সেঁজুতির গোলাপ আজ বিবর্ণ; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ১৬ এপ্রিল ২০১২; পৃষ্ঠা- দশ; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
না, পন্ডিত স্যারের বাড়ির আমড়া সেই গাছটা আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। সে কতদিন আগের কথা। স্কুল ছুটির পর সবাই ছুটতাম সেই গাছের দিকে। গাছের মগডালে ঝুলে থাকা আমড়া পাড়া নিয়ে কত ঢিল ছোড়াছুঁড়ি। যার ঢিলে আমড়া পড়ত সে নোবেল বিজয়ী বীর। মুখে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস।
উত্তরে মাথা তোলা নীল শিবালিক রেঞ্জ। তারই কোল বেয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত চা বাগিচার সবুজ গালিচা। মাঝে ছোট্ট জনপথ বানারহাট। মূলত ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষের নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন চারাগাছ হয়ে মাথা তুলছে গ্রাম গঞ্জে। গড়ে উঠেছে নতুন পল্লিসংঘ, গ্রন্থাগার, স্কুল। প্রাথমিক স্কুলটির সরকারি নাম ছিল বানারহাট স্টেট প্ল্যান প্রাইমারি স্কুল। কিন্তু লোকের মুখে মুখে তা হেডমাস্টার মাখনলাল ব্যানার্জির নাম অনুসারে মাখন বাবুর স্কুল। স্কুলে তিনি ছাড়া আর তিনজন দিদিমণি ছিলেন। মাখনবাবু অঙ্ক শেখাতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অঙ্ক কসে জিজ্ঞাসা করতেন - কীরে বুঝছস? বলতাম বুঝসি স্যার। সঙ্গে সঙ্গে পালটা প্রশ্ন- কী বুঝছস বুঝা ? সে মহা ঝামেলা, ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অঙ্ক করতে হত।
ক্লাস ফোরে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে হাইস্কুলে প্রবেশ। ক্লাস ফাইভ থেকে বিভিন্ন স্মৃতি মোড়া স্কুলবেলা। ইতিহাস পড়াতেন শৈলেন মন্ডল। ক্লাসে হিস্টোরিক্যাল ম্যাপ নিয়ে আসতেন। প্রাণ ঢেলে পড়াতেন। কখনও পলাশীর যুদ্ধ, ঝাঁসির রাণী, কখনও শিবাজির ঝুড়ির মধ্যে পলায়ন...কথা আর প্রাণের আবেগে আমাদের মনের পটে ছবি আঁকতেন। নন্দলালদার ঘন্টা যে কখন বেজে যেত তা টের পেতাম না। বাংলা পড়াতেন সুনীলকুমার চক্রবর্তী। বানারহাট স্কুলের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক। অকৃতদার, গেরুয়া পাঞ্জাবির সঙ্গে চিদম্বরম স্টাইলে সাদাধুতি। জীবনযাত্রা ছিল ঋষিতুল্য। ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরিচিত ছিলেন কবিস্যার হিসাবে। দীর্ঘদেহী, উন্নত নাসা, মাথা ভরা কোঁকড়া চুলের সঙ্গে ছিল তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর। সামনে মাইক্রোফোন দিলেই হল, যেকোনো বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বিকারে বলে যেতেন। তা সে আইনস্টাইনের জন্মদিন হোক বা শিক্ষক দিবস। যে কোনো প্রসঙ্গ উঠলেই সাবলীলভাবে টেনে আনতেন স্বামীজি, নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথকে। কবি, সাহিত্যিক, জননেতাদের বহু অজানা কথা তার মুখে শুনেছি। স্কুলে বাংলা পড়াতেন আর একজন শিক্ষক সুশীলচন্দ্র পাল। কথাবর্তা চালচলনে প্রকৃত অর্থেই সুশীল ছিলেন। সঠিক শব্দ চয়ন করে ধীরে ধীরে কথা বলতেন। পান্ডিত্য ছিল, তবে তার প্রকাশভঙ্গি ছিল অতিমাত্রায় বিনয়ী ও পরিশীলিত। সে সময় ক্রিকেটের এত রমরমা ছিল না, মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়াত ফুটবল। বিভিন্ন স্কুলগুলির মধ্যে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। স্কুল থেকে দল যেত। সঙ্গে দু-তিন লরি চেপে যেত সমর্থকেরা। সে কী উত্তেজনা। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে ছেলেদের নির্দেশ দিতেন সুভাষ স্যার। পারলে নিজেই মাঠে ঢুকে গোল করেন। ছেলেদের ভুলচুকে শুয়ার-হারামি বলে গালিগালাজ করতেন। আবার জিতলে মিষ্টিমুখ।
স্কুল বেলায় ফুটবল তো ছিলই, তার পাশাপাশি ছিল হরেকরকম খেলা। চা-বাগিচার মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম। নাম ছিল উসিকুশি। পাথর বা লোহার চাকতি ছুড়ে দিতে হত নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। তারপর হাতের পাঞ্জা দিয়ে হত মাপঝোপ। সফল হলে পাওয়া যেত সিগারেটের খালি প্যাকেট। আমরা বলতাম ডিগ্গেল খেলা। এছাড়াও ছিল পিট্টু, লাট্টু, দাড়িয়াবান্ধা আরও কত কী। ছুটির দিনে তারের বাঁকানো হাতল দিয়ে দিনভর চাক্কা চালানো।
সে সময় চা বাগান শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য মাঝেমধ্যে বিনাপয়সায় সিনেমা দেখানো হত। মাঠের মাঝে দুটি বাঁশ পুঁতে টাঙানো হত পর্দা, তাতে প্রোজেকটার দিয়ে দেখানো হত ছবি। একটা সিনেমায় চার পাঁচবার ইন্টারবেল। আশেপাশের বাগানে সিনেমা হবে খবর পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে পৌঁছে যেতাম মাঠে। কুলিকামিনদের সঙ্গে মাঠে চটি পেতে বসে যেতাম সিনেমা দেখতে। শেষ দৃশ্যে যখন নায়ক ভিলেনকে ধরে পেটাচ্ছে, আমরাও গলা ফাটিয়ে নায়ককে উৎসাহিত করতাম- ‘আউর মারো, মারো শালাকো , খুন নিকাল দো...।’ রাতে বাড়ি ফিরলে চিত্রনাট্যের কুশীলবেরা বদলে যেত। মেজদি আমাকেই দিত রামধোলাই। কান ধরে শপথ করাতো আর কোনোদিন যাবো না বলে। পরেরবার যথারীতি...। কালীপূজোর সময় চা বাগানের আদিবাসী ছেলেছোকড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরত দেউশি করতে। সোমরা, মোহন, বুধুয়ার দলে আমিও ভিড়ে যেতাম। ঘুরতাম বাবু, মাইজিদের বাড়ি। মাটিতে লাঠি ঠুকে গলা ছেড়ে ছড়া কাটতাম- ‘ঝিলমিলি ঝিক্কা দেউশিরে/ বাবুকা ঘরমা দেউশিরে/ এক্ক পয়সা দেউশিরে...।’ চাল, আলু, পয়সা জুটত, তাই দিয়ে হত ভুরিভোজ। সরস্বতী পুজোর সময় চার-পাঁচদিন ধরে চলত স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উৎসব। সে এক হইহই কান্ড। ছেলেমেয়েদের নাটক, মাস্টার- দিদিমণিদের নাটক, আবৃত্তি, গান, নাচ আরও কত প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন হাতের কাজ ও বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনী হত। মডেল তৈরিতে নেতৃত্ব দিতেন সত্যব্রত বিশ্বাস ও অজিত সরকার। ছয়- সাতটা ঘরজুড়ে থাকত বিজ্ঞান -ভূগোলের জিনিসপত্র। চা বাগান থেকে বাবু- মাইজিরা গাড়ি চেপে আসত সে অনুষ্ঠান দেখতে। ছেলেমেয়েরা নাটকের মহড়া দিত। শ্রেণিশোষণ ও দিনবদলের ভাবনা নিয়ে একের পর এক নাটক। এদেশের মহেশ থেকে ওদেশের লিং-চিং। নাটকের সব সংলাপ অমল স্যারের মুখস্থ। শ্রেণিহীন সমাজের বাসনা ছিল তার ঘুমে জাগরণে। লি সাও চি-র ‘হাই টু বি এ গুড কমিউনিস্ট’ হয়তো অমল স্যার আত্মস্থ করেছিলেন। অমল স্যার ছিলেন প্লেন বি.কম । নিজ আখের গোছানোর পাটিগণিতে পিএইচডি করা কমিউনিস্টরা তখনও সেভাবে বাজারে আসেনি। ব্যাকডেটেড অমল মাস্টার স্বপ্নমেদুর গলায় গানে সুর দিতেন -‘প্রভাতের সূর্যে রাঙা ওই দিগন্ত চক্রবাল/ভয় কী কমরেড, আমাদের প্রিয় রঙ লাল...।’
ভালো ছাত্র নয়। কোনো মতে এক থেকে দশের মধ্যে থেকে যেতাম। ক্লাসে পড়ার বই থেকে উলটোপালটা বইই পড়ার ঝোঁক বেশি ছিল। এরিক মারিয়া রেমার্ক, জুলে ভার্ন, আলেকজান্ডার ডুমা, চালর্স ডিকেন্স, ডেনিয়াল ডিফো, জনাথন সুইফট্, মেরী শেলী, এডগার অ্যালেন পো, লুইস ক্যারল এর লেখাগুলি গ্রোগ্রাসে গিলতাম। বিদেশি সাহিত্য পড়ার নেশা মাথায় ঢুকিয়ে ছিলেন নরেনদাদু। বানারহাট হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষক। সুঠাম চেহারার সঙ্গে মাথায় ছিল চকচকে টাক। আদি বাংলার বরিশালে নিজে একটা স্কুল চালাতেন। তারপর দেশভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছিলেন সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল দাদুর বাড়ি। নরেনদাদুর নাতনি সুজাতা ছিল আমার বাল্য সখী। প্রায় সন্ধ্যাবেলায় দাদু আসতেন আমাদের বাড়িতে চা খেতে। চাঁদনি, কুনু, ছোড়দি সবাই দাদুর কাছে আবদার জানাতাম গল্প শোনানোর জন্য। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো ঘিরে শুরু হতো গল্পদাদুর আসর। গলায় ছিল অসাধারণ মডিউলেশন আর নাটকীয়তা। বাবা-কাকারাও নিজেদের গাম্ভীর্য বজায় রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে সে গল্প শুনতেন। রাত বেড়ে গেলে সুজাতা হাঁকছেড়ে দাদুকে ডাকত। পরের এপিসোডের জন্য চলত প্রতীক্ষা। বইপড়া ছাড়া আবৃত্তি, নাটক করা, বিজ্ঞানের মডেল বানানোর নেশা ছিল। সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, চামচিকা এসব ধরে ফর্মালডিহাইড দিয়ে বোতলে পুড়ে রাখতাম। ব্যাঙ, গিরগিটির চামড়া মাংস থেকে হাড় ছাড়িয়ে সেগুলিকে আবার আঠা দিয়ে জুড়ে কঙ্কালের পূর্ণ অবয়ব দিতাম। একাজে আমাদের গুরুদেব ছিলেন কেষ্টো দা ভালো নাম কৃষ্ণপদ কুন্ডু। বানারহাট হাইস্কুলের ল্যাবরেটরির দায়িত্ব ছিল কেষ্টো-দার ওপর।
সে সময় জাতীয়স্তরের বিজ্ঞান প্রদর্শনী হত। ভারত সরকারের এন.সি.ই.আর.টি এই প্রদর্শনীর আয়োজন করত। জেলাস্তরে যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হত তারা যেত কলকাতায় পূর্বভারত বিজ্ঞান মেলায়। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম ও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চের মাঠে এই আসর বসত। পূর্ব ভারত বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হয়ে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালোরের জাতীয় বিজ্ঞান শিবিরে। অভিভাবক হিসাবে সঙ্গে গিয়েছিলেন শিক্ষক তুষারকান্তি সরকার। এন.সি.ই.আর.টি. এর উদ্যোগে ব্যাঙ্গালোরের লালবাগ গার্ডেনে বসেছিল জাতীয় বিজ্ঞান শিবির। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা জড়ো হয়েছিল এই আসরে। শিবিরের উদ্বোধন করেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। আমার উদ্ভাবিত 'ওয়াটার টেলিস্কোপ' যন্ত্রটি রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী গুন্ডু রাও, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস. বি. চ্যবন, শীলা দীক্ষিত ও আরও অনেকের নজর কাড়ে। হোঁচট খাওয়া ইংরাজিতে কিছুক্ষণ কথা হলো রাষ্ট্রপতির সাথে। রাষ্ট্রপতি আমার আবিস্কৃত ওয়াটার টেলিস্কোপ যন্ত্রটির খুব প্রশংসা করেন।
যেভাবে ক্যালেন্ডার পুরানো হয়, সেভাবেই এক সময় ক্লাস টেন এ পৌঁছে গেলাম কৈশোর থেকে যৌবনে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। তখন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। ফাগুন এল তার রঙের আগুন নিয়ে। বনে নয়, মনে। আকাশটাকে শুধু চোখে রেখে মন হারানোর দিন। গোটা গোটা অক্ষরে রাত জেগে ভালোবাসার স্বপ্নালু চিঠি লেখা। পড়ার বইয়ের ভাঁজে প্রিয়তমার চিঠি রেখে বারবার পড়া। প্রিয়জনকে একটু চোখে দেখার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অপটু ছন্দে কবিতা লেখা। গায়েত্রী দিদিমণির মেয়ে সেঁজুতি এক প্রদশর্নীর সময় দিয়েছে লাল গোলাপ। সে রাতটা বিনিদ্র কেটেছিল। স্কুলের পর কলেজে। কখন যে শৈশব-কৈশোর-যৌবন থেকে সময়ের রেলগাড়ি আমাকে নিয়ে চলেছে বার্ধক্যের অভিমুখে -তা টের পাইনি। সেই লেত্তি, সেই লাট্টু আজ বেপাত্তা। সেঁজুতির দেওয়া সেই গোলাপ আজ হয়তো কোনো বইয়ের ভাঁজে চ্যাপটা বিবর্ণ। বেয়াড়া মনদোতারা তবু যেন পিলু, ইমন কল্যাণের সঙ্গে মাঝে মাঝে বেহাগ বাজায়।