শব্দ ব্রহ্মের মাতামাতি

শব্দ ব্রহ্মের মাতামাতি

শব্দ ব্রহ্মের মাতামাতি; -ডাঃ পার্থপ্রতিম; বর্ষ ৩ সংখ্যা ১০ সোমবার ২৮ আশ্বিন ১৩৯৭;কলকাতা পত্রিকায় প্রকাশিত
পূজার সময় সারা দিনরাত ধরে অবিরাম মাইকের আওয়াজের সাথে বাজি-পটকার প্রলয়ঙ্কর শব্দ মিলে তৈরি হয় এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে কলকারখানা যানবাহন ও বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই অবাঞ্ছিত শব্দ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এক শ্রেণীর বিচারবুদ্ধিহীন লোকের কার্যকলাপও পরিবেশ দূষণ ঘটায়। এরাই আনন্দের অতিশয্যে বাজি-পটকা ফাটায়, জোরে মাইক বাজায় এবং ক্ষতিকারক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
কোন শব্দ কতখানি ক্ষতিকারক তা নির্ভর করে শব্দের চরিত্রের উপর। শব্দ মৃদু বা প্রবল যাই হোক না কেন তার একটা তীব্রতা ও তীক্ষ্মতা আছে। শব্দের তীক্ষ্মতা নির্ভর করে শব্দ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে কতগুলি কম্পন হয় তার সংখ্যার উপর এবং যত বেশি কম্পন হবে শব্দের তীব্রতা বা প্রবলতা শব্দ তরঙ্গের বিস্তার অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গের একশীর্ষ থেকে পরবর্তী শীর্ষ পর্যন্ত দূরত্ব দ্বারা মাপা হয় এবং বিস্তার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। শব্দের আর একটা বৈশিষ্ট্য হল তার গুণ বা জাতি নির্ভর করে শব্দের মূলসুরের সঙ্গে কতগুলি উপসুর জড়িত আছে তার সংখ্যার উপর।

আশেপাশের পরিবেশ থেকে ছোট বড় নানান মাপের কিছু না কিছু শব্দ সবসময় আমাদের কানে ঢুকছে, অবশ্য কানে প্রবেশ করলেই শব্দ শোনা যায় না। যতক্ষণ না মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে বা সেরেব্রাল কটেক্সে প্রতিবেদন সৃষ্টি করে। এটা ঘটে যখন শব্দের যান্ত্রিক শক্তিকে অন্তঃকর্ণের ককলিয়া নামক একটি বিশেষ অঙ্গ তড়িৎশক্তিকে রূপান্তরিত করে শ্রবণস্নায়ু বা অডিটরী নার্ভের মাধ্যমে শ্রবণকেন্দ্রে পাঠায়। সব শব্দ মানুষের মনে অনুভূতি সৃষ্টি করে না, প্রতি সেকেন্ডে ২০ থেকে ২০,০০০ কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পায়। সব চেয়ে কম তীব্রতার শব্দে যখন আমাদের কানে প্রতিবেদন সৃষ্টি হয় তখন তাকে বলে শ্রবণ চেতনার সূত্রপাত। শব্দের জোড় বাড়ার সঙ্গে শ্রবণচেতনাও বৃদ্ধি পায় এবং একটা তীব্রতার সীমারেখা পেরিয়ে যাবার পর বিরুক্তিকর হয়ে ওঠে। শব্দ তরঙ্গের তীক্ষ্মতা ও তীব্রতা যখন কম থাকে সুরযুক্ত হয়ে তখন অনুভূতি সঞ্চার করে। যেমন-পাখির গান, নদীর কলতান ও পাতার মর্মর ধ্বনি। শব্দ মৃদু বা জোরালো যাই হোক না কেন তার একটা নিজস্ব চাপ আছে। শব্দ বিজ্ঞানীরা এই চাপকে মাপেন- ডাইন ডেসিবেল, সোন ইত্যাদি একক দিয়ে। এর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত ও সহজবোধ্য একক হলো ডেসিবেল বা সংক্ষেপে ডিবি।টেলিফোন বাজলে ৭ ডিবি, সাধারণ কথাবার্তা ৩০-৩৫ ডিবি। কর্মব্যস্ত অফিসে ৪০ ডিবি, মোটরের তীক্ষ্ম হর্ন ১০০ ডিবির জোরে বাজানো মাইকের শব্দ ১০৫ ডিবি এবং চকলেট বোমা ফাটলে ১২৫ ডেসিবেল শব্দ হয়। মানুষের শ্রবণসীমা শূন্য ডিবি থেকে ১৩০ ডিবি পর্যন্ত, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়- কোলাহল বা অবাঞ্ছিত শব্দ ৫০ ডিবি অতিক্রম করলে শরীরে ও মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যেমন- কান মাথা ঝাঁঝাঁ করা, মাথা ঘোরা, মাথার যন্ত্রণা, অল্পতে রেগে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপবৃদ্ধি, হৃদপিন্ড ও ফুসফুসের নানা জটিল রোগ প্রভৃতি। বাজি পটকার শব্দ মাতৃগর্ভে ভ্রূণের ক্ষতি করে। গর্ভবতী মহিলারা বাজি পটকার আওয়াজে যদি চমকে ওঠেন, সেই ভয়ের ভাব তাদের জরায়ু যে প্রভাব ফেলে তার ফলে গর্ভাশয়ের জলীয় পদার্থ হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে গর্ভস্থ শিশুর অপরিণত মস্তিস্কে ব্যাঘাত ঘটায়। এর জন্য মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। আমেরিকার ‘ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড ওয়েলফেয়ার’-এর বৈজ্ঞানিকরা সমীক্ষা করে দেখেছেন গর্ভপাত ও অপরিণত শিশু জন্মের জন্য এধরনের আওয়াজ দায়ী। দেখা গেছে শান্ত গ্রামাঞ্চলের চেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরাঞ্চলেই প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মের হার বেশি।
   

গবেষকরা জানিয়েছেন, মাইকের একটানা উচ্চমাত্রিক গান দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট করে দিচ্ছে। মহিলারা সারাদিন একটানা শব্দের মধ্যে থাকলে অবসন্ন বা সোজা ভাষায় ফ্রিজিড হয়ে পড়েন। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টো। অতিরিক্ত শব্দ পুরুষদের সেক্সচুয়াল আর্জ বাড়িয়ে তোলে। এর অবশ্যসম্ভাবী পরিণতি হল স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বনিবনার অভাব।
    বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা-র হিসাবমত মানুষের সহনীয় শব্দমাত্রা দিনে ৪৫ ডিবি ও রাতে ৩৫ ডিবি, অথচ কলকাতার বহু জায়গাতেই শব্দমাত্রা ৭৫ থেকে ৮০ ডেসিবেল। দিল্লির ‘ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরী’র সমীক্ষা অনুযায়ী কলকাতায় যেভাবে শব্দমাত্রা বাড়ছে, তাতে ২০৩৫ সালের মধ্যেই প্রত্যেকটি কলকাতাবাসীর সম্পূর্ণ বধির হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। কোলাহলহীন পরিবেশে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে আমেরিকায় ‘দি নয়েজ কন্ট্রোল অ্যাক্ট অব ১৯৭২ চালু হয়েছে। জাপান ও হল্যান্ডে শব্দদূষণ কমাবার জন্য ‘কলরব কর’ আছে। কানাডাতে তো গৃহপালিত পশুর চিৎকারের জন্য তার প্রভুকে জবাব ও জরিমানা দিতে হয়।
    কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের প্রশাসন ও জনসাধারণ এ বিষয়ে খুব বেশি সচেতন নয়। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠন করে পূজা, উৎসব, নামাজ প্রভৃতিতে মাইকের ব্যবহার বন্ধ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামীকে কাটিয়ে ওঠা দরকার আর বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী বাজি-পটকার বদলে ফুলঝুরি জাতীয় বাজি ব্যবহার করে পরিবেশকে কিছুটা শান্ত রাখা উচিত।

Join our mailing list Never miss an update