এই নরদেহে- স্তন নিয়ে. .

এই নরদেহে- স্তন নিয়ে. .

আমাদের এই নরদেহের গঠনশৈলীতে রয়েছে বহু বিস্ময়ের ছোঁয়া। শরীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে নিয়ত ঘটে চলেছে চমকপ্রদ ঘটনাবলী। যা অনেকের কাছেই অজানা। তাই, এই সব নিয়ে প্রবাহ তিস্তা তোর্ষার পাতায় থাকছে ধারাবাহিক চিত্রায়িত তথ্যকথা  “ এই নরদেহে ” কলম ধরেছেন -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
" স্তন নিয়ে. . "
আমরা যখন এই ধরায় আসি, তখন এই অঙ্গটির সাথেই আমাদের প্রথম একত্ব হওয়ার কথা। মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে আসার পর আমাদের প্রথম খাদ্যের উৎস মাতৃ পয়োধর। পয়োধর বা স্তন বলতে আমাদের বুকের দুপাশে থাকা অঙ্গ দুইটিকে বুঝি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে স্তনগ্রন্থি বা ম্যামরি গ্লান্ডকে স্তন বলে। এই ম্যামরি শব্দটি এসেছে গ্রীক-ল্যাটিন শব্দ ‘মম্মা’ থেকে যার অর্থ হল- ‘ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না’ অর্থাৎ ‘আমি খেতে চাই’ এটা বোঝাতেই মম্মা থেকে ম্যামরি শব্দটি এসেছে। পুরুষ দেহে স্তন থাকলেও; পুরুষের স্তন যৌন অঙ্গ হিসাবে স্বীকৃত নয়। হয়তো সে কারণেই পুরুষের ঊর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত থাকলেও তা দৃষ্টিকটু নয়। নারী স্তনকে আড়াল করার প্রবণতা বোধ হয় বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। কেন না, বাগদেবী বন্দনায় রয়েছে- ‘কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে . . . ’। যার অর্থ- ‘দেবীর স্তন দু’টির শোভা বর্ধন করছে মুক্তার হার।’
নারীর  ম্যামারি গ্ল্যান্ড এক দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি; যার ভিতরে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে। কিশোরীর দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে স্তন গ্রন্থির বৃদ্ধি হতে থাকে। বিপরীত দিকে অ্যান্ড্রোজেন গোষ্ঠীর হরমোন যেমন- টেস্টোরেন (Testosterone) স্তনের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। এই ইস্ট্রোজেন ও অ্যান্ড্রোজেনের মিলিত ফলেই নারীদের স্তন বিবর্ধিত হয় আর পুরুষের স্তন পরিণতি লাভ করে না।

আমাদের স্তনগ্রন্থির মধ্যে বহু নালিকা বা টিউবের জটিল গঠন রয়েছে। এই নলগুলি থলির মত কাঠামো থেকে বের হয়। এই থলির কাঠামোকে বলে লোবোলেস (Lobules)। লোবোলেস হচ্ছে স্তনের মধ্যে থাকা একরকম গ্রন্থি যেগুলি দুগ্ধ উৎপাদন করে। এই দুগ্ধ উৎপাদনের বিষয়টি বিভিন্ন হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। স্তনে থাকা নালিকাগুলি লোবোলেস থেকে মাতৃদুগ্ধ বহন করে স্তন বৃন্ত বা নিপিলস (Nipples) এ নিয়ে যায়। শিশু এই বৃন্তের থেকেই স্তন্যপান করে।
মানুষের স্তন অন্যসব স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন- মনুষ্যইতর প্রাণী শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাং এদের থেকে আলাদা। এদের স্তন তখনই বড় হয় যখন তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন পরে। আবার বাচ্চা দুধ ছেড়ে দিলেই স্তন আবার শুকিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। গর্ভবতী না হলেও; যৌবনে নারীর স্তন বৃদ্ধি পায়। যা মোটামুটি সারাজীবন ধরেই থাকে। আর গর্ভাবস্থায় নারীর স্তন একটু বাড়লেও সন্তান বড় হয়ে যাওয়ার পর স্তনের আকার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না।
গর্ভাবস্থায় স্তনের আকার স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে থাকে। তবে যেসব নারীর স্তন ছোট তারা যে পরিমাণ দুধ উৎপন্ন করে; যেসব নারীর স্তন বড় তারা একই পরিমাণ দুধ উৎপন্ন করে। অর্থাৎ স্তনের আকার বড় বা ছোট তার উপরে দুধের যোগান-পরিমাণ নির্ভর করে না। শিশু যখন দুধ খায় তখন মা- এর স্তনের বৃন্ত বিশেষভাবে সঙ্কুচিত হয়। এ থেকে মা অনেকটা যৌনতৃপ্তি অনুভব করে। ঠান্ডা পরিবেশে যেমন আমাদের হাত পা কুঁকড়ে যায়; উত্তেজনার বসে স্তনবৃন্তে সঙ্কুচিত হওয়াটা অনেকটা সেইরকম।
স্তনের বৃন্তের চারপাশে ছোট গাঢ় এলাকা থাকে। যাকে বলা হয় অ্যারিওলা (Areola)। এই শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ অ্যারিওলা(Areola) থেকে, যার অর্থ হল ছোট জায়গা। গর্ভাবস্থায় নারী স্তনের অ্যারিওলা গাঢ় হয়ে যায় এবং তা আকারেও একটু বাড়ে। এই অ্যারোলাতে বেশ কিছু পরিবর্তিত ঘর্মগ্রন্থি থাকে। যেমন-মন্টগোমারি (Montgomery gland) গ্রন্থি। এই গ্রন্থি বিশেষ রস নিঃসরণ করে এবং স্তনের অ্যারোলাকে পিচ্ছিল রাখে। ফলে পুঁচকি শিশুর নরম ওষ্ঠ সহজেই স্তন পান করতে পারে।
স্তনের মধ্যে থাকা লোবিউস ও নালিকাগুলি চর্বি দ্বারা চারপাশ থেকে ঘেরা  থাকে। স্তনের ভেতরে থাকা বিভিন্ন লিগামেন্টের মাধ্যমে লোবিউস ও নালিকাগুলি ঝুলে থাকে। সাধারণত স্তনে কোন পেশী থাকে না। এটি বুকের পেশীর উপর অবস্থান করে। সেকারণেই নারীর স্তন স্থিতিস্থাপক এবং তুলতুলে। সে কারণে পুরুষেরা নারীর স্তনমন্থনে এক ভিন্ন অনুভূতি পায়। স্তনের মধ্যে রয়েছে রক্তবাহী নালী, লসিকা নালী বা লিম্ফ্ (Lymph)। লসিকানালীগুলি রক্তনালীর মতই; তবে এর ভিতরে রক্ত থাকে না। থাকে কলার রস। যেগুলি আবার রক্তস্রোতে মিশে যায়। এই কলা রস হাতের নিচে থাকা এক্সিলা (Axilla) ও বুকের মাঝের হাড় বা স্টার্নাম (Sternum) এর প্রবাহিত হয়। যদিও স্তনের প্রাথমিক কাজ শিশুর দুগ্ধ যোগান দেওয়া। তবুও বহু শতাব্দী ধরে সমাজ সভ্যতায় স্তনকে নারীর সুন্দর ও নারীত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

স্তনের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন মহিলার ক্ষেত্রে স্তনের আকার ও গঠন বিভিন্ন হয়। এমনকি একই মহিলার স্তনের গঠন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কৈশোরে একরকম, যৌবনে একরকম, গর্ভাবস্থায় একরকম, রজঃনিবৃতি বা মেনোপজের সময় আরেক রকম হয়ে থাকে।
ভ্রুণের বয়স চারসপ্তাহ হলেই স্তনের গঠন শুরু হয়ে যায়। এটা দু’পাশ থেকে আসা দুটো শৈলশিরার মত থাকে। বগলের নিচ থেকে শুরু করে স্তনবৃন্ত হয়ে পায়ে কুচকি পর্যন্ত চলে আসে। এটাকে দুগ্ধ রেখা বলা হয়। এই রেখার উপর যে কোন জায়গাতে স্তন গঠিত হতে পারে। তবে স্বাভাবিক ভাবে বগলের নিচে স্তনের গঠন হয়ে থাকে। কখনও সখনও স্তনের অস্তিত্ব চোখে পড়েনা। স্তন ও স্তন বৃন্ত হয় না। এই অবস্থাকে বলে অ্যামাসটিয়া (Amastia) । তবে এ থেকে কোন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না।
নারী স্তনে বহু ধরনের অসুখ বিসুখ দেখা যায়। সিস্ট, বিনাইন টিউমার থেকে শুরু করে ক্যানসার পর্যন্ত। লৌকিক লজ্জা কাটিয়ে এবিষয়ে মেয়েদের সচেতন হতে হবে। এর পাশাপাশি স্তনের আকার নিয়ে অনেক মহিলার মধ্যে অনেক ধরনের ভাবনা, সংস্কার রয়েছে।
আসলে আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে হবে আপনাকেই। আপনার হয়ে এই কাজটি অন্য কেউ করে দেবে না। আপনার স্তন আপনার শরীরের অংশ, আপনার দেহের দুটি মূল্যবান অঙ্গ। এই কারণে মূল্যবান নয় যে, আপনার স্তন দুটি পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়। বরং এই কারণে মূল্যবান যে দেহের এই অঙ্গে অসুখের কারণে আপনি প্রাণ হারাতে পারেন। এই স্তন দিয়েই আপনি আপনার সন্তানকে পীযূষ ধারায় তৃপ্ত করেন। আপনার স্তন দুটি কেবল পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি মাংস পিন্ড নয়। স্তনকে কীভাবে বড় করা যায়, সেটার চাইতে অনেক বেশী জরুরী এই যে কীভাবে আপনি একে সুস্থ রাখবেন। এ বিষয়ে পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।

Join our mailing list Never miss an update