সয়াবিন খেলেই হবে

সয়াবিন খেলেই হবে

সয়াবিন খেলেই হবে; ডাঃ পার্থপ্রতিম; ২ সেপ্টেম্বর ২০০৬ শনিবাসর; উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
মেনোপজ পর্বে ঢুকতে চলেছেন বা ঢুকে পড়েছেন এমন মহিলাদের জন্য সয়াবিন দারুণ উপকারী। হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির-র বিকল্প হিসেবে দিনে সত্তর গ্রাম করে সয়াবিনই যথেষ্ট। মেনোপজ পর্বে যেটা হয়, শরীরে ইস্ট্রোজেন নামের যৌন হরমোনের অভাব ঘটে। সেই খামতি পূরনের জন্য বাইরে থেকে হরমোন দেওয়া হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে সামান্য প্রোজেস্টরন বা প্রোজেস্টিন এবং অ্যান্ড্রোজেনও দেওয়া হয়। এই যে বাইরে থেকে যোগানের মাধ্যমে হরমোনের খামতিপূরণ তথা রিপ্লেসমেন্ট, সে কাজটা সয়াবিনে থাকা ফাইটোইস্ট্রোজেন করে থাকে। এক বছর ধরে গবেষণা চালানোর পর জানাচ্ছেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। সয়াবিনে ফাইট্রোইস্ট্রোজেন থাকে প্রচুর পরিমাণে। সাধারণত যে সয়াবিন হামেশাই আমরা খাই, রান্না করা সেই দলা দলা সয়াবিনের প্রতি আধ কাপে থাকে ৫৫ মিলিগ্রাম ফাইটোইস্ট্রোজেন মেলে। ২৫০ মিলিলিটার সয়াবিনের দুধে ২০ মিলিগ্রাম মেলে। আধ কাপ সয়াবিন চিপসে মেলে ৫৪ মিলিগ্রাম। আধ কাপ ড্রাই রোস্টেড সয়াবিনে মেলে ১২৮ মিলিগ্রাম।

আধ কাপ টোফু-তে মেলে ২৮ মিলিগ্রাম। আধকাপ সয় চিজে বা সয়াবিনের ছানায় মেলে ৩১ মিলিগ্রাম। আধ কাপ অর্থাৎ ৭৫ গ্রাম গ্রিন সয়াবিনে (কাঁচায়) মেলে ২০ মিলিগ্রাম। সয় হট ডগে মেলে ১৫ মিলিগ্রাম। সয়াবিন দিয়ে তৈরি দুপুর/রাতের সম্পূর্ণ খাবারে মেলে ১৬০ মিলিগ্রাম। রান্না করা টেম্পোতে মেলে ৫৩ মিলিগ্রাম। সয়ামিল্ক স্কিনে মেলে ৫১ মিলিগ্রাম।
মেনোপজ পর্বে মুখ, কান গরম হয়ে যায়। এই হটফ্লাশের কারণে মুখমন্ডল লাল হয়ে যায়। রাতদুপুরে দরদর করে ঘাম হয়ে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না, যোনীর ভেতরটা শুকিয়ে যায়, প্রস্রাব চেপে রাখতে পারা যায় না। বারবার প্রস্রাব হতে থাকে, সব সময় একটা নিঃসঙ্গতা বোধ তথা এক ধরনের বিপন্নতা, ডাক্তারি পরিভাষায় এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম হয়ে থাকে। ভাল লাগছে না, আমার বেঁচে থেকে আর কী হবে- কারো কারো মধ্যে এরকম মানসিকতাও তৈরি হয়ে যায়। শরীরে ইস্ট্রোজেন-এ খামতি শুরু হয়ে গেলে, ইস্টোজেনের উৎসে ভাটা পড়ে গেলে হাড়ের ক্ষয়জনিত অসুখ তথা অস্টিওপোরোসিস হতে শুরু করে। তাই বেঁকে যাওয়া ঠাকুমা বা দিদিমাকে আর সোজা করা যায় না। সময় যাতে এভাবে আপনাকে বাঁকিয়ে না দিতে পারে তার জন্যই দরকার ইস্ট্রোজেনের খামতি মেটানো। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সেই মেনোপজ হয়, তার আগে হয় না এমন নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজও হয়ে থাকে। ৪০ বছরের কম বয়সে বরাবরের জন্য মেনোপজ বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি শারীরিক সমস্যা হয়। তাই যাঁরা এতদিন সয়াবিনের প্রতি মনোযোগী হননি, তাঁরা এবারে সয়াবিন পাতে নিন, সয়াবিনের নানা পদ খেতে শুরু করে দিন।
সয়াবিন রক্তের উচ্চচাপ কমায়। রক্তে বাজে চর্বির মাত্রা বাড়ায় না। একশো গ্রাম সয়াবিন খেলে শরীর ৪৩২ ক্যালোরি শক্তি পায়। পরিণত সাধারণ সয়াবিনে দুই শতাংশের মতো ফ্যাট থাকে। রাজমা-তে থাকে দেড় শতাংশের মতো।

অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যৌনাঙ্গ শুকিয়ে যাওয়া, বুকের নানা রোগ-টোগ, পিঠে ব্যথা, হাড়ে ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রেও শুশ্রুষাকারী হিসেবে সয়াবিনের ব্যাপক ভূমিকা। তবে একটাই কথা, নিয়মিত সয়াবিন খেয়ে যেতে হবে। মেনোপজ হয়নি যাঁদের, তাঁরা যাঁরা মেদ কমানোর জন্য সয়াবিন খেয়ে চলছেন, সয়াবিন মেদ কমে এই ধারণাটা একটু বদলাতে হবে। কারণ, সয়াবিনে মেদ কমে না, সামান্য হলেও বাড়ে। এই সামান্য বাড়াটাকে ব্যায়ামের মাধ্যমে কমিয়ে ফেলতে হবে। তবে সয়াবিন খাওয়া কিছুতেই ছাড়া যাবে না। শরীর ও মনের স্বার্থরক্ষার তাগিদেই। আর একটা কারণেও সয়াবিন আমাদের অধিকাংশের খাওয়া উচিত, তা হল চাহিদামতো প্রোটিন আমাদের শরীর তো কোনদিনই পায় না। অথচ সয়াবিনের একশো গ্রাম প্রোটিন থাকে প্রচুর। ৪৩.২ গ্রাম। ফ্যাট ১৯.৫ গ্রাম। খনিজপদার্থ থাকে ৪.৬ গ্রাম। শ্বেতসার থাকে ২০.৯ গ্রাম। ক্যালসিয়াম ২৪ মিলিগ্রাম। ফসফরাস থাকে ৬৯০ মিলিগ্রাম। লোগা থাকে ১০.৪ মিলিগ্রাম। ম্যাগনেসিয়াম থাকে ১৭৫ মিলিগ্রাম। ম্যাঙ্গানিজ, জিংক থাকে যথাক্রমে ২.৩৫ ও ৪.৪ মিলিগ্রাম করে। সয়াবিনে মেলে সব ধরনের অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। যাঁরা কম ফ্যাটওয়ালা সয়াবিন নাগেটস অর্থাৎ নিউট্রিলার প্যাকেটে যেমন থাকে, তেমন সয়াবিন খান, ফ্যাট ১০০ গ্রামে মাত্র ২ গ্রাম। পুরুষের শুক্রাশয় থেকে যেমন অ্যান্ড্রোজেন নিঃসৃত হয়, তেমনই মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে নিংসৃত হয় ইস্ট্রোজেন। অ্যান্ড্রোজেনের  মূল কাজ যৌন অঙ্গগুলির বিকাশ ঘটানো এবং পুরুষের গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য যথা দাড়ি, গোঁফ, পুরুষালি চেহারা গঠনে সহায়তা করা। এই হরমোনের অভাবের কারণে পুরুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসায় টোস্টোস্টেরন হরমোন ও তার কতকগুলি সংশ্লেষিত সমতুল ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

পুরুষদের অ্যান্ড্রোজেনের মতোই ইস্ট্রোজেন মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত হয়। এই হরমোন যৌনাঙ্গের বিকাশ এবং মেয়েদের গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনের অভাবে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। এছাড়া অস্টিওপোরোসিস, চর্মরোগ, মানসিক সমস্যা, হৃদরোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি হতে পারে। এইসব সমস্যায় নানা ধরনের সিন্থেটিক ইস্ট্রোজেন ব্যবহার করা হয়। ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত অপর হরমোনটি হল প্রোজেস্টিন। এর মূল কাজ জরায়ুকে সন্তান ধারণে সক্ষম করা। সিন্থেটিক প্রোজেস্টিন বিভিন্ন স্ত্রীরোগ এবং গর্ভপাতের সমস্যায় ব্যবহার করা হয়।
    একটা কথা জানিয়ে রাখি, জাপানের মেয়েরা চট করে বুড়িয়ে যান না। চিরতারুণ্যে ভরপুর তাদের জীবন। মূলে কে জানেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ইস্ট্রোজেনের খেলা। তবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ইস্ট্রোজেন নয়, প্রাকৃতিক ভান্ডারে জমে থাকা ফাইটোইস্ট্রোজেনে ওদেশের মেয়েদের অনন্ত যৌবনের মূল চাবিকাঠি। জাপানিদের খাবারে সয়াবিন থাকবেই। ৫০ বছর ধরে আমেরিকা থেকেও সয়াবিন যাচ্ছে জাপানে। বিভিন্ন ধরনের ডাল, সয়াবিন, সবজি ও টাটকা ফল হল প্রাকৃতিক ফাইটোইস্ট্রোজেনের অফুরন্ত ভাঁড়ার। তাই যাদের রোজকার খাবারের তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও সয়াবিন থাকে, তারা মেনোপজ জনিত সমস্যা এড়াতে পারেন। সর্বোপরি সার্বিক সুস্থ ও নীরোগ দীর্ঘজীবন পেতে নিয়মিত সয়াবিন, টাটকা শাক-সবজি, ফলমূল ও দুধ খেয়ে যেতে হবে। কেননা, ক্যালসিয়ামও মেয়েদের শরীরে সমান প্রয়োজনীয় উপাদান।
    বরাবরের জন্য নিয়মিত ঋতুচক্র থেমে গেলেই যে হরমোন থেরাপি করাতে হবে তা কিন্তু নয়। মহিলাদের মধ্যে যাদের নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, তাদেরই প্রয়োজন হয় এইচ. আর. টি। অবশ্য সব থেকে বেশি হরমোন থেরাপি প্রয়োজন হয় তাঁদের, যাঁদের নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই হরমোনের উৎস শুকিয়ে যায়। আর কাদের দরকার হয়?               

Join our mailing list Never miss an update