পাহাড়- অরণ্য- নদী আর নানা জনজাতির সংস্কৃতি নিয়ে ভ্রমণের হাতছানি দিচ্ছে ডুয়ার্স;ডাঃ পার্থপ্রতিম। ১লা জানুয়ারী ২০২০; বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত।
উত্তরের আকাশে মাথা তোলা মৌন হিমালয়, তার কোল বেয়ে নেমে আসা দিগন্ত ছোঁয়া চা বাগিচার সবুজ গালিচা। নীচে তিস্তা-তোর্ষা অববাহিকার সমভূমি। কল-কল ধ্বনি তুলে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী স্রোতস্বিনী; আবার কোথায় শান্ত নীরব তটিনী। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা; জনজাতী ও ভূমি বৈচিত্র্যের নিরিখে এককথায় অনন্য। ভ্রমণবিলাসী মানুষের কাছে চিরকালের আকর্ষণ হয়ে রয়ে গেছে জলপাইগুড়ি জেলা।
জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলে রয়েছে মূলত পাহাড়, নদী, অরণ্য। রেলপথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আসার পর; সড়কপথে শিলিগুড়ি হয়ে ঢুকে পড়া যায় ডুয়ার্সে। ডুয়ার্সে প্রবেশ পথে পড়বে সেবকসেতু। তিস্তা নদীর ওপর এই সেতুটি ১৯৩৭ সালে তৈরি। ইংরেজ যুবরাজ ষষ্ঠ কিং জর্জ ও রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় এই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়। তাই এর আর এক নাম করনেশন ব্রিজ। জলস্তর থেকে ব্রিজ স্প্যানের উচ্চতার নিরিখে এটি ভারতের মধ্যে অন্যতম। মহানন্দা অভয়ারণ্য ও বহু চা বাগিচার বুক চিরে চলে যাওয়া ৩১ সি জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ওদলাবাড়িতে। ওদলাবাড়ি থেকে যাওয়া যায় গজলডোবায়। গজল ডোবার তিস্তাব্যারেজে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে পর্যটন হাব ‘ভোরের আলো’। বহু দূর বিস্তৃত জলরাশিতে নৌকাবিহার, উত্তর আকাশে পাহাড় শৃঙ্গে শুভ্রতার চমক, বৈকুন্ঠপুর অরণ্যের পথ চলা পথিকমনে ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়। এখানে গড়ে উঠেছে বিলাস বহুল সুদৃশ্য হোটেল ও লজ।
ওদলাবাড়ি থেকে মালবাজার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র লাটাগুড়িতে। গরুমারা অরণ্যের মাঝে লাটাগুড়ি, দক্ষিণ ধূপঝোড়া ও বাতাবাড়িতে ভ্রমণবিলাসীদের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। হাতির পিঠে চেপে অরণ্য দেখা, জিপসাফারী, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আরও বহু কিছু। এখানে বিভিন্ন ধরনের হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। গরুমারা অভয়ারণ্যের ধারেই চাপড়ামারি। চাপরামারি অরণ্যের ভেতর দিয়ে সড়কপথে পৌঁছে যাওয়া যায় উত্তরবঙ্গের অন্যতম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ‘জলঢাকা হাইড্রাল প্রজেক্ট’ -এ। সেখান থেকে আরও উপরে রয়েছে বিন্দু। বিন্দুতেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল ব্যারেজ। গরুমারা অভয়ারণ্যে রয়েছে রামসাই টুরিস্ট কমপ্লেক্স ও কালীরহাট ইকোভিলেজ। এখানে হাতির পিঠে সাওয়ার হয়ে পর্যটকেরা জঙ্গল ঘুরতে পারেন। রামশাই থেকে ময়নাগুড়ি হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় জেলার অন্যতম প্রাচীন জল্পেশ মন্দিরে। ১৫২৪ সালে কোচবিহার রাজ পরিবারের বিশু সিংহ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করে। জল্পেশ মন্দির থেকে কিছুটা গেলেই অপর শৈব মন্দির জটিলেশ্বর। সম্ভবত গুপ্ত যুগে অর্থাৎ ৩২০ থেকে ৬০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের কাছে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।
দেবী চৌধুরানী মন্দির জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া। শোনা যায়, এই মন্দিরটি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী স্মৃতি বিজরিত। জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতে রাজকীয় জৌলুস না থাকলেও কিছু প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে।জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি সংলগ্ন দিঘীটি বর্তমানে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কয়েকঘন্টা কাটানোর জন্য বেশ ভালো জায়গা। জলপাইগুড়ি বোদাগঞ্জের মা ভ্রামরী দেবী কালীবাড়ি সতীপীঠের একটি পীঠ বলে কথিত। সবুজে ঘেরা এই মন্দিরের অদূরেই বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এই মন্দির অন্যতম আকর্ষণ।
অরণ্যপ্রেমী মানুষের কাছে জলদাপাড়া এক অন্যতম আকর্ষণ। মাদারীহাটের এই অরণ্য একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করেছে। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ভেতর হলং লজে রাত্রিবাস এক ভিন্ন অনুভূতি এনে দেয়। এছাড়াও বহু বনবাংলো ও বেসরকারী রিসোর্ট রয়েছে জলদাপাড়ার ধারে কাছেই। মাদারীহাট থেকে যাওয়া যায় টোটোপাড়াতে। এখানে বিরলজনজাতি টোটোদের বাস। তবে বর্ষায় এই পথ খুব দুর্গম হয়ে ওঠে।
জলদাপাড়া অভয়ারণ্য ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কুঞ্জনগর পার্ক। ফালাকাটা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। শীতকালে বনভোজনের বাসনায় বহু পিকনিক পার্টি এখানে ভিড় জমায়। মাদারীহাটের কাছে খয়ের বাড়ি পার্কে রয়েছে বন্য জন্তুজানোয়ারের রেসকিউ সেন্টার। লোকালয়ে ধরা পড়া লেপার্ড ও অন্যকিছু জন্তু-জানোয়ারদের চিকিৎসার জন্য কিছুদিন এখানে রাখা হয়। এখানে রয়েছে বনভোজনের জায়গা, নৌকাবিহারের ব্যবস্থা।
মাদারীহাট থেকে হাসিমারা হয়ে ভুটানের অন্যতম শহর ফুন্টশোলিং। এখানে তিব্বতীয় স্থাপত্যের বহু নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে ক্রোকোডাইল পার্ক, বিদেশী জিনিসপত্র কেনার দোকানপাট, গুম্ফা, রাজার আবাস ও আরও বহু কিছু। হাসিমারা থেকে সড়ক ও রেলপথে যাওয়া যায় রাজাভাতখাওয়া জংশনে। বক্সা টাইগার রিজার্ভের প্রবেশ পথ এই রাজাভাতখাওয়া। এখান থেকে যাওয়া যায় জয়ন্তী ও বক্সাদুর্গে।রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্গ এখন বিধস্ত। তবুও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ইতিহাসপ্রেমী মানুষের মন কেড়ে নেবে। জয়ন্তী নদীর অপর পাড়ে ভুটান। জয়ন্তীতে বহু বনবাংলো ও হোমস্টে রয়েছে। যা রাত্রিবাসের উপযুক্ত। জয়ন্তীর ‘পুকরি পাহাড়’ -এর চূড়ায় রয়েছে শান্তশীতল সবুজে মোড়া জলাশয়। যেখানে বড় বড় মাছ ও কাছিমের দেখা মেলে।
রাজাভাতখাওয়ার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় বেশ কিছু বিরল নিদর্শন। বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের দেহাবশেষ, বিভিন্ন পাখির ডিম, বিভিন্ন প্রাণীর মলের সংরক্ষিত অংশ। পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পাশেই আছে অর্কিডের সংগ্রহশালা। মে-জুন মাসে এখানে ফুলের বাহার আসে। বক্সা অভয়ারণ্যের অর্কিডের খ্যাতি অনেক দূরে ছড়িয়েছে।
শিলিগুড়ি জংশন থেকে রেলপথেও ডুয়ার্স ঘোরা যায়। মহানন্দা অভয়ারণ্যের বুক চিরে আসা রেলপথ সেবক স্টেশন হয়ে ঢুকে পড়ে ডুয়ার্সে। এপথে রয়েছে দুটি সুড়ঙ্গ। আঁধার ঘেরা সুড়ঙ্গ পথে রেলযাত্রা বেশ গা ছমছম ব্যাপার। এইপথে নিউ মাল জংশন, বানারহাট, মাদারীহাট হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় আলিপুরদুয়ার জংশনে।
চা বাগিচা ঘেরা বানারহাট থেকে সীমান্ত গ্রাম চামুর্চী হয়ে পৌঁছে যেতে পারে ভুটানের জেলা শহর সামসীতে। সামসীতে রয়েছে ভুটানী মদ তৈরীর ডিস্ট্রিলারী। বিভিন্ন ফল-সবজি থেকে জ্যাম, জেলী ও আচারের কারখানা। সামসীবাজারে যত্রতত্র রয়েছে ভুটানী মদের বার; যা সুরারসিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বানারহাট থেকে সড়কপথে সহজেই আসা যায় গয়েরকাটায়। এখানে খুট্টিমারী বনাঞ্চলের ধারে গড়ে উঠেছে মধুবনী ইকোপার্ক। রাত্রিবাসের জন্য বেশ কয়েকটি কর্টেজ এখানে রয়েছে। ইকোপার্ক থেকে রাভা জন-জনজাতির খুকলং বস্তিতে ঘুরে আসা যায়। গোঁসাইহাট ইকোপার্কে বনদপ্তরের ছোট মিউজিয়াম রয়েছে, রয়েছে বোর্ডিং ও পিকনিক করার জায়গা, পার্ক ও নাটকের মুক্তমঞ্চ।
আলিপুরদুয়ার একসময় জলপাইগুড়ি জেলার মহকুমা শহর ছিল। ২০১৪ সালের ২৫শে জুন তা জেলায় পরিণত হয়। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ি জেলারই একটি অংশ।
জলপাইগুড়ি জেলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো রয়েছেই; তাছাড়া রয়েছে বহু জাতি ও জনজাতির বাস; রয়েছে সুবিশাল লোক সংস্কৃতির সম্ভার। এসব নিয়ে গড়ে উঠতে পারে এথেনিক ট্যুরিজমের বড়সড় প্রকল্প । গড়ে উঠতে পারে চা বাগিচা কেন্দ্রীক পর্যটন কেন্দ্র। সরকার ও বেসরকারী উদ্যোগের সমন্বয়ে বাস্তব রূপ পেতে পারে আরো অনেক কিছু. . । তবে এতকিছুর জন্য- আপাতত সময়ের পথচেয়ে থাকা ছাড়া আর কী উপায়।