মোটর নিউরোন ডিজিজ -এখনো এক চ্যালেঞ্জ

মোটর নিউরোন ডিজিজ -এখনো এক চ্যালেঞ্জ

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ২২ নভেম্বর ২০০৮;  পৃষ্ঠা-তিন -এ  প্রকাশিত

আমাদের শরীর জুড়ে রয়েছে এক সুবিশাল স্নায়ুর জাল। এই স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভস সিস্টেমের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি আমরা উপলব্ধি করতে পারি। প্রয়োজনে সেই উপলব্ধি বা উত্তেজনায় সাড়া দিয়ে থাকি। একটা ছোট উদাহরণের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা সহজে বোঝা যেতে পারে। যেমন, আপনার পায়ে কাঁটা ফুটলো সেই বেদনা আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় স্নায়ুতন্তুর মাধ্যমে। মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ আসে আপনার পা টাকে সরিয়ে নেওয়ার। এই নির্দেশ সবার প্রথমে আসে পায়ের মাংসপেশীতে, মাংসপেশী নড়াচড়া করে বা সঙ্কুচিত করে কাঁটা বেছানো পথ থেকে আপনার পা-টিকে সরিয়ে ফেলার। মস্তিষ্ক থেকে পেশীতে যে সব স্নায়ুকোষের মধ্যে দিয়ে নির্দেশ আসে; সেই স্নায়ুকোষগুলিকে বলে মোটর নার্ভ । এই মোটর নার্ভ বা স্নায়ুকোষ নিউরোনের মধ্যে দিয়ে আসা সংকেতটা আসলে বৈদ্যুতিক সংকেত । কোন কারনে এই বৈদ্যুতিক সংকেত না পৌঁছালে বা মোটর নিউরোন কোষগুলি ঠিকমত কাজ না করতে পারলে মাংসপেশীগুলির উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ আপনার ইচ্ছা করছে পা-টিকে সরিয়ে নেবার; কিন্তু আপনি সেটা পারছেন না। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার যে, আমাদের শরীরে যে পেশী রয়েছে তাকে মোটামুটি ভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন- যে পেশীগুলিকে আমরা ইচ্ছামতো নাড়াচড়া করতে পারি তাকে বলে ঐচ্ছিক পেশী।
    রোগীর হাত থেকে জিনিস পড়ে যায় বিশেষত শিশি, বোতলের মুখ খোলা, কলের মুখ বন্ধ করা এসব ক্ষেত্রে রোগী অসুবিধা বোধ করে। রোগী তার হাঁটাচলায় ভারসাম্যের অভাব লক্ষ্য করে এবং মাঝে মাঝে টাল খায়। আক্রান্ত পেশী আরষ্ঠ হয়ে আসে এবং হেঁচকা টান লাগে। বিশেষত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে রোগীর বড় অসুবিধা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগটি দীর্ঘদিন হয়ে গেলে তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তবে গবেষণা থেকে দেখা গেছে রোগীর পায়খানা ও প্রচ্ছাবের বেগ নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন কষ্ট হয় না। রোগীর কানে শোনার শক্তি, চোখের দৃষ্টি শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষের মতোই থাকে।
    রোগের শেষ পর্যায়ে রোগীর কথাবার্তা, কোন কিছু খাবার চিবানো বা গেলার মতো অবস্থা থাকে না। রোগী পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস-এর সাথে মোটর নিউরোন ডিজিজের মূল ফারাকটা হল পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর যে অংশে পক্ষাঘাত হয়েছে সেই অংশ অসাড় বা অবশ হয়ে পড়ে। সেই অংশে হাত দিলে সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মোটর নিউরোনের ক্ষেত্রে রোগীর আক্রান্ত অংশে সাড় থাকে অর্থাৎ ছুলে বা মশা কামড়ালে সে বুঝতে পারে; শুধু সে নাড়াতে পারে না। রোগ আক্রমণের পর কতদিনে তা মারাত্মক আকার ধারন করবে বা রোগ লক্ষণ কতদিনে রোগীটিকে পুরোপুরি অসুস্থ করে দেবে সেই সময় কাল এক একটি রোগীর কাছে একেক রকম হয়। ব্রিটিশ মোটর নিউরোন ডিজিজ অ্যাসোসিয়েশন এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে তিন বছরের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ(৫০%) রোগী পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। দশ শতাংশ(১০%) রোগীর ক্ষেত্রে এই সময়টা লাগে দশ বছর। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে রোগ আক্রমণের কুড়ি বছর পর্যন্ত সে মোটামুটি নিজের কাজ নিজে করতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগলক্ষণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আবার কোন রোগীর ক্ষেত্রে বছরের পর বছর অবস্থা একই রকম থাকে। একটা কথা মনে রাখা দরকার মোটর নিউরোন ডিজিজে রোগীর বুদ্ধি, মেধা ও স্মৃতিশক্তি কোনভাবেই নষ্ট হয় না, শুধু মাত্র সচল অংশ ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে।
মোটর নিউরোন ডিজিজ নিয়ে এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক গবেষণা চলছে। তবে এ রোগের প্রকৃত কারণ এখনও সঠিকভাবে জানা যায় নি। অর্থাৎ কি কারণে একজন রোগী এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়; তা এখনও রহস্য ঘেরা। মোটর নিউরোন ডিজিজের রোগ নির্ণয় বেশ জটিল। যেহেতু এই রোগ খুব অল্প সংখ্যক মানুষের হয় তাই প্রথম পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ে ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা বেশ বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন।
  

Join our mailing list Never miss an update