বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইলেট্রনিক্সের ভেল্কি

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইলেট্রনিক্সের ভেল্কি

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইলেট্রনিক্সের ভেল্কি; ডাঃ পার্থপ্রতিম।  ৯ই মার্চ, ১৯৯২(সোমবার) দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত

  বুশ-সাদ্দাম লড়াইয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার যুদ্ধ বেঁধে গেল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। যে যার রণকৌশল নিয়ে এগিয়ে চলছে। যুদ্ধ নয়, বিশ্বযুদ্ধ বলাই ভালো। পৃথিবীর মানচিত্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে নয়টি সেনা-বাহিনী। অস্ত্রভান্ডারে স্কাড, পেট্রিয়ট, হ্যারিকেন বোমা নেই। আছে লেগ কাটার, মিডিয়াম পেস, বউন্সার, হুক, কভার ড্রাইভ, স্টেট ড্রাইভ.....আরো কত কী। ইরাকী যুদ্ধ আমেরিকাবাসীরা সরাসরি দেখেছিলেন-সি এন এন দূরদর্শনের দৌলতে। এবারে বিশ্ববাসীর চোখের সামনে এ বিশ্ব যুদ্ধের জীবন্ত কভারেজ তুলে ধরেছে চ্যানেল নাইন।
    হ্যাঁ, পঞ্চম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইলেকট্রনিক্স ভেল্কি দেখাচ্ছে মিঃ ক্যারি প্যাকারের চ্যানেল-৯। পিচের কাছে মাইক্রোফোন তো আগেই ছিল। এবার এদের সর্বাধুনিক সংযোজন ‘স্ট্যাম্প কাম’। জাপানী সোনি কোম্পানীর তৈরি লিপস্টিক সাইজের ছোট্ট ক্যামেরা দুটি দু’পাশের মিডিল স্ট্যাম্পের ভেতরে লুকিয়ে থেকে সবসময় নজর রাখছে ব্যাটসম্যান ও বোলারের ওপর। ক্যামেরাটি এত শক্তপোক্ত যে, উইকেটে যত জোরেই বল লাগুক না কেন ক্যামেরার কোন ক্ষতিই হয় না। না, ক্যামেরা না বলে এক ক্ষুদ্রে টিভি সেন্টার বলা যেতে পারে। ছবি তুলে তাকে কম্পোজিট ভিডিও সিগন্যালে রূপান্তরিত করে বেতার মাধ্যমে পাঠিয়ে  দেবে স্টেডিয়ামের টেলিভিশন কন্ট্রোল রুমে। সেখানকার নির্দিষ্ট রিসিভার সেটে আবার ফুটে উঠবে সে ছবি। এল বি ডব্লু সিদ্ধান্ত ঠিক কি না অথবা বল কতটা ঘুরছে তা এই ক্যামেরায় দেখে দর্শকেরা নিজেই বুঝে নিতে পারবেন।

  মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে বারোটি টিভি ক্যামেরা। মাঠের বাইরে একটি ক্যামেরা রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচু হাইড্রোলিক ক্রেনের মাথায়। তার নিষ্পলক চোখ খুঁজে চলেছে শহরের মনোরম দৃশ্যগুলি। প্রতিটি ক্যামেরার জন্য কন্ট্রোল রুমে আলাদা আলাদা টিভি সেট ছাড়াও রয়েছে আঠারোটি বিশেষ মনিটারিং অসিলোস্কোপ। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তা দেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কোন্ ছবিটি দেখানো হবে, সেটি তখনই রিলে করা হচ্ছে। ‘পিপ’ বা ‘পিকচার ইন পিকচার’ পদ্ধতিতে একই সঙ্গে দুটি বা তার বেশি ক্যামেরার ছবি পৌঁছে যাচ্ছে দূরদর্শন দর্শকের কাছে। এছাড়াও রয়েছে একটি মিনি সুপার কম্পিউটার যার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে অতীতের বিভিন্ন খেলার ফলাফল, খেলোয়ারদের ব্যাক্তিগত রান, বোলিং সাফল্য, খেলার বিভিন্ন রেকর্ডস... আরো কত কী। প্রয়োজন মতো আঙ্গুলের পরশেই সেগুলি আবার চলে আসছে ডিসপ্লে স্ক্রিনে।
    কম্পিউটার গ্রাফিক্সের চমকও কম নয়। লেখচিত্রের মাধ্যমে দর্শককে মাঝে মাঝেই দু’দলের তুলনামূলক অবস্থা বা ‘গ্রাফিক্যাল কমপ্যারিজন অব প্লেয়ারস’ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রয়েছে ‘ওভাল ডায়াগ্রাম’, একজন ব্যাটসম্যানের পঞ্চাশ ও শতরান হলেই পর্দায় ভেসে উঠছে একটি ইলিপস বা উপবৃত্ত, যা  থেকে জানা যাচ্ছে ব্যাটসম্যানের কোন জায়গায় বল পাঠিয়ে কত রান পেয়েছেন। ‘ভিডিও ভিসন মিস্কিং-এর সাহায্যে ফিল্ডিং-এর পরিবর্তন ছোট ছোট তীর দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে দর্শককে। কোন ব্যাটসম্যান শূন্য রানে আউট হলে একই পদ্ধতিতে বেচারাকে হাঁস বানিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্যাভেলিয়নে।
    একটি খেলা শেষ হওয়ার পরেই চ্যানেল নাইনের কর্মীরা যন্তর-মন্তর নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন এক ক্রীড়াঙ্গন থেকে আর এক রণাঙ্গণে। চ্যালেন নাইনকে যাঁরা প্রায় রূপকথার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সেই সব পরিশ্রমী কুশীলবেরই একজন- ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক টনি গ্রেগ। গ্রেগসাহেব বললেন- ‘মাঠে যাঁরা খেলছে তাদের থেকে আমরা কোন অংশে কম চাপ নিচ্ছি না। বরং আমার মনে হয়, এর থেকে মাঠে নামলেই অনেক কম ধকল সইতে হতো।’ মাঠের আবহাওয়া বোঝার ক্ষেত্রে অধিনায়কদের সাহায্য করতে এসেছে ছোট্ট ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র ‘এরোগার্ড ওয়েদার ওয়াচ।’ এ-ই বলে দিচ্ছে-মাঠের উষ্ণতা, বৃষ্টিপাতের  সম্ভাবনা, হাওয়ার গতি। এ যন্ত্রের এল ডি আর যা ‘লাইট ডিপেন্ডেবল রেজিস্টার’ জানাবে সূর্যকিরণের তীব্রতা। আপেক্ষিক আর্দ্রতা মাপার জন্য বড়সড় রেনাল হাইগ্রোমিটারের দরকার নেই। এরোগার্ড পিচ পরীক্ষা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের আবহাওয়াগত সুবিধা-অসুবিধা সব বলে দিতে পারে।

চ্যানেল-৯ এর বিশেষজ্ঞ সমাবেশ একেবারে সোনায় সোহাগা-রিচি বেনো বির লরি, গ্রেগ ও ইয়ান চ্যাপেল, টনি গ্রেগ, সুনীল গাভাস্কার, রিচার্ড হ্যাডলির মতো প্রাক্তন তারকারা সর্বদা মতামত জানাচ্ছেন। বোলার, ব্যাটসম্যান, ফিল্ডার ছাড়াও দূরদর্শনের পর্দায় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে সুন্দরী তম্বী বা কচি-কাচাঁ দর্শকদের ভোলাভালা মুখ। উপরিপাওনা ফুজি কোম্পানির ‘ব্যানার অব দ্য ডে’ তো রয়েছেই। দূরদর্শন দর্শকদের কোন মতেই যাতে একঘেয়েমী না লাগে তার জন্য প্রায় শ’তিনেক কর্মী করে চলেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম।
চ্যানেল নাইনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ব্রিয়ান মোরিল দাবি করলেন - তাঁদের সম্প্রসারণের মায়াজালে এ কয়েকটি দিন ক্রিকেটপ্রেমীদের বেঁধে বসিয়ে রাখবেন দূরদর্শনের সামনে। আমরাও অধীর আগ্রহে বসে থাকবো। দেখবো, পঞ্চম বিশ্বকাপের শেষ খেলার শেষে কার হাসিমুখটি ফুটে ওঠে ছোট্ট ইলেকট্রনিক্স বাক্সটিতে।


 

Join our mailing list Never miss an update