমণের  সম্ভাবনা অনেক কমে। এই জীবাণুটি গ্যাসট্রিক আলসার ও স্টমাক ক্যানসার সহ আরও বহু রোগের কারণ। মদ্যপানে ফুড পয়জনিং তথা খাদ্যের মাধ্যমে ঢোকা বিষের আক্রমণ থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়। পানীয় জলে থাকা সালমোনেল্লা জীবাণু মদের সংস্পর্শে মারা যায়। টাইফয়েড ছড়াতে সালমোনেল্লা বড়োই পটু।
    শুধু পুরুষরাই কেন ? মদ্যপানে লাভবান হন মহিলারাও। একটু বেশিই। বিশেষত, ওভারিয়ান ক্যানসার আক্রমণের আশংকা কমে। মদের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও ফাইটোইস্ট্রোজেন থাকার কারণে অনেক ধরনের ক্যানসারের সম্ভাবনা পঞ্চাশ শতাংশ কমে যায়। ইউনির্ভাসিটি অফ মিশিগানের গবেষকেরা ক্যানসার আক্রান্ত কোষের উপর রেড ওয়াইন প্রয়োগ করে দেখেছেন আক্রান্ত কোষগুলি অতি দ্রুত ধ্বংস হয় ও দেহের অন্য সকল অংশে ছড়াতে পারে না। ইতালি ও ফ্রান্সে প্রতি দশজন সুরার খদ্দেরের মধ্যে ছয়জনই মহিলা। এই দুই দেশে ডিম্বাশয়ের ক্যানসার-এ আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
    বার্ধক্যে বা রজঃবন্ধ হওয়ার পর মহিলাদের দেহে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয়। ফলে দেহের হাড়গুলি ক্ষয়প্রাপ্ত ও ভঙ্গুর হতে থাকে। মদ্যপায়ী মহিলাদের রক্তে ইস্ট্রোজেন বেশি থাকায় এই সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। যদি মনে রাখতে হবে বেশি মদ্যপানে কিন্তু ক্যালসিয়াম হু হু করে বেরিয়ে যেতে থাকে। মাত্রা বেশি হলে অ্যালকোহল এই ক্ষতিটা করবেই।
    হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের একদল গবেষক দশ বছর ধরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন টাইপ টু ডায়াবেটিসের আশংকা সুরাপায়ীদের ক্ষেত্রে বেশ কমে যায়। এর সঠিক কারণ তেমভাবে জানা না গেলেও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, রক্তে ইনসুলিন প্রতিরোধ কমে আসে বলে এমনটি হয়ে থাকে।
    কীভাবে আপনি মদ্যপান করছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আকণ্ঠ কারণবারি গেলে যাঁরা ঠাকুর ভাসানের নাচ নাচতে থাকেন, তাঁদের জন্য এইসব পরামর্শ নয়। মদ হা-ভাতের মতো ঢকঢক করে গিললে চলবে না। কারণ মদ না মেটায় জ্বালা না মেটায় ক্ষুধা। পানাহার করতে হবে ধীরে সুস্থে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সূর্যাস্তের আগে মেহফিল না বসানোই ভালো। খালি পেটে মদিরাপান নৈব নৈব চ। ড্রিংকসের টেবিলে ভাজাভুজিও না। মর্কটকুলের মতো বেশি করে শশা, গাজর না চিবানোই ভালো। পেট যদি খালি থাকে তবে সুরাপানের অন্তত আধঘন্টা আগে শুকনো টোস্ট খেয়ে নিতে পারেন। রক্তের কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে থাকে তবে টোস্টে মাখনও লাগাতে পারেন। হাফ বয়েলড অর্থাৎ আধসেদ্ধ ডিমও চলতে পারে। বন্ধু বান্ধবের কাছে কেতা নেওয়ার জন্য কখনই জল ছাড়া মদ খাবেন না। হুইস্কি হলে বেশি করে সোজা মেশাবেন, আর রাম হলে কোলা। ডিনারের ঘন্টা দুয়েক আগে পানপাত্রে চুমুক দিতে শুরু করুন। পান শেষ হওয়ার পনেরো মিনিট থেকে আধ ঘন্টা পর রাতের খাবার খান।

    শুধু শারীরিক কারণে নয়, মানসিক চাপ কমাতে, মনকে  ফুরফুরে তরতাজা করে তুলতে মদের জুড়ি মেলা ভার। অ্যালকোহল স্নায়ুতন্ত্রের কাজ শিথিল করে বলে ঘুম ভালো হয়। ঘুম ভালো হওয়াটা সব ক্ষেত্রেই জরুরি। এই অবসরে বঙ্গবধূদের কানে কানে একটা কথা বলে দিই। যদি বুঝতে পারেন কর্তা বাইরে থেকে অতিরিক্ত মদ গিলে রাতে বাড়ি ফিরছেন তবে চেঁচামিচি, তিরস্কার করতে শুরু করবেন না। বরং ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করুন। পরদিন ধীরে সুস্থে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করুন। বাড়িতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় পানাহারের ব্যবস্থা করুন। গোপনে মদ ছাড়ান- এমন বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবেন না।
    সুরার সঙ্গে সুরের সম্পর্ক আদি ও অকৃত্রিম। সে রাজা- বাদশা থেকে শুরু করে আমার পাড়ার কানু মাতাল-সবাই এ সময় সংগীত রসিক হয়ে পড়ে। ঝিন চাক্, লারে লাপ্পা নয়। মনকে হালকা করতে ধীর লয়ে গান শুনুন। রামকুমারের টপ্পা বা শচীন কর্তার  পুরাতনি শুনতে যদি ভালো না লাগে, তবে কেনেজির ব্রেথলেস শুনতে পারেন। নিম্নগ্রামে গোলাম আলির গজল চলতে পারে। যদি পার্টিতে যান তবে সুরা পানের পর হালকা বিষয়ে নিয়ে খোশগল্প করুন। একটু আধটু অ্যাডাল্ট জোকস মন্দ নয়। পি.এন.পি.সি-তে না যাওয়াই ভালো সবরকম বিতর্ক এড়িয়ে চলুন। মদ্যপানের পর কোনওরকম হীনমন্যতাকে প্রশ্রয় দেবেন না। মদ খাওয়া অপরাধ নয়, মাতলামি করাটা অবশ্যই অপরাধ। মদ্যপানে আপনার কিছু অর্থ নষ্ট হলেও হতে পারে, তবে কোনভাবেই চরিত্র নষ্ট হয় না। তাই যদি হতো তবে সোমরসপায়ী ঋষিমুনি প্রপিতামহদের চরিত্র বলে কিছু থাকত না। মাত্রাতিরিক্ত খেলে ক্ষতি হয়- এ যুক্তিতে কারণবারি থেকে নিজেকে দূরে রাখার কোন মানে হয়? এই দুনিয়ার সকল খাদ্য অখাদ্যের ক্ষেত্রেই তো কথাটি প্রযোজ্য। মহামতি চাণক্য তো বহুদিন আগেই বলেছেন- অতিদর্পে হতা লঙ্কা, অভিমানে চ কৌরবাঃ। অতিদানে বলির্বন্ধঃ, সর্বমত্যন্ত গহির্তম।।
    বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এক বোতল শ্যাম্পেন চার কোটি নম্বই লক্ষ বুদবুদের সমষ্টি। এই পৃথিবীতে মিশরের মানুষদের মদ্যাসক্তি সবচেয়ে কম। মাথাপিছু মদ্যপানের হার, বছরে গড়ে দু টেবিল চামচ! মদে ৮৬ শতাংশ জল থাকে। অ্যালকোহল থাকে ১১.২ শতাংশ। অন্যান্য উপাদান ২.৮ শতাংশ। এই অন্যান্য উপাদানের সংখ্যা আড়াইশোরও বেশি। ভর্তি গ্লাস অর্ধেক। আবার তাকান ঠিক একই রকম মনে হচ্ছে কি? আর এক ফোঁটাও নয়, থামান মদ্যপান। খেয়াল করুন, পঙ্কজ উদাস গাইছেন, হুই মাহেঙ্গি বহুত/ থোরি থোরি পিয়া করো/ পিয়ো লেকিন রাখখো হিসাব/ থোরি থোরি পিয়া করো...    

 

Join our mailing list Never miss an update