তৃনয়না টুয়াটারা

তৃনয়না টুয়াটারা

তৃনয়না টুয়াটারা
প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলে ঘেরা এই দেশটিকে দ্বীপপুঞ্জ বললেও ভুল হবে না। নিউজিল্যান্ডের উত্তরভূমির কাছে রয়েছে উঁচু-নীচু এক পাথুরে দ্বীপ, যেখানে সাধারণ মানুষের যাওয়া নিষেধ। একমাত্র বিজ্ঞানী ও গবেষকরা সেখানে যাওয়ার ছাড়পত্র পান। তার কারণ হল- সে দ্বীপে বসবাস করে এক অদ্ভুত বিরল প্রাণী, যার নাম টুয়াটারা। বৈজ্ঞানিক নাম- স্ফীনোডন পাঙ্কটাটাস (Sphenodon Punctatus) হলেও ডাক নামেই সবাই?
এরা পৃথিবীতে এসেছিল সম্ভবত ২০ কোটি বছর আগে। কচ্ছপ, কুমীর এমন কি ডাইনোসরস, টেরাডেকটাইলেরও তখনো আবির্ভাব ঘটেনি। সে সময়ে রিঙকোসাফেলয়ান (Rhynchocephalion) নামে একধরনের সূচালো মাথাওয়ালা সরীসৃপ দেখা দিয়েছিল। ওদেরই একটি শ্রেণী টুয়াটারা। অন্যসব জাতভাইয়েরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু যেভাবেই হোক বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে আজও এরা টিকে আছে। প্রাচীনতম এই প্রাণীটি সম্ভবত ২০ কোটি বছর আগেকার সরীসৃপদের মতো একই ঢংয়ে জীবনযাপন করে। তাই বৈজ্ঞানিকদের কাছে টুয়াটারা চাঞ্চল্যকর গবেষণার বিষয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণীরা কিভাবে বেঁচে থাকতো? টুয়াটারাদের জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করে গবেষকেরা তা জানার চেষ্টা করছেন।
দেখতে বড় সড়ো গিরগিটির মতো হলেও, ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় গিরগিটির সাথে এদের বিস্তর ফারাক। সারাটা দেহ শক্ত দানার মতো আঁশ দিয়ে ঢাকা। টুয়াটারা-র পিঠে ও পেটে পাঁচ থেকে সাত সারি খোঁচা খোঁচা ফলক আছে। দেখে মনে হয় লাইন বেঁধে দাঁত নেমে গেছে ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত। আসলে আঁশগুলিই এভাবে ঠেলে উঠেছে। মাথার হাড়গুলি সাধারণ সরীসৃপের চেয়ে অনেক বেশি শক্তপোক্ত। মেরুদন্ডের কষেরুকা লেটিওসরস, ডাইনোসরসদের মতো দু’পাশেই অবতল। গায়ের রঙ কারো গাঢ় বাদামী, কারো ধুসর, কারো বা আবার জলপাই সবুজ। দেহের ঐ নানারঙের জন্য সহজেই নজর কাড়ে।
জীবাশ্ম পরীক্ষা করে জানা গেছে জুরাসিস কালো অর্থাৎ ১৯-১৪ কোটি বছর আগে টুয়াটারা লম্বায় ছিল পাঁচ থেকে ছ'ফুট। কিন্তু এখন এরা মাত্র আড়াই ফুট লম্বা। খরগোস, গিনিপিগের মতো সামনের দু’পা দিয়ে গর্ত খোঁড়ে। সারাটা দিন গর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই বের হয় শিকারের খোঁজে। ঝিঁঝি পোকা ও ওয়েটাস নামক ঘাসফড়িং এদের খুব প্রিয়খাদ্য। তবে মাকড়সা, কেঁচো, পাখির ডিম-বাচ্চা এসবও খেয়ে থাকে।
 সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল- আমাদের শিব, দুর্গা প্রভৃতি দেবদেবীর মতো টুয়াটারাদেরও রয়েছে তৃতীয় নয়ন। স্বাভাবিক দুইটি চোখের মাঝামাঝি জায়গায় থাকে এই তৃতীয় নয়ন বা পিনিয়াল আই। এটি চামড়া ঢাকা লেন্সের মতো, কোন আইরিস বা অক্ষিপেশী নেই। বিশেষ ধরনের স্নায়ু দিয়ে লেন্সটি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত। তৃতীয় নয়নটি কী কাজ করে তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও, প্রাণীবিদরা মনে করেন-এদের পূর্বপুরুষেরা পিনিয়াল আইটি দূরবীনের মতো ব্যবহার করতো। হেমন্ত শেষে শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে সব সরীসৃপেরা ঠান্ডায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। টুয়াটারা কিন্তু ব্যতিক্রম, এমন কি সাত ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রাতেও বেশ প্রাণবন্ত থাকে। আবার গরম ও জোরাল আলোতে এরা অস্বস্তি বোধ করে। তাই কিছু ভূবিজ্ঞানীদের ধারণা, এদের আবির্ভাবের সময় পৃথিবী  ছিল খুব ঠান্ডা। এরা শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে মিনিটে ৮ থেকে ৯ বার শ্বাস নেয় কিন্তু কখনো আবার ঘন্টায় একবার শ্বাস নিয়ে থাকে। লন্ডন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বিখ্যাতপ্রাণী বিজ্ঞানী ডঃ অ্যালবার্ট গুন্টার জানিয়েছেন- টুয়াটারা একশো বছর বা তার বেশি সময় বাঁচে।

অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের সব জায়গায় এরা অবাধে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ এখানে এসে ঘর বাঁধতে শুরু করে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসে ভেড়া, শূকর, বেড়াল কুকুর প্রভৃতি প্রাণী। মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীদের আক্রমণে দলে দলে এরা মারা পড়ল। একশো বছরের মধ্যেই নিউজিল্যান্ড থেকে লুপ্ত হলেও, কোন মতে একটি দ্বীপে টিকে গেল কয়েকটি টুয়াটারা। এদের কপাল ভালো, পৃথিবীর  বিভিন্ন প্রান্তের প্রকৃতিপ্রেমীরা এই বিরল প্রাণীটির সুসংরক্ষণের দাবীতে একজোট হলেন। রাষ্টসংঘের পরিবেশ দপ্তরের সাহায্যে নিউজিল্যান্ড সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে দ্বীপটি এদের জন্য বরাদ্দ হলো। তাই আজও পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছে তৃনয়না টুয়াটারা।
 

Join our mailing list Never miss an update