যযাতি নারী হলে ইতিহাস অন্যরকম হতো

যযাতি নারী হলে ইতিহাস অন্যরকম হতো

যযাতি নারী হলে ইতিহাস অন্যরকম হতো;  ডাঃ পার্থপ্রতিম; জুন সংখ্যা ২০০৬; পৃষ্টা- ৮৭ 'তথ্যকেন্দ্র' পত্রিকাতে প্রকাশিত

নদীর ঢেউ-এর মতো নারীর যৌবন দ্রুত বয়ে যায়। ফেরে না। কিন্তু বয়ে যাওয়া যৌবনকে যদি সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো ফিরিয়ে আনা যায়! কিংবা ধরে রাখা যায় বদ্ধ জলাশয়ের মতো? প্রায় অবিশ্বাস্য সেই চিকিৎসার কথা শোনাচ্ছেন -ডা.পার্থপ্রতিম।
    কালের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই ক্ষয় হতে থাকে। আমাদের এই নরদেহও প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের বাইরে নয়। আমরা ধরার বুকে ধরা দেওয়ার পর থেকে দেহের মধ্যে চলতে থাকে বিভিন্ন পরিবর্তন। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে আমরা চলতে থাকি বার্ধক্যের অভিমুখে। নারীদেহে যখন বার্ধক্য আসে, তখন বেশ কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়। সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রজঃস্রাব। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মেনোপজ’। এই সময় শরীরের ভেতরে থাকা বিভিন্ন হরমোন্যাল গ্রন্থগুলি তাদের কাজকারবার পালটে ফেলে। ডিম্বাশয় বা ওভারি থেকে বেরিয়ে আসা ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ খুবই কমে যায়। দেখা দেয় বিভিন্ন উপসর্গ। কান, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করা হঠাৎ করে গরম হলকার  অনুভুতি, মিলনকালে যোনিপথ পিচ্ছিল না হওয়া, শরীরী সখ্যতার আকর্ষণ কমে যাওয়া আরও বহু কিছু। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব ঘটতে থাকে।

    ‘হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’, সংক্ষেপে এইচ আর টি নারী জীবনের ঘড়িটাকে খানিকটা পিছিয়ে দিতে পারে। দেহ থেকে চলে যাওয়া বসন্তকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে এই আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি। এইচ আর টি-তে ইস্ট্রোজেন ও তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ প্রোজেস্টেরন প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত চার রকমভাবে এই হরমোন দেহে ব্যবহার করা যেতে পারে।
মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ওরাল মেডিসিন ত্বকের একটি নির্দিষ্ট স্তরে হরমোন ক্যাপসুল ঢুকিয়ে বা সাব-কিউটেনিয়াস, ত্বকের নীচে হরমোন্যাল ইনজেকশন দিয়ে বা ট্রান্সডারমাল এবং যোনিপথে ক্যাপসুল প্রবেশ করিয়ে বা ভ্যাজাইনাল পদ্ধতি। বিগত যৌবনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা ঠিক করি কার জন্য কোন পদ্ধতিতে ওষুধটি প্রয়োগ করা উচিত।
    ওষুধ চালু করার আগে কয়েকটি বিষয় চিকিৎসকেরা খুঁটিয়ে জনে নেন। যেমন, যিনি এইচ আর টি নিতে চান, তিনি মেনোপেজের পর ঋতুস্রাব চান কী না? তার জরায়ু বাদ গিয়েছে বা হিস্টেরকটমি হয়েছে কী না? মা দিদি বা পরিবারের কার কী সমস্যা আছে?
    এখন আমাদের দেশের বাজারে ওই ধরনের ওষুধই পাওয়া যায়। দামও খুব বেশি নয়। খাওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ট্রাডিয়াল ভ্যালেরেট, কনজুগেটেড ইকুইন ইস্ট্রোজেন সালফেট। ত্বকের নীচে ইনজেকশনের  জন্য অর্থাৎ সাবকিউটেনিয়াস ও ট্রান্সডারমালের জন্য ইস্ট্রোডিয়াল কনজুগেটেড ইকুইন ইস্ট্রোজেনস ব্যবহার করা হয়।

    এইচ আর টি শুধু যে আপনার তনুর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সময়কে স্থির করিয়ে দেয় তা নয়, প্রতিরোধ করে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলার দেহে ক্যালসিয়ামের অভাবে ফলে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। ইস্ট্রোজেনের অভাবে অস্থির এই ক্ষয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত হয়। সত্তর বছর বয়সে নারীদেহের ৫০ শতাংশ হাড় ক্ষয়ে যায়। পুরুষের নব্বই বছর বয়সে ক্ষয়ে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ হাড়। সামান্য আঘাতেই হাড় ভাঙে। ভাঙা হাড় সহজে জোড়া লাগে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের  ভাষায় আমরা যাকে বলি অস্টিয়োপোরোসিস। এইচ আর টি অস্টিয়োপোরোসিসকে প্রতিহত করে।
    আমাদের হৃদপিন্ড সারাদেহে রক্ত সরবরাহ করে। আবার হৃদযন্ত্রের কাজ পরিচালনার জন্য তারও পুষ্টি ও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। করোনারি ধমনী রক্তের মাধ্যমে এসব হৃদপিন্ডে পৌঁছে দেয়। হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ হল হৃদপেশির পুষ্টির অভাব। কোলেস্টরল নামের লিপিড করোনারি আর্টারিতে জমে রক্ত চলাচলের রাস্তা সরু করে দেয়। আমরা যাকে বলি অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। নারীদেহে যতক্ষণ ইস্ট্রোজেন হরমোন সক্রিয় থাকে, ততদিন কোলেস্টেরল রক্তনালিতে জমতে পারে না। সে কারণে পুরুষেরা মহিলাদের তুলনায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু মেনোপজের পর রক্তে যখন ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমে  যায়, তখন হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা পুরুষ-মহিলার সমান-সমান। যারা এইচ আর টি নেন তাদের করোনারি ধমনী সংক্রান্ত রোগের সম্ভাবনা প্রায় থাকে না।

    এইচ আর টি-র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়েও ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে বলা যায় একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক এই পদ্ধতিতে যে ভাবে উপকৃত হন, সে তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ খুবই সামান্য। তবে স্তনে ও জরায়ুতে কোনো টিউমার বা সিস্ট যদি থাকে সেক্ষেত্রে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ওষুধপ্রয়োগ করতে হয়। দেখে নেওয়া হয় ক্যানসারের কোনো সম্ভাবনা আছে কী না।
    হরমোন বড়ি খাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হল প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে এটি খেতে হয়। তাছাড়া খাওয়ার ওষুধ অন্ত্র-লিভার-এর দীর্ঘপথ পেরিয়ে রক্তে পৌঁছায়। এতে ওষুধের প্রায় চল্লিশ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে অনেক চিকিৎসক ইস্ট্রোজেন পেটেল রোগিনীর দেহে প্রয়োগ করেন। কুঁচকিতে সামান্য জায়গা অবশ করে চামড়ার তলায় এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অতি ছোট ক্যাপসুলের মত এই ওষুধটি প্রায় নয় মাস কার্যকর থাকে। বিদেশের বাজারে নাকে স্প্রে করার নেজ্যার ইস্ট্রোজেনও বেরিয়েছে।

    স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আরও নতুন সব পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। তবে আসল কথা এই সব অভিনব প্রযুক্তি গ্রহণ করার মতো মানসিকতা এখনো এদেশের মহিলাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। এর কারণ কিছুটা অর্থনৈতিক হলেও বেশিরভাগটাই অজ্ঞতাজনিত ও মানসিক। জীবনকে শেষ দণ্ডপল পর্যন্ত উপভোগ করার মানসিকতা তাদের কোথায়? সবাই তো এলিজাবেথ টেলর বা রেখা নন।

Join our mailing list Never miss an update