সমস্যা যখন থাইরয়েডে

সমস্যা যখন থাইরয়েডে

সমস্যা যখন থাইরয়েডে; ডাঃ পার্থপ্রতিম;  ৩০ জুন ২০০২ পৃষ্ঠা বারো; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
আজকাল অনেকেই ‘থাইরয়েডের প্রবলেমে’ ভুগছেন। সমস্যা দূর করতে নিয়মিত এলট্রক্সিন ট্যাবলেট খান। কিন্তু থাইরয়েড আসলে কী, শরীরে তার ভূমিকা কী, অনেকেরই জানা নেই। লিখেছেন ডাঃ পার্থপ্রতিম
আমাদের গলার নিচের অংশে স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংসের দু’পাশে থাকে থাইরয়েড গ্রন্থি। এটি দু’টি ডিম্বাকৃতি অংশ বা লোব দিয়ে তৈরী। এই লোব দুটি আবার ‘ইসথুমাস’ নামের যোজক দিয়ে যুক্ত থাকে। স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়ষ্কদের থাইরয়েড গ্রন্থির গড় ওজন ২৫ গ্রাম। থাইরয়েড গ্রন্থি গোলাকার, ডিম্বাকার, অনিয়তাকার অসংখ্য ছোট ছোট গ্রন্থিথলি বা ফলিকল নিয়ে তৈরী।
থাইরয়েড থেকে ক্ষরিত হর্মোন
থাইরয়েড গ্রন্থির প্রধান হর্মোন হল থাইরক্সিন বা টেট্রাআয়োডো থাইরোনিন, ডাক্তারি সমাজে এর ডাকনাম টিফোর। এছাড়াও ট্রাইআয়োডো থাইরোনিন নামে একটি হর্মোন ক্ষরিত হয়। যাকে সংক্ষেপে টিথ্রি বলে।

টিথ্রি এবং টিফোর হর্মোন দু’টি মোটামুটিভাবে একই ধরনের কাজ করে। এরমধ্যে টিথ্রি বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী, তবে টিফোর অনেক বেশি পরিমানে ক্ষরিত হয় বলে থাইরয়েড গ্রন্থির প্রধান হর্মোন বলে ধরা হয়। শুধু মেদবৃদ্ধির ক্ষেত্রেই নয়, দেহের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজের ক্ষেত্রে এই হর্মোন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টিথ্রি এবং টিফোর দেহের বিভিন্ন কলাকোষে খাদ্যবস্তুর জারণ বা অক্সিজেনের ব্যবহার বাড়িয়ে দিলে মৌল বিপাক হার (বেসাল মেটাবলিক রেট) অর্থাৎ দেহে তাপশক্তির উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। শীতকালে ঠান্ডা আবহওয়ার এই হর্মোনের ক্ষরণ বেড়ে গিয়ে দেহকে গরম রাখে। এ কারণে অনেকে একে তাপ উৎপাদক ক্যালোরিজেনিক হর্মোন বলে।
থাইরয়েড হর্মোনের প্রভাবে গ্লুকোজ অন্ত্র থেকে রক্ত ঠিকভাবে মিশে যায়। এর কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম বেশি হতে পারে। এই হর্মোন দু’টি রক্তে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলে দেহে প্রোটিন সংশ্লেষণে সাহায্য করতে পারে।
টিথ্রি এবং টিফোর হর্মোন দু’টি কলাকোষে লাইপেজ উৎসেচকের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেহে ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ কমিয়ে দেয়। সে কারণে রক্তে এ দুটির পরিমাণ কমে গেলে দেহের মেদ বৃদ্ধি ঘটতে থাকে।
থাইরয়েড থেকে হর্মোন ক্ষরণ কমলে কী হয় ?     
এই হর্মোনগুলির অভাবে শিশু জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয় আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্মরণশক্তি, বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের বাধা দেখা দেয়। থাইরয়েড হর্মোন অন্ত্র থেকে ভিটামিন বি টুয়েলভ-এর শোষণ বাড়িয়ে রক্তের লোহিত কণিকার উৎপাদনে সাহায্য করে। এই হর্মোনের অভাবে রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) দেখা দেয় ও একই সঙ্গে হৃৎপিন্ডের কার্যক্ষমতা কমে আসে। এসব ছাড়াও খিদে, খাবার ইচ্ছে, পরিপাক শক্তি বৃদ্ধি, এসব বহু কাজেই এই হর্মোনের প্রভাব রয়েছে।

থাইরয়েডকে কে নিয়ন্ত্রন করে ?  
আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত থাকা পিটুইটারি গ্রন্থি দেহের ভেতরের বিভিন্ন হর্মোন গ্রন্থিগুলিকে নিয়ন্ত্রন করে। এই কারণে একে বলে মাস্টারগ্ল্যান্ড। পিটুইটারি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হর্মোন সংক্ষেপে টি এস এইচ থাইরয়েড গ্রন্থির গঠন, কাজকারবার পরিচালনা করে। টি এস এইচ-এর প্রভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির আকার বৃদ্ধি পায় ও সুগঠিত হয়। এটি আবার থাইরক্সিনের উৎপাদন ও ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। পিটুইটারি থেকে টি এস-এইচ-এর ক্ষরণ কম হলে থাইরয়েডের সক্রিয়তা ও ক্ষরণ কমে আসে। এই অবস্থাকে বলে হাইপোথাইরয়েডিজম।
থাইরয়েডের হর্মোন ক্ষরণ কম হলে কী হবে ?
শিশুদের ক্ষেত্রে থাইরক্সিনের ক্ষরণ কম হলে বাচ্চা খর্বাকৃতি হয়, রোগীর পেট ও মুখে ফোলা ফোলা ভাব থাকে। পেশিগুলি দুর্বল হয়। একে বলে ক্রেটিনিজম। বয়স্কদের থাইরক্সিনের অভাবে চামড়া খসখসে হয়, দেহে মেদবৃদ্ধি ঘটে। কোষে প্রেটিন, লবণ, জলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে শোথ বা ইডিমা দেখা দেয়। মুখ ও দেহ ফুলে যায়, কারো কারো ক্ষেত্রে মাথা, ভ্রূ, বগলের চুল উঠতে থাকে। হৃদস্পন্দনের হার ও দেহের উষ্ণতা কমে যায়। রোগী শীতকাতুরে হয়ে পড়ে। অল্প ঠান্ডাতেই রোগী জামাকাপড়-সোয়াটার পড়ে। পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যেই এ রোগের প্রবণতা বেশি। এই রোগকে বলে মিক্সিডিমা।

স্থূলত্বের কারণ
মোটা হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। রক্তের টিথ্রি, টিফোর ও টি এস এইচ পরীক্ষা করলে থাইরয়েড সংক্রান্ত গোলযোগের খবর পাওয়া যায়। এই পরীক্ষার খরচ ৬০০-৮০০ টাকা। বড় বড় শহরের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটারি ছাড়া এই পরীক্ষা করা যায় না। তবে মফস্বলের কিছু ক্লিনিক রোগীদের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে তা সংরক্ষিত করে বড় ল্যাবরেটারিতে তা পাঠিয়ে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে থাকেন।
রক্তে থাইরয়েডের পরিমাণ ও তার নিয়ন্ত্রণ
মোটামুটিভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির রক্তে বিভিন্ন থাইরয়েড হর্মোনের স্বাভাবিক মান হল- ট্রাই আয়োডো থাইরোনিন (টিথ্রি)-৬০-১৮০mg/dl , থাইরক্সিন (টিফোর)-৩.২-১২mg/dl, টি এস এইচ-০.৩৫-৫৫miu/ml, রক্তে থাইরয়েড হর্মোনের পরিমাণ কমথাকলে এলট্রিক্সিন (Eltroxin) নামের একটি স্বল্পমূল্যের আলোপ্যাথিক ওষুধ খুবই কার্যকারী। তবে বেশির ভাগক্ষেত্রেই এই ওষুধটি সারাজীবন খেয়ে যেতে হয়।
হোমিওপ্যাথিক মতে লক্ষণ অনুসারে থাইরয়েডিনাম (Thyraidinum), গ্রাফাইটিস (Graphitis), ব্যারাইটাকার্ব (Baryta carb), ফাইটোলক্কা (Phytolacca) প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে সবক্ষেত্রেই চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে চলতে হবে, নতুবা বিপদ বাড়তে পারে।
চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ
বানারহাট, জলপাইগুড়ি-৭৩৫২০২;ফোন:(০৩৫৬৩)৫২৮৯৩

Join our mailing list Never miss an update