এই নরদেহে- সতীচ্ছদ নয়; যোনিপর্দা

এই নরদেহে- সতীচ্ছদ নয়; যোনিপর্দা

আমাদের এই নরদেহের গঠনশৈলীতে রয়েছে বহু বিস্ময়ের ছোঁয়া। শরীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে নিয়ত ঘটে চলেছে চমকপ্রদ ঘটনাবলী। যা অনেকের কাছেই অজানা। তাই, এই সব নিয়ে প্রবাহ তিস্তা তোর্ষার পাতায় থাকছে ধারাবাহিক চিত্রায়িত তথ্যকথা  “ এই নরদেহে ” কলম ধরেছেন -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
"সতীচ্ছদ নয়; যোনিপর্দা বা যোনিচ্ছদ"
নারীদেহের এই অঙ্গটি নিয়ে বহুধরনের সংস্কার কুসংস্কার জড়িয়ে আছে। ইন্টারনেট জ্ঞান ভান্ডারের অভাবনীয় উন্নতি হলেও এখনো অনেক মানুষ মনে করেন নারীর সতীত্ব বা কুমারীত্ব নির্ণয় করার এটা একমাত্র পন্থা। সে কারণে নারীর যোনিদ্বার ঘিরে থাকা এই পাতলা পর্দাটির নাম হয়েছে সতীচ্ছদ ইংরাজীতে হাইমেন (Hymen)। এটি মূলত মিউকাস যুক্ত এপিথিলিয়াল টিস্যু বা বিশেষ আবরণী কলা দিয়ে তৈরী। এটি যোনির প্রবেশ মুখ আংশিক বা সম্পূর্ণ ঢেকে রাখে। মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে এই সতীচ্ছদ দেখা যায়।  হাতি, শিম্পাঞ্জি (Chimpanzee), ঘোড়া, সমুদ্রগাভী (Manatee), তিমি (Whale), দক্ষিণ আমেরিকার উটের মতো দেখতে প্রাণী লামা (Llama) -র যোনিপর্দা রয়েছে।
অনেকের ধারণা প্রথম যৌন সঙ্গমের সময় এই পর্দাটি ফেটে যায়। তারা ভাবে এই পর্দা ছিন্ন থাকলেই সে নারী আর কুমারী নয়। ইতিপূর্বে পুরুষ সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিল। এই ভ্রান্ত ধারণার ফলে অনেক ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক সন্দেহের বেড়াজালে চাপা পড়ে। স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। বিষয়টি তা নয়। শুধু যৌন সঙ্গমে নয়, বিভিন্ন কারণেই এই পর্দা ফেটে যেতে পারে। ঘোড়ায় চড়া, হাই জাম্প- লং জাম্প দেওয়া, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা হস্তমৈথুনের সময়ও এটি ছিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ নারীর কুমারীত্ব সতীচ্ছদ থাকা না থাকার উপরে নির্ভর করে না। সে কারণেই আমরা এই পর্দাটিকে ‘সতীচ্ছদ’ না বলে, ‘যোনিচ্ছদ’ বা ‘যোনিপর্দা’ বলবো। আমরা চাই- এই পৃথিবীর সকল অভিধান থেকে সতীচ্ছদ শব্দটি চিরদিনের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাক্ ।
প্রথম মিলনে অনেকেই ভাবেন কুমারী নারীর যোনিচ্ছদ ফেটে রক্তপাত হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণামূলক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে- শতকরা ৪০ জন নারীর যোনিপর্দা ছিন্ন হওয়ার সময় কোনরকমের রক্তপাত হয় না। প্রতি একহাজার কন্যা সন্তানের মধ্যে একজন বা দু’জন শিশুর জন্ম হয় যোনিচ্ছদ ছাড়াই। আফ্রিকান হাতিদের যোনিপর্দা সম্পূর্ণ ছিন্ন হয় সন্তান প্রসবের সময়।
    যোনিচ্ছদের নীচে একটি ছোট্ট ছিদ্র থাকে। সেখান থেকে মাসিক চক্রের সময় রক্ত বেরিয়ে আসে। তার সাথে বেরিয়ে আসে জরায়ুর দেওয়ালের ছিন্ন ভিন্ন কোষ- কলা। মাসিক চক্রে রক্তপাতের সময় জরায়ুর গাত্র থেকে এক বিশেষ তঞ্চন বিরোধী বা অ্যান্টিকোয়াগুলেটিং (Anti-coagulating) রাসায়নিক নিঃসৃত হয়। যার ফলে মাসিক চক্রের রক্ত দেহের অন্যান্য অংশের মত তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে শক্ত হয় না। কোন কোন নারীর ক্ষেত্রে এই তঞ্চন বিরোধী রাসায়নিকটি খুব কম পরিমাণে নিঃসৃত হয়। ফলে তাদের মাসিক রক্তপাত দলা দলা, কিছুটা শক্ত হয়ে থাকে। তারা মাসিক চক্রের সময় প্রচন্ড ব্যথাও অনুভব করে। এইসব কারণেই যোনিপর্দা  ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
যোনিপর্দা ছিন্ন হলেও শল্য চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে সেটি আবার তৈরী করা যায়। তাকে ডাক্তারী ভাষায় আমরা বলি হাইমেনোপ্লাস্টি (Hymenoplasty)। অনেক সময় বা যোনিপর্দা অতিমাত্রায় পুরু হয়ে গেলে তা যৌন সঙ্গমের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে সার্জারি করে যোনীপর্দা অপসারণ করা হয়। একে আমরা ডাক্তারী ভাষায় বলি হাইমেনোটমি (Hymenotomy)।
    হাইমেনপ্লাস্টি সাধারণত সেইসব দেশ বা অঞ্চলগুলিতে করা হয়; যেখানে পুরুষের মনে বদ্ধ ভ্রান্ত ধারণা রয়ে গেছে যে- যোনিপর্দা অক্ষত থাকা কুমারীত্ব বা সতীত্বের পরিচয়। সেক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে এমনভাবে নকল যোনীপর্দা বসানো হয় যাতে পুরুষের সাথে যৌন মিলনের সময় কিছুটা রক্তপাত ঘটে। এই অপারেশনটি করার জন্য হাসপাতালে থাকার তেমন প্রয়োজন হয় না। আমেরিকা, মধ্যপূর্ব আরব দেশগুলিতে, দক্ষিণ কোরিয়া, পশ্চিম ইউরোপে বিভিন্ন শল্যচিকিৎসক এই ছোট্ট সার্জারির পর দিনের দিন রোগীকে ছেড়ে দেন। কিছু কিছু দেশে এই অপারেশনের ক্ষেত্রে আইনিবাধা রয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই অপারেশনে তেমন কোন বিধিনিষেধ নেই। বেসরকারী ক্লিনিকগুলিতে এটা হামেশাই হয়ে থাকে। এই অপারেশন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আরবীয় মধ্যপূর্বের দেশগুলিতে বিশেষতঃ ইরান-এ। সেখানকার মহিলারা চান অন্তত বাসররাত পর্যন্ত তাদের কুমারীত্ব ধরে রাখাতে। এই বিষয়ে ইরানের ধর্মীয় নেতা সৈয়দ মহম্মদ সিদ্দিকি হুসাইনী (Sayid Mohammad Sadeq Hussaini) ফতেয়া দিয়েছেন যে; যদি কোন নারী এধরনের শল্য চিকিৎসা বা অপারেশনের সাহায্য নেয় তবে তাকে কুমারী নারী বলে ধরে নেওয়া হবে। এছাড়াও বিদেশের বাজারে নকল কুমারীপর্দা বেরিয়েছে এটা মহিলারা সহবাসের পূর্বে যোনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে রাখতে পারে। যেটাতে রক্তের মত কিছু কৃত্রিম তরল পদার্থ ভরা থাকে। যাতে সহবাসের সময় ফেটে গিয়ে কৃত্রিম রক্তপাত ঘটায়।

    যোনির পর্দার তেমন কোন শারীরবৃত্তীয় কাজ নেই। তবে কিছু শরীরবিজ্ঞানী বলেন- এটি যোনিদ্বারে বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিহত করে। এই যোনিপর্দার ছিদ্রটি বিভিন্ন রকমের হতে দেখা যায়। সে হিসেবে তাদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- স্বাভাবিক (Normal), বলয়াকার (Annular), বহুছিদ্রযুক্ত (Cribriform), দ্বিখন্ডিত (Septated), অবরুদ্ধ (Imperforate)। যোনিচ্ছদের সাথে কুমারীত্বের এই ভাবনা অনেক দেশের সভ্যতা সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের সাথে জড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে বিস্তর দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। গতবছর ২০১৮ অক্টোবর মাসে ইউনাইটেড নেশন হিউম্যান রাইটস্, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছেন এভাবে কুমারীত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতি অমানবিক আচরণের সমতুল্য।
    শৈশবে নারীদের যোনিচ্ছদ খুবই ক্ষুদ্র ও ছোট থাকে। প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিমিটার করে বড় হয়। বয়ঃসন্ধিক্ষণে ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এই যোনিপর্দা খুবই স্থিতিস্থাপক এবং চারিধারে একটু উঁচু সীমানার মত হয়। কোন কোন সময় যোনিচ্ছদে কিছু কিছু সংক্রামণ দেখা যায় তাকে ডাক্তারী ভাষায় বলা হয় হাইমেনিটিস (Hymenitis)।
সবশেষে একটি কথা মনে রাখা দরকার- দাম্পত্য সম্পর্ক এক দীর্ঘকালীন হৃদয়মেদুর বিষয়। এই সম্পর্কের ফল স্বরূপ ধরার বুকে ধরা দেয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। জীবনের এই পরম সন্ধিক্ষণে কেনই বা আমরা ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে; অতীতের ক্লেদ-পঙ্ক খুঁজে বেড়াতে যাব? ফুলসজ্জার নিশীথ রাতে কেন ‘রক্তপাত’ কাঙ্খিত হবে? তার চেয়ে গোলাপের রক্তিমতায় বর্ণময় হয়ে উঠুক নবদম্পতির নবজীবন। আসুন- দু’জনায় দু’জনাতে মুগ্ধ থাকি। মগ্ন থাকি- যা কিছু চির সুন্দর। দু’জনার মিতালী-র ছন্দে, হোক প্রাণময় দু’জনার অন্তর।

Join our mailing list Never miss an update