এই নরদেহে- সময়ের তালে তালে. .

এই নরদেহে- সময়ের তালে তালে. .

আমাদের এই নরদেহের গঠনশৈলীতে রয়েছে বহু বিস্ময়ের ছোঁয়া। শরীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে নিয়ত ঘটে চলেছে চমকপ্রদ ঘটনাবলী। যা অনেকের কাছেই অজানা। তাই, এই সব নিয়ে প্রবাহ তিস্তা তোর্ষার পাতায় থাকছে ধারাবাহিক চিত্রায়িত তথ্যকথা  “ এই নরদেহে ” কলম ধরেছেন -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
"সময়ের তালে তালে. . ."
আমাদের নরদেহের বহিরাঙ্গে দুটি মাত্র যৌনাঙ্গ আছে অর্থাৎ এই দুটি যৌনাঙ্গ বাইরে থেকে নজর পড়ে তার একটি হল পুরুষ লিঙ্গ, অন্যটি অন্ডথলি। বাকীগুলি থাকে তলপেটের ভেতর। অন্ডথলি ত্বক ও পাতলা পেশীস্তর দিয়ে তৈরী। এটি পেনিস বা লিঙ্গের নিচে ঝুলতে থাকে। এই অন্ডকোষকে আমরা ইংরেজীতে বলি স্ক্রোটম (Scrotum) । এই স্ক্রোটাম এর ভেতরে রয়েছে দুটি পৃথক পৃথক কক্ষ। এই থলির মধ্যেই থাকে পুরুষের প্রধান যৌন অঙ্গ বা শুক্রাশয়। শুক্রাশয় হল দুইটি ডিম্বাকৃতি গ্রন্থি যেখান থেকে তৈরী হয় পুরুষের যৌনজীব ‘শুক্রাণু’। যা নারী ডিম্বাণুর সাথে মিলেমিশে নতুন জীবনের সূচনা করে।
এই শুক্রাশয়ে পুরুষের বিভিন্ন যৌন হরমোন উৎপন্ন হয়। যার অন্যতম হল টেস্টোস্টেরন (Testosterone)। এই অন্ডথলিটি দেহের বাইরে কেন এভাবে ঝুলতে থাকে ? কেন নারী ডিম্বাশয়ের মতো থাকে না দেহের অভ্যন্তরে ? স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্নটি মাথায় আসতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন আমাদের দেহের ভেতরের যে তাপমাত্রা; সেই তাপমাত্রায় শুক্রাণু উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে কারণেই আমাদের এই নরদেহ জৈব বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অন্ডকোষটি দেহের বাইরে নিয়ে এসেছে। অন্ডথলির এই দেহের বাইরে আসার কারণে দেহের তাপমাত্রা থেকে অন্ডথলির তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট কম থাকে। সে কারণে যার সব সময় আঁটোসাটো অন্তর্বাস পরেন বা গরম আবহাওয়ায় থাকেন তাদের শুক্রাশয়ে শুক্রানুর উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম হয়।

অন্ডথলিটি যে ত্বক দিয়ে তৈরী হয় তা নির্দিষ্ট ভাবে দুটি অংশে বিভক্ত থাকে। বাইরে থেকে খালি চোখেই তা স্পষ্টত ধরা পড়ে। পেরিনিয়াল র‌্যাপ  (Perineal Raphe) দিয়ে বিভক্ত থাকে। এই লম্বা রেখাটি লিঙ্গের নিচ থেকে শুরু হয়ে একেবারে মাঝবরাবর গিয়ে মলদ্বারের কাছে চলে যায়। নারীর যোনী গহ্বরের নীচেও এই উঁচু রেখাচিহ্ণ দেখা যায়। অন্ডথলির ত্বকটি কোঁচকানো কোঁচকানো থাকে। ত্বকের গায়ে পিউবিক হেয়ার বা যৌন লোম থাকে। এই ত্বকের মধ্যে পাঁচ ধরনের পেশীস্তর রয়েছে। এটা অনেকটা কাপড়ের পাতলা স্তরের মতো। যৌন মিলনের সময় যখন পুরুষের উত্তেজনা চরমে ওঠে; তখন অন্ডথলিটি কুঞ্চিত বা ছোট হয়ে আসে। এই চাপ এর ফলে পুরুষ লিঙ্গ থেকে বীর্য নারীর যোনীপথে ছলকে ছলকে পড়তে থাকে। পুরুষাঙ্গ থেকে বীর্য নির্গত হবার গড়পড়তা বেগ ঘন্টায় ২৮ কিলোমিটার। বীর্যপাতের ক্ষেত্রে অন্ডথলিটি বিশেষ চাপ দেওয়ার ভূমিকাটি করে থাকে। মানসিক উত্তেজনা কমে আসলে অন্ডকোষ আবার শিথিল ও আবার প্রসারিত হয়ে পড়ে।
নারী যোনীর একদম বাইরে যে ওষ্ঠের মতো লিবিয়া মেজরা অংশটি থাকে, স্ক্রোটম তারই বিবর্তিত রূপ। বিজ্ঞানের ভাষায় বলি হোমোলগি (Homologi)। যখন কোন পুরুষ শল্যচিকিৎসার সাহায্যে নারী হতে চান; তখন সার্জেনরা এই স্ক্রোটম দিয়ে তার যোনীর বহিরঙ্গ তৈরী করেন। পুরুষের সাথে যৌন সঙ্গমের যোনীপথ তৈরী হয় পুরুষলিঙ্গের গোড়ায় থাকা নালীর নির্দিষ্ট অংশ কেটে।

স্ক্রোটাম এর ত্বকে রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট বেশি থাকার কারণেই এটির  রঙ দেহের অন্যসব ত্বকের তুলনায় বেশ গাঢ়। আমরা তো আগেই জেনেছি, আমাদের যৌন উত্তেজনা ও যৌনমিলনের সব কাজকারবার নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। অন্ডথলির বিভিন্ন কাজ পরিচালিত হয়  মূলতঃ চারটি স্নায়ুতন্তু দ্বারা। এগুলি হলো- ১) জেনিটাল ব্রাঞ্চ অফ জেনিটো ফেমোরাল নার্ভ (Genital branch of genitofemoral nerve), ২)এনটোরিয়ার স্ক্রোটাল নার্ভ (Anterior Scrotal nerves), ৩) পোস্টারিয়ার স্ক্রোটাল নার্ভ (Postenior Scrotal nerves), ৪) পিনাইল ব্রাঞ্চ অফ পোস্টেরিয়ার ফিমোরাল ফিটোনিয়াস নার্ভ (Penineal of posterior femoral cutaneous nerve) । এই স্নায়ুগুলি মস্তিষ্ক থেকে আসা বিভিন্ন সুর-ছন্দের সাথে তালে তাল মেলায়। কখনও অন্ডথলিকে সঙ্কুচিত করে; কখনও আবার প্রসারিত করে। কখনো আবার ঘর্মাক্ত করে তোলে অন্ডথলিকে। পুরুষ হৃদয়ে যৌন উত্তেজনা তৈরী হলে, তাতে সাড়া দিয়ে এরাও মেতে ওঠে তাতা থৈ থৈ ছন্দে।
সাধারণভাবে যে সব স্তন্যপায়ীরা স্থলে বাস করে তাদের মধ্যেই এই ধরনের অন্ডথলি বা স্ক্রোটাম দেখা যায়। জলে বাস করা তিমি, সীল, সমুদ্রগাভী এই ধরনের প্রাণীদের শুক্রাশয় দেহের বাইরে থলির মত ঝোলে না। দেহের ভেতরে মূলত্বকের নিচেই থাকে। বিবর্তন বিজ্ঞানীরা বলেন- যেহেতু তাদের জলের বাঁধা কাটিয়ে সাঁতরে ছুটে যেতে হয়; সেক্ষেত্রে এই দেহের বাইরে ঝুলে থাকা থলিটি ছুটে চলার গতিকে বাধা দিতে পারে। সেকারণেই তারা তাদের সামুদ্রিক পরিবেশ অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে। এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার আর্ডভার্ক (Aardvark), সোনালী ছুঁচো (Golden moles) এইসব পতঙ্গভোজী প্রাণী ও মাটির নিচে গর্ত করে থাকা বেশ কিছু প্রাণীদের এই অন্ডথলি থাকে না। এক্ষেত্রেও সেই একই কথা অর্থাৎ এদের চলাফেরার ধরনটা এমনই যেখানে অন্ডথলি থাকলে তাদের অসুবিধায় পড়তে হয়। আসলে সব জীবদেহের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই এক প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফল। জীববিজ্ঞানীদের মতে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৪৫০ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। প্রায় ২৫০ কোটি বছর আগে ধরার বুকে ধরা দেয় প্রাণের স্পন্দন। তারপর থেকে বিস্তর রদ বদল হয়েছে জীবের অঙ্গ ও তন্ত্রের। ইতিমধ্যে কেউ বা চিরতরে হারিয়ে গেছে এই ধরার বুক থেকে। কেউ বা প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে আছে এই বসুন্ধরার বুক জুড়ে। সবশেষে আমরা মানুষ হেমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens sapiens)  বসে গিয়েছি জীবদুনিয়ার মসনদে।

Join our mailing list Never miss an update