পুড়লো আমার প্রেমের প্রথম পাঠ; -ডাঃ পার্থপ্রতিম।
তখন সবে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছি। চা বাগিচা ঘেরা ডুয়ার্সের এক গঞ্জ। মূলতঃ পূর্ব পাকিস্থান থেকে আসা বাঙলাভাষী মানুষের ভাবনা ও প্রয়াসে গড়ে উঠেছে এই শিক্ষা নিকেতন। বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়। আমাদের স্কুলে তখন লাইব্রেরিয়ান ছিল না। ইতিহাস পড়ানোর পাশাপাশি লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব সামলাতেন মন্ডল স্যার। শৈলেন কুমার মন্ডল। লাইব্রেরিতে আনা নতুন বইগুলি তিনি প্রথমে বেশ মন দিয়ে পড়তেন। তারপর মার্কা লাগাতেন। কোনটা এক- দুই- তিন, কোনটিতে দুই- তিন- চার, কোনটা আবার তিন- চার- পাঁচ-ছয়। এক মার্কার বইগুলি শুধুমাত্র ক্লাস ফাইভের জন্য উপযুক্ত। দুই ছিল ক্লাস সিক্স এর। এভাবেই শুধুমাত্র একাদশ শ্রেণীর ছেলেমেয়েরাই পাবে ছয় মার্কা দেওয়া বই।
আমাদের ছোটবেলায় বই পড়ার একটা চল ছিল। ফোর ফাইভ থেকেই পড়ে চলেছি। বিভিন্ন রকমারী বই। সেই সময় জন্মদিন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বই উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। এমন কী বিয়ে, বৌভাতে কোন বাড়ির একজনকে নিমন্ত্রণ করলে তিনি একটি বই হাতে নিয়ে আসতেন। গিফট্ হাউসের ধারালো নখর তখনো আঁচড় কাটতে পারেনি বইবাজারের শ্যামল হৃদয়ে। ক্লাসে পড়ার বই থেকে উলটোপালটা বইই বেশি পড়ার ঝোঁক ছিল। এরিক মারিয়া রেমার্ক, ভিক্টর হুগো, ক্যাথারিন ম্যানসফিল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জন গলস্ওয়ার্দি, ন্যুট হ্যামসুন, আলেকজান্ডার ডুমা আরো সব অনুবাদ বিদেশি সাহিত্য তখন গোগ্রাসে গিলছি। আমার সাথী ছিল গৌতা ও সুবল। বই পড়ার প্রতিযোগিতা চলতো ওদের সাথে।
স্কুল লাইব্রেরীর তাক ঘেঁটে ঘেঁটে আমরা বই পছন্দ করতাম। তারপর তা দিতে হতো মন্ডল স্যারের হাতে। মন্ডল স্যার ক্লাসে ইতিহাস পড়াতেন। হাতে ম্যাপ নিয়ে ক্লাসে আসতেন। ম্যাপ দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন পলাশীর প্রান্তরে কোন দিকে দাঁড়িয়ে আছে মোহনলাল মিরমদন আর কোন পাশে ক্লাইভের সেনা। পড়াতেন বললে ভুল হবে। তিনি যেন মনের পটে ছবি আঁকতেন। গলায় ছিল অসাধারণ মডিলিউশন আর নাটকীয়তা। পড়াতে পড়াতে অভিনয় করে দেখাতেন। কী ভাবে শিবাজি আর শম্ভুজি ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে পালালো; তা যেন আজও চোখ বুজে দেখতে পাই।
মন্ডল স্যারের একটি বিষয় ছিল। প্রতি মাসে একজন বা দুজন ছাত্রকে ধরে তিনি শাস্তি দিতেন। সেটা ঠিক শাস্তি নয়; বেদম পেটানো। তার মার খেয়ে অজ্ঞানও হয়েছেন অনেকে। সব সময় যে সঠিক আপরাধীকে পেটাতেন তা নয়। তাছাড়া কখন, কাকে, কী কারণে মন্ডল স্যার ধোলাই দেবেন; তারও কোন গ্রামার ছিল না। সেসময় রাইট টু এডুকেশন বা সেই ধরনের আইন কানুন ছিল না। ছাত্র পেটানোটা কোন আপরাধ ছিল না। তাছাড়া স্কুলে মার খেয়েছি এ কথা বাবার কানে গেলে, তিনিও বাকীটা পুষিয়ে দিতেন। তাই সে মার খাওয়াটা ছিল চোরের মার খাওয়ার মতোন। মন্ডলস্যারের কাছে আমরা একটু ভয়ে ভয়ে থাকতাম।
প্রতি সপ্তাহে একটি ক্লাস স্কুল লাইব্রেরীর জন্য বরাদ্দ থাকতো। স্কুল লাইব্রেরীতে অনেক ঘেঁটে বার করলাম বইটি। বইটির মলাটে গির্জার পটভূমিকায় এক সুন্দরী সদ্য যুবতী, কোলে ধরা আছে একটি ছাগ শিশু। ছবি পেছনে অস্পষ্ট কিছু একটা। ছবিটি ফটোগ্রাফ নয়, হাতে আঁকা রঙিন। ভিক্টর হুগোর লেখা ‘দ্যা হাঞ্চব্যাক অব নোত্রদাম’। বইটি মন্ডল স্যারের হাতে দিতেই তিনি দেখলেন পাঁচ মার্কা। না, পার্থপ্রতিম হবে না। এই বই পড়তে হলে তোমাকে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমিও অন্য বই না বেছে দরজার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। ক্লাস শেষ হতে চলছে। সহপাঠিরা সবাই ফিরে গেছে লাইব্রেরী ছেড়ে। স্যার বললেন- কী রে, তোর কী ব্যাপার। কাতর কন্ঠে বললাম, স্যার বইটি দিলে একটু পড়তাম। বেশী কিছু বলার সাহস নেই। কী জানি স্যারের কী মনে হলো, বইটি হাতে দিয়ে বললেন; পড়া বাদ দিয়ে পড়িস না।
তখন বাড়িতে বিজলি বাতি আসে নি। রাতে এ্কটি হ্যারিকেন আলোয় আমি, ছোড়দি, কালাদা পড়তে বসতাম। সেখানে অন্য কিছু পড়ার সুযোগ নেই। ভোরের আলো ফুটতে বই নিয়ে ছুটলাম তপনদের কাঁঠালতলায়। লুকিয়ে চুরিয়ে দুু’দিনেই শেষ করলাম বইটি। বইটির নায়ক কোয়াসিমোন্দা। থাকতো সেইন নদীর ধারে নোত্রদাম গির্জায়। একজন কুৎসিৎ, বোকা হাবড়া লোক। পিঠে বড়সড়ো কুঁজ। এক চোখের ওপর বেশ বড় অর্বুদ, দানবের মতো বলশালী। সে গির্জার ভারী ঘন্টা ‘ইমানুয়েল’ টি বাজাতো। গির্জার পেল্লায় পেল্লায় ডজন দুই ঘন্টা বাজিয়ে বাজিয়ে সে বধির হয়ে গেছে। সে প্রেমে পড়ে বেদেনী সুন্দরী এসমেরালদা র। প্রেক্ষাপটটি মর্মস্পশী। বিচারকের আদেশে কশাঘাতে রক্তাক্ত, তৃষ্ণার্থ কোয়াসিমোন্দা পড়ে আছে রাজপথে। শাস্তির ঝুঁকি নিয়ে তার মুখে জল ঢেলে দেয় এসমেরালদা। আবার অন্য অপরাধে ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত এসমেরালদাকে রাজসৈনিকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গির্জার মধ্যে লুকিয়ে রাখে কোয়াসিমোন্দা। শেষমেশ ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হয় এসমেরালদাকে। প্রথাগতভাবে তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় মন্টফকনের গুহায়। বহুকাল পর গুহায় দেখা যায় এসমেরালদার কঙ্কালকে জড়িয়ে রয়েছে এক বড়সড় কুঁজো দানবের কঙ্কাল।
সেটা কী প্রেম ? না কী অন্য কিছ; তা বোঝার বয়স তখনো সে ভাবে হয় নি। সবে এইট-এ উঠেছি। গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। স্বপ্নমেদুর মনে উঁকি দিচ্ছে অনাগত বসন্ত। মাঝে মাঝে রাত বিনিদ্র কাটে। মন আনমনা হয়। আড় চোখে দেখছি সহপাঠিনীদের। খুব সম্ভবতঃ সেটাই আমার পড়া প্রথম প্রেম কাহিনী। কেমন যেন নিজেকেই কোয়াসিমোন্দা ভাবতে লাগলাম। মন ঘুরতে লাগলো ক্যাথিড্রালের আনাচে কানাচেতে। মনে মনে ছবি আঁকলাম নর্থ রোজ উইন্ডো, বেল টাওয়ার, কারুকাজ করা গোল ছাদের।
গত ১৬ই এপ্রিল আগুনে পুড়ে গেছে আটশো বছরের পুরোনো গির্জাটি। টিভির পর্দায় দেখলাম লেলিহান শিখা স্পায়ারের নিচের অংশ থেকে গ্রাস করছে গোটা ছাদটাকে। ভেঙ্গে পড়ছে তিনশো ফুট উচুঁ চূড়া। ধোঁয়ার কুন্ডুলি পাঁক মেরে উঠছে প্যারিসের আকাশে। তারই সাথে পুড়েছে যেন আমার প্রেমের প্রথম পাঠ।