টান ধরেছে গাঁটে গাঁটে; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২০ জানুয়ারি ২০০৭; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
প্রথম দিকে ধরেই নিয়েছিলেন যে গুঁতোটুঁতো লেগেছে। এমনিতেই শঙ্করবাবু টু পাইস ফাদার-মাদার। টিভির বিজ্ঞাপন দেখে সপ্তাহখানেক মলম ঘসলেন। ছেলে টুম্পাও বাপ কা বেটা। ব্যাথা না কমাতে, দোকান থেকে কিছু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কিনে দিলেন বাবাকে। শেষমেষ আর উপায় না দেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একদিন চেম্বারে এসে হাজির। শুধু শঙ্করবাবু নয়, এ ঘটনা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। গাঁটের বাতকে প্রথম দিকে অনেকেই ঠিকমতো গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। গাঁটের বাত রোগকে আমরা বলি গাউট। তবে ডাক্তারি শাস্ত্রমতে গাউট কোনো নির্দিষ্ট রোগের নাম নয়। অনেক রকম উপসর্গকে এই নামে বোঝানো হয়। সাধারণভাবে মনোসোডিয়াম ইউরেট মানোহাইড্রেট জাতীয় কেলাস বা ক্রিস্টাল তথা স্ফটিক বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে জমা হয়ে এ ব্যাধির সৃষ্টি করে। আমাদের দেহের হাড়গুলি বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকে। যাকে প্রচলিত কথায় বরা হয় অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট। কিছু সন্ধি নড়াচড়া করা যায় না, এই সন্ধিকে বলে অচল সন্ধি বা ফিক্সড জয়েন্ট। মস্তিষ্কের করোটিতে এ ধরনের ফিক্সড জয়েন্ট থাকে। আমাদের দেহের যে সন্ধিগুলিকে নড়াচড়া করা যায় সেগুলির ভেতরে সাইনোভিয়াল মেমব্রন নামের ঝিল্লি থাকে। এই ঝিল্লি থেকে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড বা সন্ধিরস ক্ষরিত হয়। এই সন্ধিরস প্রতিটি সচল সন্ধিকে মসৃণ রাখে। সেদিক থেকে সাইনোভিয়াল ফ্লুইডকে ওপরওয়ালার দেওয়া লুব্রিকেণ্ট বলা যায়। গাউট একটি বিপাকক্রিয়া জনিত ব্যাধি বা মেটাবলিক ডিসঅর্ডার। আমাদের দেহে বিপাকক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন বিপাকজাত পদার্থ তৈরি হয় যা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। এগুলি প্রথমে রক্তে মেশে, তারপর পৌঁছায় কিডনিতে। কিডনিতে মূত্রের মাধ্যমে এ ধরনের অনেক ময়লাই দেহের বাইরে বের করে দেয়। ইউরিক অ্যাসিড হল সেইরকমই একটি বর্জ্যপদার্থ। কোনো কারণে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের ঘনত্ব বেড়ে গেলে, অ্যাসিডের কেলাস বা স্ফটিকগুলি দেহের হাড়ের জয়েন্টগুলির সাইরোভিয়াল ফ্লুইডের মধ্যে জমতে শুরু করে। ছোটো ছোটো সূচলো স্ফটিক বা ক্রিস্টালগুলি থেকে গাঁটের ব্যথা দেখা দেয়। ইউরিক অ্যাসিডের ঘনত্ব বেড়ে গেলে নতুন নতুন কেলাস তৈরির জন্য যেমন গাঁটে ব্যথা দেয়, তেমনই অনেক সময় অ্যাসিডের মাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়ার জন্য পুরোনো স্ফটিকগুলি ভেঙ্গে সুচলো ধারযুক্ত ছোটো ছোটো কেলাস গঠিত হয়। এদের খোঁচাও গাঁটে ব্যথা সৃষ্টি করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ হল শখের করাত। রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে যেমন গাউট হয়, তেমনই ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমে যাওয়াতে একই রকমের জ্বালা যন্ত্রণা হতে পারে। এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে অনেক চিকিৎসক ব্লাড সিরাম ইউরিক অ্যাসিডের ফলাফল দেখে বিভ্রান্ত হতে পারেন। অতিরিক্ত মদ্যপানে গাঁটে গাঁটে বাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। অ্যালকোহল লিভারকে উজ্জীবিত করে বলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়। মদ্যপানে কিডনির কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। বিয়ারও গাঁটের বাতের জন্য দায়ী। এখন তো অনেকে বিয়ারকে কোল্ড ড্রিংকস মনে করেন। ভাবেন, চিরতার জল দেহের তেমন ক্ষতি তো করবেই না বরং লাভই হবে। এই চিন্তা যাঁদের মাথায় আছে তাঁরা সাবধান। বিয়ারে থাকা পিউরিন আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রে পৌঁছে ভেঙ্গে গিয়ে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে।
সাধারণভাবে পূর্ণবয়স্ক পুরুষের ও রজঃবন্ধ হওয়ার পর মহিলাদের মধ্যে এই অসুবিধা বেশি দেখা যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে ব্লাড সিরাম ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মাত্রা ৩.৪-৭.০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। মহিলার ক্ষেত্রে এই মান ২.৫-৬.২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার। পুরুষদের ক্ষেত্রে যাঁরা মদ ও বিয়ারে আসক্ত তাঁদের মধ্যে একাধিক সন্ধিতে গাউটের লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে রজঃনিবৃত্তির পরে এই লক্ষণ দেখা যায়। যত লোক গেঁটে বাতে আক্রান্ত হন তার মধ্যে ১১ শতাংশ মহিলা। অল্পবয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগ খুব কমই দেখা যায়। মোট মহিলা রোগিনীর মাত্র ১৭ শতাংশ অল্পবয়সী মহিলা। কমবয়সী মহিলাদের মধ্যে যাঁরা আক্রান্ত হন তাঁদের মধ্যেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক বাত রোগের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অনেক সময় দেখা যায় রোগীর রক্তরস বা সিরামে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি রয়েছে, কিন্তু মাসের পর মাস তেমন কোন উপসর্গ নেই। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক অবস্থা। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, গ্রামবাসীর তুলনায় শহরবাসীর রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে। আরো দেখা গেছে চাউমিন, মটন রোল ফিশ ফ্রাই কাটলেট এইসব ফাস্টফুডের নামে যাঁদের জিভে জল আসে, তাঁদের তনু গাউটের অন্যতম মৃগয়াক্ষেত্র। গাউটের রোগীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় কিডনি দিয়ে ইউরেট-এর ঠিকমতো নিষ্ক্রমণ হয় না। বিশেষত রক্তে পিউরিনের মাত্রা বেশি হলে তা কিডনির কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
গাউট যখন প্রথম আক্রমণ করে তখন তা পায়ের পাতার বুড়ো আঙ্গুলের সঙ্গে যুক্ত মেটাটারসল ও ফ্যালেঞ্জেস হাড়ের সন্ধিতে আঘাত হানে। ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এই ঘটনা দেখা যায়। এছাড়া হাত ও পায়ের ছোটো বড়ো সন্ধি যেমন হাঁটু, কনুই, কবজি, হাত-পায়ের আঙুল আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত সন্ধিগুলি ফুলে ওঠে, লাল হয় ও গরম হয়ে ওঠে। সঙ্গে থাকে বেশ ব্যথা ও যন্ত্রণা। সাধারণভাবে দীর্ঘক্ষণ বিশ্রামের পর রোগী যখন প্রথম নড়াচড়া করতে শুরু করেন তখনই বেশি অসুবিধায় পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চলার সময় অথবা টয়লেটে বসে থেকে উঠতে গেলে পেশিতে যন্ত্রণার শেষ থাকে না। অনেক সময় গাঁট ফুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর জ্বর আসে। রক্তে ই এস আর বেড়ে যায়। রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। যাকে ডাক্তারি ভাষায় আমরা বলি লিউকোসিস।
এই উপসর্গগুলি কয়েকদিন বা সপ্তাহখানেক পর কমে যায়। কোনো চিকিৎসা না করলেও আপনা-আপনিই কমতে পারে। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। গাউটের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যখন বতাসে আর্দ্রতা বাড়ে। বসন্তকালে যখন মরা ডাল কচি ডালপালায় ভরে যায়, তখনো এই রোগের তীব্রতা প্রকট হয়। বাতের মধ্যে একমাত্র গাউটকেই সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়। রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্লাড সিরাম ইউরিক অ্যাসিডের ওপর ভরসা করলে চলবে না।
গেঁটে বাতের রোগীর ওজন যতটা কম রাখা যায়, ততই ভালো। সবসময় অল্প ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে হবে। ঘি, মাখন, আলু কম খাওয়া উচিত।