“ রেলপথে ডুয়ার্স ভ্রমণ ”

“ রেলপথে ডুয়ার্স ভ্রমণ ”

“ রেলপথে ডুয়ার্স ভ্রমণ ”-ডাঃ পার্থপ্রতিম।জলপাইগুড়ি জেলা সার্ধশতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ (১৮৬৯-২০১৯) -এ প্রকাশিত প্রবন্ধ।

অরণ্য-বনানী- পাহাড়ের কোল ঘেসে এগিয়ে চলা ডুয়ার্সের রেলপথ; ভ্রমণ পিপাসুদের রসাস্বাদনের অন্যতম আকর্ষণ। ডুয়ার্সের রেলপথ বলতে পশ্চিম ডুয়ার্সের শিলিগুড়ি জংশন থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন পর্যন্ত রেলপথকেই বোঝায়। এন.জে.পি থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন ১৬৮ কিমি দীর্ঘ এই রেলপথে বর্তমানে ২৩ টি স্টেশন রয়েছে। নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে শিলিগুড়ি টাউন, শিলিগুড়ি জংশন হয়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশন পর্যন্ত যায়। কিছু ট্রেন আবার আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে নিউ আলিপুর হয়ে আসাম গামী। আবার কয়েকটি ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে আলিপুরদুয়ার কোর্ট, বানেশ্বর, নিউকোচবিহার- কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশ লাগোয়া বামনহাটে পৌঁছে যায়।

শিলিগুড়ি জংশন থেকে গুলমাতে আসা রেলপথটি নয়নাভিরাম দৃশ্য মেদুর। শিলিগুড়ি নগরের সীমানা ছাড়ালে মোহরগাঁও গুলমা চা বাগানের বুক চিরে দু’পাশে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের গালিচা পথ পেরিয়ে চলে আসে গুলমা স্টেশন। মহানন্দা নদীর ধারে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে গুলমা। স্টেশনের অন্যতম আকর্ষণ ফুলে ফুলে ছাওয়া গুলমা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম। স্টেশন থেকে দূরে তাকালেই দেখা যায় মহানন্দা অভয়ারণ্যের সীমারেখা। যতদূর চোখ যায় সবুজে শ্যামল চাষ জমি। ধানের পাশাপাশি এখানে মারুয়া ও ভুট্টার চাষ হয়। অশ্বশালার জন্য গুলমার বেশ নাম রয়েছে ।

ঘোড়া কেনাবেচার জন্য অনেকেই গুলমাতে যায়। যদিও বর্তমানে টু-হুইলারের দাপটে ঘোড়ার ব্যবধান কমে এসেছে। তবুও বেশ কিছু সৌখিন মানুষ ও কিছু গ্রামীণ পণ্য পরিবহন ব্যবসায়ী এখনো গুলমার অশ্বশালায় ভিড় জমান। গুলমাতে বেশ কয়েকটি হোম-স্টে রয়েছে। যাদের আতিথেয়তা বেশ ভালো। গুলমাতে এক রাত্রি থেকে আশেপাশের বন জঙ্গলে, নদীপাড়ে ঘুরলে সবুজের ছোঁয়ায় মনটাও সবুজ হয়ে যায়।
গুলমার পরবর্তী স্টেশন সেবক। গুলমা থেকে সেবকের রেলপথের দূরত্ব ১২ কিমি। পুরো পথটাই মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুক চিরে গিয়েছে। চোখ-কান খোলা রাখলে রেলযাত্রীরা দেখা পেতে পারেন বুনো হাতি, হরিণ, বাইসন, বানর ও অগন্তি ময়ূরের। সেবক রেলস্টেশনটি একেবারেই পাহাড়ের কোল ঘেষে। স্টেশনের অদূরেই তিস্তা নদী। সেবক স্টেশনে নেমে পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায় সেবক কালীবাড়ি ও বাঘপুল। তিস্তার উপরে অনন্যগঠন শৈলীতে ভরা করনেশন ব্রিজ। ১৯৩৭ সালে এটি তৈরী করা শুরু হয় এবং নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৪১ সালে। ইংরেজ যুবরাজ ষষ্ট কিং জর্জ ও রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় এই সেতুটি ইংরেজ প্রযুক্তিবিদরা তৈরী করেন; সে কারণে এর নাম রাজ্যাভিষেক (করনেশন) ব্রিজ। এই সেতুর দুপাশে বাঘের মূর্তি রয়েছে বলে স্থানীয় লোকের মুখে মুখে এটি বাঘ পুল। স্টেশনের অনতিদূরে রয়েছে শিলিগুড়ি থেকে ডুয়ার্স ও সিকিম যাওয়ার সড়কপথ। রোড রেলওয়ে লেবেল ক্রসিং। সেবক স্টেশনের কাছে থাকা পাহাড়ে জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ভান্ডার। এখানকার রং বেরঙের বৈচিত্র্যে ভরা প্রজাপতি, বিভিন্ন প্রজাতির পোকা মাকড়, রকমারি গুবরে পোকা জীব বিজ্ঞানীদের কাছে এক গবেষণার বিষয়।

সেবক থেকে রেলপথে তিস্তা পেরিয়ে বাগরাকোট রেলস্টেশন। সেবক থেকে বাগরাকোটের মাঝে ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা দৃশ্যগুলি বেশ মনোরম। এই পথে রয়েছে দুইটি আঁধার ঘেরা টানেল। ঝিঁক-ঝিঁক করে রেলগাড়ি টানেলের ভিতরে ঢুকলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই ধরনের টানেল রেলপথ এ রাজ্যের খুব অল্প জায়গাতেই আছে। পূর্বে এই রেলপথটি ছিল বেঙ্গলডুয়ার্স রেলওয়ে কোম্পানীর অধীনে এই কোম্পানী ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় লালমনিরহাট জংশনের সাথে ডুয়ার্সকে যুক্ত করার প্রয়াস হিসেবে পাহাড়ের বুকে সুরঙ্গ করে ইংরেজ প্রযুক্তিবিদরা এই রেলপথ টানেল তৈরী করে। সে সময় এই রেলপথের মুখ্য কার্যালয় ছিল দোমহিনী।  বর্তমানে এটি এন এফ রেলওয়ে বা উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের অধীনে।     বাগরাকোট স্টেশনে নেমে সেখান থেকে  সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যায় ডালিমকোট দুর্গের ধ্বংসাবশেসে। যেখানে ইঙ্গো ভুটান যুদ্ধ হয়েছিল। বাগরাকোট স্টেশন থেকে আরও যাওয়া যায় লিসলিভার চা বাগিচায়। লিস নদীর গা ঘেঁষে থাকা এই চা বাগিচা নদী পারে রয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। সেই তৃণভূমিতে রয়ে গেছে যুদ্ধকালীন পরিত্যক্ত বেশ কয়েকটি কামান ট্যাঙ্কের ধ্বংসাবশেষ। যারা ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন তাদের কাছে বাগরাকোটের আশেপাশের এলাকাগুলি খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। ডালিমকোট এলাকাতে রয়েছে একটি কয়লাখনি। একসময় এই কয়লা চা বাগিচার কারখানায় আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। যদিও খনিটি বর্তমানে পরিত্যক্ত।

বাগরাকোটের পরবর্তী স্টেশন ওদলাবাড়ি। ওদলাবাড়ি রয়েছে ঘিস নদীর ধারে। বনদপ্তরের তৈরী করা ওদলাবাড়ি শিশু উদ্যান ছোটর মধ্যে সুন্দর। ওদলাবাড়িতে নেমে সেখান থেকে সড়কপথে যাওয়া যায় গজলডোবা। গজলডোবা তিস্তা ব্যারেজে বর্তমানে গড়ে উঠেছে বিশেষ পর্যটন কেন্দ্র। ভোরের আলো পর্যটন কমপ্লেক্সে বিভিন্ন রকম বিলাসবহুল ব্যবস্থা রয়েছে। গজলডোবার পথের পাশের হোটেলগুলিতে তরতাজা বৈরোলী মাছের বিভিন্ন পদ ভোজন রসিকদের কাছে অন্য মাত্রা এনে দেয়।

ওদলাবাড়ির পরেই রয়েছে ডামডিম রেলস্টেশন। ডামডিম রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপরে থাকা কাঠের তৈরী স্টেশন সুপরিটেনডেন্টনের অফিসটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। ডামডিম থেকে গাড়ি করে পৌঁছে যাওয়া যায় শৈলশহর গরুবাথান-এ। কালিংপং জেলার এই মফঃস্বলে নদীর ধারে পার্কটি বেশ সুন্দর। শীত পড়লেই কুয়াশামাখা সকালে দলে দলে পিকনিক পার্টি হাজির হয়। এই পার্কটিতে পিকনিক করার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা যেমন- জল, একাধিক রান্নার শেড, বসার জায়গা, পোষাক পরিবর্তনের কক্ষ, শৌচালয় সবই এখানে আছে। গরুবাথান থেকে যাওয়া যায় শৈলশহর লাভা লোলেগাঁও-তে। বর্তমানে ভ্রমণ বিলাসীদের কাছে লাভা-লোলেগাঁও এক পরিচিত নাম। পাহাড়ি পথে ঘন পাইন বন, বুদ্ধিস্ট মনেষ্ট্রি অনেক পর্যটকের কাছে মাটির বুকে এ চিলতে স্বর্গ। অনেকে লাভা লোলেগাঁও থেকে রিসপেও যায়।

গরুবাথান থেকে যাওয়া যেতে পারে ঝান্ডিতে। নবনির্মিত এই ঝান্ডিতে রয়েছে ভিন্ন স্বাদের বেশ কয়েকটি টুরিস্ট কটেজ। কোনোরকম কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে জৈব পদ্ধতিতে বিভিন্ন শাকসব্জি ও ফসল ফলায় গরুবাথানের বেশ কিছু কৃষক পরিবার। যা স্বাস্থ্য সচেতন শহরের মানুষের কাছে কাঙ্খিত বস্তু।
ডামডিম থেকে নিউ মাল জংশনের দূরত্ব ৬ কিমি। এই জংশন স্টেশন থেকে মালবাজার স্টেশন ও দোমহনী হয়ে একটি রেলপথ চলে গেছে চ্যাংরাবান্ধা হয়ে নিউ কোচবিহার পর্যন্ত। বিভিন্ন দূরগামী ট্রেনের নিউ মাল জংশনে স্টপেজ রয়েছে।

যারা ট্রেনপথে লাটাগুড়ি যেতে চান তারা নিউ মাল জংশন থেকে বা শিলিগুড়ি জংশন থেকে লাটাগুড়ির ট্রেন ধরতে পারেন। বর্তমানে মালবাজার একটি মহকুমা শহর। এখানে বেশ বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। নিউ মাল স্টেশনের অদূরেই রয়েছে মালবাজার পার্ক। শীতে এই পার্কে ফুলের বাহার আসে। এই পার্ক সংলগ্ন স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিচালিত মালবাজার টুরিস্ট লজ। এখানে বেশ বিলাসবহুল ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে সরকারী ও বেসরকারী বাসস্ট্যান্ড। মালবাজারের বালাজী মন্দির ধর্মপ্রবণ মানুষের কাছে এক অন্যতম গন্তব্যস্থল। বহু টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী ও পরিবেশ ধর্মালুদের মন কেড়ে নেবে। মালবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস যোগে লাটাগুড়ি ও জলপাইগুড়ি যাওয়ার বহু বাস-গাড়ি রয়েছে। উল্টোদিকে শিলিগুড়ির সাথে মালবাজারের বাস যোগাযোগ খুবই ভাল।
শিলিগুড়ি জংশন থেকে নিউ মাল জংশন হয়ে চ্যাংরাবান্ধা যাওয়ার ট্রেন রয়েছে। এই ট্রেন আসামের নিউ বঙ্গাইগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আরেকটি ট্রেন নিউ চ্যাংরাবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন হয়ে পৌঁছায় নিউ কোচবিহার। নিউ মাল জংশন থেকে মালবাজার রেলস্টেশনের দূরত্ব ৩ কিমি। মালবাজরের পরবর্তী স্টেশন বড়দিঘী। এর দূরত্ব মালবাজার থেকে ৮ কিমি।। বড়দিঘী চা বাগানগুলি ঢেউ খেলানো উঁচু নিচু। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলিও অনেকের ভাল লাগে। বড়দিঘী চা বাগানের লাগোয়া গরুমারা বনাঞ্চল। বড়দিঘী থেকে ৬ কিমি দূরে রয়েছে নেওড়ানদী রেলস্টেশনটি। নেওড়ানদী ও লাটাগুড়ি জংশন দুটোই অভয়ারণ্যের গাঁ ঘেসা।

লাটাগুড়ি থেকে ১৮ কিমি দূরে দোমহনী রেলস্টেশনটি। ইংরেজ জমানা ও তার পরবর্তীকালে দোমহনী এই অঞ্চলের রেল ব্যবস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল। ৬৮ সালের বন্যায় পুরো ব্যবস্থাটাই পাল্টে যায়। দোমহনী থেকে তিস্তার নদীতে নৌকা বিহার বেশ উপভোগ্য বিষয়। এছাড়াও দোমহনীর ঝিল গুলিতে শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। যা দেখতে অনেক পর্যটকেরাই ভিড় জমায়। দোমহনী থেকে ময়নাগুড়ি রোড ৬ কিমি। ময়নাগুড়িতে রয়েছে ডুয়ার্সের অন্যতম প্রাচীন জল্পেশ মন্দির। শ্রাবণ ও চৈত্র মাসে এখানে শৈব ভক্তদের বিপুল সমাগম হয়। দিন ১৫ ধরে মেলা চলে। ময়নাগুড়ি  থেকে ৯ কিমি দূরে রয়েছে ভোটপট্টি। ভোটপট্টিতে গ্রাম্য ছায়া সুশীতল পরিবেশে স্বামী নিগমানন্দের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম রয়েছে। ভোটপট্টি থেকে ১০ কিমি দূরে রয়েছে চ্যাংরাবান্ধা। চ্যাংরাবান্ধায় রয়েছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের সাথে আমদানী ও রপ্তানীর বাণিজ্য হয়। চ্যাংরাবান্ধা থেকে গাড়ি করে ঘুরে আসতে পারেন তিনবিঘা করিডোর। সেখানে ভারতের মাঝখান দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলের মধ্যে যাতায়াত হয়।

নিউ মাল জংশন থেকে আলিপুরদুয়ারগামী পরবর্তী স্টেশন চালসা। নিউ মাল থেকে চালসার দূরত্ব ৮ কিমি। চালসা একসময় রেলওয়ে জংশন ছিল। এখনও নামের সাথে জংশন শব্দটি রয়েছে। আগে এখান থেকেই মেটেলি যাওয়া যেত রেলপথে। ১৯৬৮ সালে বন্যা বিপর্যয়ের পর এই রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি এই রেলপথ চালু করার বিষয়ে নতুন ভাবে কাজ শুরু হয়েছে। চালসা রেলস্টেশনের অদূরেই রয়েছে শালবনি সংঘের গ্রন্থগার ও নাট্যমঞ্চ। একসময় অতীত দিনের অনেক নামজাদা নাট্য ও যাত্রা দল এই মঞ্চে তাদের পালা মঞ্চস্থ করেছে। চালসা থেকে বাস বা গাড়িতে চেপে একদিকে যেমন ঝালং-বিন্দু যাওয়া যায়। অন্যদিকে লাটাগুড়ি ও ময়নাগুড়ি ও জলপাইগুড়িগামী প্রচুর বাস ও গাড়ি রয়েছে।

চালসা থেকে ঝালং হয়ে বিন্দু যাওয়ার পথে সবুজে শ্যামলে। চাপরামারি অভয়ারণ্যের বুক চিরে কালো অজগরের মত এঁকেবেকে চলে গেছে পাকা বাঁধানো পথ। এই পথেই রয়েছে চাপড়ামারি বনবাংলো। ঝালং যাওয়ার পথে রয়েছে রবার, ইপিকাক, সিঙ্কোনা চাষের সরকারী প্রকল্প। ঝালং-এ রয়েছে জলঢাকা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

জলঢাকা নদীর জল বাঁধ দিয়ে তা থেকে টারবাইন ঘুরিয়ে তা থেকে উৎপাদন করা হয় জলবিদ্যুৎ। ২৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ডুয়ার্সের বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকটাই পূরণ করে। ঝালং থেকে ৯কিমি দূরে রয়েছে শৈল মফঃস্বল বিন্দু। এখানে জলঢাকা নদীর উপর রয়েছে বাঁধ। প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। জলঢাকা নদীর একপাশে রয়েছে ভারত। অপর পারে ভুটান। বিন্দু থেকে ব্যারেজ পেরিয়ে ভুটানে প্রবেশ করা যায়। তবে পর্যটকদের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন। বিন্দু ও জলঢাকাতে বেশ কয়েকটি লজ ও হোটেল রয়েছে। যেগুলি রাত্রিবাসের জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও বর্তমানে বেশ কয়েকটি হোম স্টে আতিথেয়তার ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছে।
চালসা থেকে লাটাগুড়ি যাওয়ার বহু বাস ও গাড়ি রয়েছে। বর্তমানে লাটাগুড়ি ডুয়ার্সের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রচুর সংখ্যক সরকারী ও বেসরকারী লজ রয়েছে। রয়েছে তারকাপ্রাপ্ত বিলাস বহুল রিসর্ট। গরুমারা অভয়ারণ্যের গাঁ ঘেঁসা থাকা লাটাগুড়ি, দক্ষিণ ধূপঝোরা পর্যটকদের ক্ষেত্রে অন্যতম গন্তব্যস্থল। এখানে এলিফেন্ট রাইডিং ও জিপসি গাড়ি করে অরণ্যের অভ্যন্তরে দেখার সুযোগ রয়েছে। এখানে রয়েছে রাজ্য বন দপ্তরের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।

চালসা থেকে নাগরাকাটা রেলস্টেশনের দূরত্ব ১৩ কিমি। এই রেলপথটি চাপরামারি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। ট্রেনের জানলা দিয়ে দুই চোখ পেতে থাকলে; মাঝেমধ্যেই বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে। এই রেলপথের ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে মূর্তি ও জলঢাকা নদী। এই রেলপথের একটি জায়গায় এমন সর্পিল বাঁক রয়েছে, যেখানে ট্রেনের শেষ কমপার্টমেন্ট থেকে ট্রেনের ইঞ্জিন দেখা যায়। জলঢাকা নদী থেকে অনতিদূরেই নাগরাকাটা। নাগরাকাটা এক গঞ্জ মফঃস্বল। নাগরাকাটায় রয়েছে বনদপ্তরের ছোট্ট শিশু উদ্যান। প্রশাসনিক ভাবে নাগরাকাটা একটি ব্লক। নাগরাকাটা থেকে চাপরামারি ও গরুমারা সহজেই যাওয়া যায় ৩১ সি জাতীয় সড়ক ধরে। জলঢাকা নদীর ধারে বেশ কয়েকটি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
নাগরাকাটার পরবর্তী স্টেশন ক্যারন। স্থানীয় মানুষের মুখে এটি লুকসান নামে পরিচিত। ক্যারন স্টেশনে নেমে এখান থেকে গাড়ি করে ক্যারন চা বাগানে যাওয়া যায়। এখানে বেশ কয়েক ঘর অসুর সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। লুকসানে রয়েছে লিম্বু সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতার মন্দির। এই জাতীয় মন্দির  এই রাজ্যে বিরল। লুকসান থেকে যাওয়া যেতে পারে লাল ঝামেলা বস্তিতে। শীতকালে বহু বন ভোজনের দল লাল ঝামেলায় আসে। লাল ঝামেলায় বয়ে যাওয়া ডায়না নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে দেখা যায় ভুটান পাহাড়ের নৈসর্গিক শৈল চূড়া। এখানে একটি ঝুলন্ত ব্রীজ রয়েছে। যা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।

ক্যারন থেকে বানারহাট রেলস্টেশনের দূরত্ব ১৩ কিমি। চা-বাগিচার মাঝখান দিয়ে এই পথ যাত্রা বেশ নয়নাভিরাম। পথে পড়বে ডায়না নদীর ওপর রেলব্রীজ। রাতের বেলায় ট্রেনের জানালা দিয়ে ভুটানের জেলা শহর সামসীর আলো ঝলমলে দৃশ্য দেখা যায়। দেখে মনে হয় যেন সে এক দীপাবলীর রাত। বানারহাট রেলস্টেশনে নেমে সহজেই বিদেশ ভ্রমণ করা যেতে পারে। বানারহাট রেল স্টেশনের থেকে ১৫  কিমি দূরে রয়েছে ভুটানের জেলা শহর সামসী। বৈধ পরিচয় পত্র থাকলে রাজকীয় সিংহদুয়ার পেরিয়ে ঢুকে পড়া যায় প্রতিবেশী এই বিদেশ ভূমিতে। সামসী বাজারে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। আর রয়েছে ভুটানী মদের পানশালা। দামেও সস্তা। যারা ভ্রমণ পথে প্রাকৃতিক মাদকতা ভিন্ন অন্য মাদকতায় স্বাদ নিতে চায়; তারা চুমুক দিতে পারেন পান পেয়ালায়। সামসী আর্মি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্টের তৈরী রাম, হুইস্কি, ব্রান্ডি, বিয়ার সবই পাওয়া যাবে সামসী বাজারে। এখানে রয়েছে সুপ্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফা। পর্যটকদের হাতের ছোঁয়ায় ঘুরতে থাকে কালচক্র। স্বর্ণালী বৌদ্ধমূর্তি হিংসাবিহীন পৃথিবীর কথা শোনায়। সামসি বাজারের অদূরেই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক বছর আগে গড়ে উঠেছে বালাজী মন্দির। যা এক কথায় অসাধারণ। সামসীতে রয়েছে ড্রুক কোম্পানীর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ আধুনিক কারখানা। এখানে বোতলজাত হচ্ছে জ্যাম, জেলি, আচার বিভিন্ন  ফলের রস। এই কারখানার অদূরেই রয়েছে ভুটান আর্মি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্টের ডিস্টিলারি। যেখানে তৈরী হচ্ছে রাম, হুইস্কি, বিয়ার আরও সব উষ্ণ পানীয়। সামসির প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ মনোরম। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ঘরবাড়িগুলি বেশ ভালো লাগে। ভুটানের নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী রয়েছে। যা তিব্বতীয় বৌদ্ধিক স্থাপত্যের অনুসরণে গড়ে ওঠা। তাই ভুটানের সরকারী আবাস থেকে শুরু করে গুম্ফা, দালানবাড়ি বেশ আকর্ষণীয়। সামসিতে রয়েছে জেলা শাসকের কার্যালয়, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন এবং রাজপ্রাসাদও রয়েছে। সামসী যাওয়ার পথেই রয়েছে ভারতের সীমান্ত গ্রাম চামুর্চি। চামুর্চি থেকে যাওয়া যায় মহাকাল গুহায়। এখানে পাহাড়ের বুকে বড় বড় শিবের জটা দিয়ে তৈরী হয়েছে গুহা। শিবের জটা দিয়ে সবসময় টপ টপ করে জল পড়ছে। যারা রোমাঞ্চ বিলাসী তারা পায়ে হেঁটে পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে পৌঁছে যেতে পারেন এই স্ট্যালাকটাইট স্ট্যালাগমাইট গুহায়। পাহাড়ি চুনাপাথরের সাথে আম্লিক জলের খেলা চলে- এই পাহাড়ের কন্দরে। এক বিশেষ ভৌগোলিক পরিবেশে এই ধরনের গুহা তৈরী হয়। মহাকাল যাওয়ার পথে সুকৃতি নদীর ধারে এক সুন্দর পর্যটননিবাস তৈরী হয়েছে। এখানে রয়েছে পার্ক, রেস্তারা, ওয়াচিং টাওয়ার ও রাতে থাকার ব্যবস্থা। শিলিগুড়ি থেকে সাতসকালে ট্রেনে বানারহাটে চলে এলে, চামুর্চি মহাকাল দেখে সেইদিনই আবার ফিরে যাওয়া যায়।
 বানারহাটে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন কালীবাড়ি । এখানে ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চ আছে। কালী মন্দিরের শান্ত শীতল খোলা মেলা পরিবেশ অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। একসময় এই নাট্য মঞ্চে কলকাতা থেকে নামী দামী অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা নাটক মঞ্চস্থ করতে এসেছেন।

বানারহাটের পরবর্তী স্টেশন বিন্নাগুড়ি। বানারহাট ও বিন্নাগুড়ির রেলপথের দূরত্ব ৫কিমি। বিন্নাগুড়িতে রয়েছে ভারতের অন্যতম সেনা ক্যান্টনমেন্ট। সে কারণে বেশ কয়েকটি দূরগামী ট্রেনের স্টপেজ রয়েছে এই স্টেশনে। বিন্নাগুড়ি থেকে সড়কপথে যাওয়া যায় ডুয়ার্সের অন্যতম প্রচীন জনপদ গয়েরকাটায়। একসময় কাঠের ব্যবসায় গয়েরকাটার বেশ সমৃদ্ধি ছিল। এখানে রয়েছে গয়েরকাটা রিডিং ক্লাবের শতাব্দী প্রাচীন নাট্যমঞ্চ । গয়েরকাটা থেকে নাথুয়া যাবার পথে মধুবনী নদীর পাশে তৈরী হয়েছে বিশেষ পর্যটন আবাস। নদীর ওপারেই খুট্টিমারী বনাঞ্চল। এই বনাঞ্চলে আছে বনবাংলো। খুট্টিমারী থেকে যাওয়া যায় রাভাদের গ্রাম গোসাইহাটে। সেখানে পার্ক, জলাশয়, অনুষ্ঠান মঞ্চ, বনবাংলো ও বোডিং এর সুবিধা রয়েছে।
বৈধ প্রবেশ পত্র সংগ্রহ করে বিন্নাগুড়ি সেনা ছাউনিতে যদি একবার যাওয়া যায়, তবে মন ভরে যাবে। বড়সর সিংহদুয়ার  দিয়ে ঢুকলে এক ঝাঁ চকচকে সেনানগরী। বেশ কয়েকটি স্কুল, একাধিক মার্কেট কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, সিনেমাহল, গল্ফগ্রাউন্ড, সুইমিং পুল বেশ কয়েকটি পার্ক  কি নেই। সব কিছুই ছবির মত সাজানো গোছানো। পর্যটকদের মনে হবে তারা যেন কোন বিদেশের শহরে পৌঁছে গেছেন।

বিন্নাগুড়ি থেকে দলগাঁও রেলস্টেশনের দূরত্ব ৯ কিমি। রেলস্টেশনের নাম দলগাঁও হলেও জায়গাটি বীরপাড়া বলে পরিচিত। অর্থনৈতিকভাবে বীরপাড়া ডুয়ার্সের এক বর্ধিষ্ণু মফঃস্বল। বীরপাড়া থেকে সহজেই ভুটানের গোমটুতে যাওয়া যায়। গোমটুতে একটি সুন্দর বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে। এখানে রয়েছে সিমেন্ট তৈরীর কারখানা। গোমটু যাওয়ার পথে পড়বে মাকড়াপাড়া কালীবাড়ি। পাহাড়ের গায়ে তৈরী হওয়া এই কালীবাড়িটি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বহু প্রেমিক-প্রেমিকারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে এই মন্দিরে যান। গোমটুতে ঢোকার ব্যাপারে তেমন বিশেষ কোন কড়াকড়ি নেই। গোমটু বাজারে ভুটানীমদের পাইকারী আউটলেট রয়েছে। এখানে কারণবারির দাম খুব সস্তা। বীরপাড়ায় বনদপ্তরের শিশুউদ্যান ছোটর মধ্যে সুন্দর।

বীরপাড়ার পরবর্তী রেলস্টেশন মুজনাই। জায়গাটির নাম শিশুবাড়ি। ৩১ সি জাতীয় সড়ক শিশুবাড়ির উপর দিয়ে গিয়েছে। একসময় শিশুবাড়ির হাটের খুব সুনাম ছিল। ডুয়ার্সের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা হাটে আসত বেচাকেনা করতে। এখন সেই সুনাম ম্রিয়মাণ।  
মুজনাই এর পর রয়েছে মাদারীহাট। মুজনাই ও মাদারীহাটের দূরত্ব  ৯ কিমি। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের জন্য মাদারীহাট ডুয়ার্সের অন্যতম পর্যটন স্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

 

জলদাপাড়া অভয়ারণ্য একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য খ্যাতিলাভ করেছে। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের হলং লজের খ্যাতি দেশজোড়া। এছাড়াও জাতীয়সড়কের পাশে রয়েছে বনদপ্তরের পর্যটন আবাস। কম খরচে মাদারীহাট থানা লাগোয়া ইউথ হোস্টেলে থাকা যেতে পারে। এছাড়াও বহু বেসরকারী লজ মাদারীহাট জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের এলিফেন্ট রাইডিং ও জিপসিগাড়ি সাফারি বেশ আকর্ষণীয়। কাঠের আসবাব শিল্পের জন্য মাদারীহাটের সুনাম রয়েছে। মাদারীহাট থেকে টোটোপাড়া যাওয়া যায়। রাস্তাটা বেশ দুর্গম। বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো। টোটোরা এক বিরল জনজাতির মানুষ। এদের জীবনধারণ ও আচার আচরণ প্রাচীন ম্যাঙ্গোলয়েডদের মত।
মাদারীহাটের পরের স্টেশন হল হাসিমারা। হাসিমারাতে ভারতীয় বায়ুসেনার বিমানঘাঁটি রয়েছে। তবে সেখানে নিরাপত্তার বেশ কড়াকড়ি রয়েছে।  সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রবেশ করা খুবই মুশকিল। হাসিমারা থেকে গাড়ি চেপে ভুটানের অন্যতম শহর ফুন্টশেলিং যাওয়া যায়। পথে পড়বে ভারতের জয়গাঁ শহর। জয়গাঁ ও ফুন্টশেলিং দুটোই বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ। ভুটানের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন জিনিসপত্র কেনাকাটার  জন্য ফুন্টশেলিং ও জয়গাঁতে আসে। ভুটানের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া আসার বাস ও ট্যাক্সি ফুন্টশেলিং থেকেই পাওয়া যায়। ফুন্টশেলিং ও জয়গাঁতে অনেক খাবারের দোকান ও হোটেল রয়েছে।
এরপরে রয়েছে হ্যামিল্টনগঞ্জ ও কালচিনি। এই দুটি লাগোয়া শহর। হ্যামিল্টনগঞ্জ থেকে কালচিনি স্টেশনের দূরত্ব ২ কিমি। হ্যামিল্টনগঞ্জে কালীবাড়ির বেশ সুনাম রয়েছে। প্রতিবছর কালীপূজোর সময় হ্যামিল্টনগঞ্জে বড়সড় মেলা বসে।

কালচিনির পরের স্টেশন গারোপাড়া এটি মূলত চা বাগিচা অধ্যুষিত এলাকা। বেশ কয়েকটি চা বাগানের মানুষজন এই স্টেশনের মাধ্যমে চলাফেরা করে।
গারোপাড়ার পরে রয়েছে রাজাভাতখাওয়া জংশন। রাজাভাতখাওয়াতে রয়েছে বক্সা টাইগার প্রজেক্ট। রাজাভাতখাওয়া থেকে সড়কপথে বক্সা ও জয়ন্তী যাওয়া যায়। বক্সায় ইংরেজ আমলে গড়ে তোলা বক্সা দুর্গ ও কারাগারের এখনও কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। যা দেখতে পর্যটকেরা ভিড় জমায়। জয়ন্তীর পরিবেশও খুব মনোরম। ভুটান পাহাড়ের কোলবেয়ে বয়ে যাওয়া জয়ন্তী নদী বর্ষাকালে ভয়াবহ রূপ নেয়। জয়ন্তীতে থাকা পুকড়ি পাহাড়ের টিলার উপরে রয়েছে একটি পুকুর। এখানে দেখা যায় বিরাট বড় বড় মাগুর মাছ ও কাছিমের। পাহাড়ের টিলায় কিভাবে এই পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে অনেক লোককথা স্থানীয় মহলে প্রচলিত। রাজাভাতখাওয়ায় রয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারী লজ ও সরকারী বনবাংলো। এখানে বেশ সুন্দর একটি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ফরেস্ট মিউজিয়াম রয়েছে। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সাথেই রয়েছে শকুন প্রজননকেন্দ্র ও অর্কিডের সংগ্রহশালা। বিভিন্ন রংবেরঙের অর্কিড দেখা যায় গ্রীষ্ম শুরুর প্রাককালে। বক্সাতে রয়েছে বিরল ডুপপা জনজাতির আবাসভূমি। রাজাভাতখাওয়ার আশেপাশে বক্সা অভয়ারণ্যের গাঁ ঘেসে থাকা গ্রামগুলিতে এখন বহু হোমস্টে চালু হয়েছে। যেখান থেকে নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে অনেক পর্যটকেরাই প্রাকৃতিক সান্নিধ্য লাভ করেন।
একসময় রাজাভাতখাওয়া  থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত রেলপথ ছিল। সকাল বিকেল চলতো কু-ঝিঁকঝিঁক রেলগাড়ি; আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে রাজাভাতখাওয়া জংশন হয়ে জয়ন্তী পর্যন্ত। জয়ন্তী থেকে ভুটানী কমলালেবু ডলোমাইট এসব ট্রেনে করে ছড়িয়ে পড়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বেশ কিছু বছর আগে প্রাকৃতিক সংরক্ষণের কারণ দেখিয়ে এই রেলপথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাজাভাতখাওয়ার পরেই রয়েছে আলিপুরদুয়ার জংশন। রাজাভাতখাওয়া থেকে আলিপুরদুয়ার জংশনের দূরত্ব ১১ কিমি। আগে যখন মিটার গেজ রেলপথ ছিল সেসময় আলিপুরদুয়ার জংশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখানে রেলকর্মীদের বিরাট অবাসন বা রেল কলোনী রয়েছে। রেলওয়ে ডিভিশনাল হেড কোয়াটার আলিপুরদুয়ার জংশনে অবস্থিত। এখানে রেলওয়ে স্কুল, রেল হাসপাতাল, রেলওয়ে ইনস্টিউট সবই আছে। আগে মিটারগেজ পথে আসামের যোগাযোগের একমাত্র রেলপথ আলিপুরদুয়ার জংশনের উপর দিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে ব্রডগ্রেজ রেলপথ চালু হওয়ার পর আলিপুরদুয়ার জংশনের গুরুত্ব কিছুটা কমে আসে। তার পরিবর্তে নিউ আলিপুর স্টেশনের রেল যোগাযোগ গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

ডুয়ার্সের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা শতাব্দী প্রাচীন হলেও সেভাবে উন্নত হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে। শিলিগুড়ি জংশন থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন ১৬১ কিমি দীর্ঘ এই রেলপথের বহু স্টেশন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ স্টেশনগুলির মধ্যে রয়েছে শিলিগুড়ি জংশন ও গুলমার মাঝে পশ্বাশ্রয়, চালসা ও নাগরাকাটার মাঝে চাপরামারি, ক্যারন ও বানারহাটের মাঝে চ্যাংমারি, রাজাভাতখাওয়া ও আলিপুরদুয়ার জংশনের মাঝে দমনপুর। এর পাশাপাশি বন্ধ হয়েছে চালসা জংশন থেকে মেটেলি যাবার রেলপথ। মালবাজার থেকে চ্যাংরাবান্ধা যাবার রেলপথ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। ভূতপূর্বরেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর উদ্যোগে তা ফের চালু হয়। রেলস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া, রেলপথ উঠিয়ে দেবার যে নজির ডুয়ার্স এলাকায় রয়েছে; তা স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতের আর কোথায় হয়েছে কিনা তা জানা নেই।
আলিপুরদুয়ার একসময় জলপাইগুড়ি জেলার মহকুমা শহর ছিল। ২০১৪ সালের ২৫শে জুন তা জেলায় পরিণত হয়। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ি জেলারই একটি অংশ।

ডুয়ার্সের  অন্যতম প্রধান শিল্প চা। নানাকারণে এই চা শিল্প এখন ধুঁকছে। বহু বাগানেই শ্রমিকদের বেতন ও পাওনা বাকী রয়েছে, রয়েছে বহু বন্ধ চা বাগান। আদিবাসী যুবক-যুবতীদের বেকারত্ব আজ আকাশ ছোঁয়া। রুটিরুজির তাগিদে নিত্যদিন ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে এই এলাকার যুবক-যুবতী, মানুষজন। ডুয়ার্সের অর্থনীতি এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। টি ও টিম্বার অর্থাৎ চা ও কাঠ যা ডুয়ার্সের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ছিল; তা এখন চরম সংকটে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পর্যটন শিল্প এই এলাকার মানুষদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটু অক্সিজেন যোগান দিতে পারে। পর্যটন শিল্পের মূল চাবিকাঠিটি রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সে দিক থেকে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে শিলিগুড়ি জংশন গামী এই পথে অনেক ট্রেন চলাচল করে। তবে বেশিরভাগ ট্রেনই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিতে দাঁড়ায় না। পর্যটকদের ব্যাপক ভোগান্তি হয়। তার সাথে সাথে বেড়ে যায় ভ্রমণ সংক্রান্ত খরচপত্র। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে ছাড়ে মহানন্দা এক্সপ্রেস (১৫৪৮৩/ ১৫৪৮৪) ও কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস (১৩১৪৯/১৩১৫০) এই  দুটি দূরগামী ট্রেন। এই ট্রেন দু’টি যদি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস(১৫৭৬৭/ ১৫৭৬৮) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিতে দাঁড়ালে ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে কলকাতা ও দিল্লীর যোগাযোগ আরও নিবিড় হত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্যাসেঞ্জার কাম এক্সপ্রেস ট্রেনের মত এই দুটিকেও রূপান্তরিত করা দরকার।

রেলপথে হাতির মৃত্যু নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন তোলেন পরিবেশপ্রেমীরা। অনেকেই প্রস্তাব দেন এই পথে রেল চলাচল বন্ধ করার। হাস্যকর এই প্রস্তাবে কোন সারবর্তা না থাকলেও; ট্রেন দুর্ঘটনায় হাতির মৃত্যু নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এই ১৬১ কিমি দীর্ঘ রেলপথের ৩৫ কিমি অরণ্য এলাকায় সুউচ্চ ওভারব্রীজ বা এলিফেন্ট কড়িডোর বানিয়ে দিলে ডুয়ার্সের রেলপথ অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। ডুয়ার্স এলাকার আর্থসামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আরও সদার্থক ভূমিকা নিতে হবে। সেই আশায় বুক বেঁধে রয়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত ডুয়ার্স এলাকার মানুষেরা।

Join our mailing list Never miss an update