পটকা-বাজির হাজারো বিপদ; ডাঃ পার্থপ্রতিম। ২১ অক্টোবর ১৯৯২বুধবার; ওভারল্যান্ড পত্রিকায় প্রকাশিত
প্রতিবারের মত এবারও এসে গেলে কালীপূজা-দীপাবলী। দীপাবলী মানেই আলোর রোশনাই, বাজি-পটকার ঝলকানি। এখন অনেক আনন্দ-উৎসবে পটকা পোড়ানোর রীতি প্রচলিত হয়েছে ঠিকই, তবে বাজি-পটকা থেকে হাজারো রকম বিপদ দেখা দিতে পারে। অনেকক্ষেত্রেই আনন্দের অতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ নিরানন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পটকা-বাজি থেকে বিপত্তির প্রধান দিকগুলি হল।
রা সা য় নি ক দূ ষ ণ
বাজি বা পটকার মধ্যে থাকে একটি সহজদাহ্য মিশ্রণ, যেটি বাতাসের অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। আসলে অক্সিজেনের যোগান দেওয়ার জন্য বাজির মিশ্রণে থাকে সোরা বা পটাসিয়াম নাইট্রেট (KNO3) অথবা কোনও-কোনও ক্ষেত্রে পটাসিয়াম ক্লোরেট (KCLO3)। এই যৌগ দু’টিতে আগুন লাগলেই তা থেকে অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। দাহ্যপদার্থ হিসাবে বাজির মধ্যে থাকে কাঠকয়লার গুঁড়ো, গন্ধক বা সালফার।
তারাবাজি, ফুলঝুরি, তুবড়িতে স্ফুলিঙ্গ বা ফুলকি তৈরির জন্য সীসার যৌগ, অ্যালুমিনিয়াম ও লোহার গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক বছর হল বাজারে এসেছে রঙ-বেরঙের আলো সৃষ্টি করা বাজি। এসব বাজিগুলিতে বিভিন্ন রঙের আলোর জন্য বিভিন্ন ধাতব লবণ ব্যবহার করা হয়। যেমন-অ্যান্টিমনি ও আর্সেনিক যৌগ থাকে বলে তুবড়ির আলো হয় উজ্জ্বল সাদা। বেরিয়ামের লবণ সবুজ, সোডিয়াম সল্ট হলুদ, পটাসিয়ামের লবণ হালকা সাদা ও তামার সল্ট নীল আলো তৈরি করে।
বাজি-পটকাতে যে জ্বালানি সালফার ও কার্বন থাকে তা পুড়ে সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস তৈরি হয়। সালফার-ডাই-অক্সাইড শ্বাসনালী ও ফুসফুসে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি করে। এই গ্যাস বৃষ্টির জল ও কুয়াশার সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এসব অ্যাসিড ত্বকের ক্ষতি করে। তবে সে পরের কথা। কার্বন মনোঅক্সাইড ফুসফুসের মধ্য দিয়ে প্রাণীর রক্তের সাথে মিশে পরিণত হয় সুস্থির কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিনে। ফলে জীবকোষে ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ হতে পারে না। এজন্য মাথাধরা, ক্লান্তিভাব ও আরও বহু উপসর্গ দেখা দেয়।
বাজি-পটকার মিশ্রণের সীসা বা লেড অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্তাল্পতা, দেহের অঙ্গগুলির অসাড়তা দেখা দিতে পারে। দেখা গেছে, শিশুদের ক্ষেত্রে সীসার বিষক্রিয়া বেশি। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলও সীসার মতোই। আর্সেনিক থেকে দুরারোগ্য চুলকানি, যকৃতের গোলযোগ দেখা দেয়। অনেক ফিজিওলজিসের মতে, আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম, বেরিয়াম, প্রভৃতি ধাতু আমাদের শরীরের জৈবিক ক্রিয়া চালানোর জন্য অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এদের মাত্রা বাড়লে শরীরে দেখা দেয় নানা অসুবিধা। বাজির ধোঁয়ার সঙ্গে এসব পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়, তারপর রক্তে মেশে। অনেকসময় অসাবধানতাবশত বাজির বারুদ পেটে চলে যায়, সেক্ষেত্রে অ্যালার্জি ও পেটখারাপ হয়ে থাকে।
বাজি-পটকা পোড়ানো মানেই আগুন নিয়ে খেলা। কাজেই আগুনের ছ্যাঁকা লাগতেই পারে।এমনকি আগুনে পুড়ে জীবন সংশয়ও হয়। শিশুদের এই বিপত্তি বেশি ঘটে।
আনন্দের অতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ/ নিরানন্দের কারণ হয়ে দাঁড়ায়
শ ব্দ দূ ষ ণ
পটকা-বাজির সবচেয়ে মারাত্মক দিক হল শব্দদূষণ। পটকার আমচকা জোরালো আওয়াজ ক্ষতিকারক পরিবেশ সৃষ্টি করে। কোনও শব্দ কতখানি ক্ষতিকারক তা নির্ভর করে শব্দের চরিত্রের ওপর। শব্দ মৃদু বা প্রবল যাই হোক না কেন, তার একটা তীব্রতা (Loudness) ও তীক্ষ্নতা (lntensity আছে। শব্দের তীক্ষ্নতা নির্ভর করে শব্দতরঙ্গের কম্পাঙ্ক (Frequency) অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে কতগুলি কম্পন হয় তার সংখ্যার ওপর এবং যত বেশি কম্পন হবে শব্দের তীক্ষ্নতাও তত বাড়বে। শব্দের তীব্রতা ও প্রবলতা শব্দতরঙ্গের বিস্তার অর্থাৎ শব্দতরঙ্গের একশীর্ষ থেকে পরবর্তী শীর্ষ পর্যন্ত দূরত্ব দ্বারা মাপা হয়। বিস্তার বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে তীব্রতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে।
আশপাশের পরিবেশ থেকে ছোট-বড় নানান মাপের কিছু না কিছু শব্দ সবসময় আমাদের কানে ঢুকছে, অবশ্য কানে প্রবেশ করলেই শব্দ শোনা যায় না। যতক্ষণ না মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্র বা সেরিব্রাল কর্ট্রেক্স (Cerebral Cortex) প্রতিবেদন সৃষ্টি করে। এটা ঘটে যখন শব্দের যান্ত্রিকশক্তিকে অন্তঃকর্ণের ককলিয়া (Cochlea) নামের একটি বিশেষ অঙ্গ তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে শ্রবণস্নায়ু বা অডিটরিনার্ভের মাধ্যমে শ্রবণকেন্দ্রে পাঠায়। সব কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ মানুষের কানে অনুভুতি সৃষ্টি করে না, প্রতি সেকেন্ডে ২০ থেকে ২০,০০০ কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পায়।
শব্দ মৃদু বা জোরালো যাই হোক না কেন, তার একটা নিজস্ব চাপ আছে। শব্দের চাপ তীব্রতার সঙ্গে সমানুপাতিক। বিজ্ঞানীরা এই চাপকে মাপেন-ডেসিবেল, ডাইন, সোনা ইত্যাদি একক দিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও সহজবোধ্য একক হল ডেসিবেল বা সংক্ষেপে ডিবি। ক্রিং-ক্রিং করে টেলিফোন বাজলে ৭ ডিবি, সাধারণ কথাবার্তা ২৫-৩০ ডিবি, কর্মব্যস্ত অফিসে ৪০ ডিবি, জোরে বাজানো মাইকের শব্দ ১০০ ডিবি, চকলেট বোমা ফাটালে ১২০-১৩০ ডিবি শব্দ হয়। মানুষের শ্রবণসীমা শূন্য ডিবি থেকে ১৪৫ ডিবি পর্যন্ত, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়- কোলাহল বা অবাঞ্চিত শব্দ ৫০ ডিবি অতিক্রম করলে শরীর ও মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
যেমন- কান মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে, মাথাঘোরা, মাথায় যন্ত্রণা, অল্পতে রেগে যাওয়া, ক্ষুদামান্দ্য, রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদপিন্ড ও ফুসফুসের নানা জটিল রোগ প্রভৃতি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র হিসাবমতো সাধারণ মানুষের সহনীয় শব্দমাত্রা দিনে ৪৫ ডিবি ও রাতে ৩৫ ডিবি। ১৬০ ডিবির বেশি শব্দ কানের পর্দা (Tympanic membrane) ফাটিয়ে দেয়।
বাজি-পটকার অচমকা শব্দ মাতৃগর্ভে ভ্রূণেরও ক্ষতি করে। গর্ভবতী মহিলারা বাজি পটকার আওয়াজে যদি চমকে ওঠেন, তবে সেই ভয়ের ভাব তাঁদের জরায়ুতে প্রভাব ফেলে। তার ফলে গর্ভাশয়ের জলীয় পদার্থ (Amniotic Fluid) হঠাৎ সংকুচিত হয়ে গর্ভস্থ শিশুর অপরিণত মস্তিষ্কে ব্যাঘাত ঘটায়, এর জন্য জন্ম হতে পারে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর। আমেরিকা সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অব্ হেল্ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার’- এর বিজ্ঞানীরা সমীক্ষা করে দেখেছেন গর্ভপাত ও অপরিণত শিশুজন্মের পিছনে এ ধরনের আওয়াজই দায়ী।
গবেষকেরা আরও জানিয়েছেন, মাইকের একটানা উচ্চমাত্রিক গান ও বাজি-পটকার বিকট শব্দ দাম্পত্য সম্পর্ককেও নষ্ট করে দিচ্ছে। মহিলারা জোরালো শব্দের মধ্যে থাকলে অবসন্ন ও কামশীতল (Frigid) হয়ে পড়েন। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উলটো। অতিরিক্ত শব্দ পুরুষের কামবেগ (Sexule desire) বাড়িয়ে তোলে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বনিবনার অভাব। দীপাবলীর দিনগুলিতে শব্দদূষণ কিছুটা কমানোর জন্য বিকট আওয়াজ সৃষ্টিকারী পটকা-বাজির বদলে ফুলঝুরি, তুবড়ি জাতীয় বাজি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই প্রস্তাব কিছুটা মন্দের ভাল।
বাজি-পটকার আচমকা শব্দ মাতৃগর্ভে ভ্রূণেরও ক্ষতি করে। গর্ভবতী মহিলারা বাজি-পটকার আওয়াজে যদি চমকে ওঠেন, তবে সেই ভয়ের ভাব তাঁদের জরায়ুতে প্রভাব ফেলে।
অ ন্যা ন্য বি প দ
বাজি-পটকা পোড়ানো মানেই আগুন নিয়ে খেলা। কাজেই আগুনের ছ্যাঁকা লাগতেই পারে। এমনকি আগুনে পুড়ে জীবন সংশয়ও হয়। শিশুদের এই বিপত্তি বেশি ঘটে। তাই হাতের কাছে ফার্স্ট এইড বক্স রাখতে পারলে ভালো। আগুনে পুড়ে গেলে প্রথমে পোড়া জায়গাটি কিছুক্ষণ ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে রাখুন। ক্ষত স্থান বড় হলে স্যালাইন জল বা ফোটানো ও ঠান্ডা করা জল ধীরে-ধীরে ঢালতে থাকুন। এবার শুকনো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে জলটা সাবধানে মুছে নিতে হবে যাতে ফোস্কা না ফেটে যায়। কোনও অ্যান্টিসেপটিক মলম পোড়া জায়গায় লাগিয়ে গজ বা ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিন। তারপর ডাক্তারবাবুদের পরামর্শমতো টিটেনাস ইনজেকশন নিতে পারেন। এবং ব্যাথা কমাবার ওষুধ (অ্যাসপিরিন, প্যারাসিটামল...) ও ঘুমের বড়ি, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। (অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ করে)।
বাজি পেড়ানোর সময় সাবধানে না থাকলে আগুনের ফুলকি বা বাজির মধ্যে থাকা বারুদ চোখে এসে পড়তে পারে। এমন হলে সঙ্গে-সঙ্গে চোখে ঠান্ডা পরিষ্কার জলের ঝাপটা দিন। কিছুক্ষণ অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন। চোখ একদম রগড়াবেন না। ব্যান্ডেজ বা গজ ও চোখের ওপর সামান্য তুলো দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত চোখটিকে বন্ধ করে ঢেকে রাখুন। চোখ আমাদের দেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার ছাড়া আর কেউ ওষুধ দিয়ে ডাক্তারি করতে যাবেন না।
সা ব ধা ন তা
১. সিন্থেটিকের ঢিলেঢালা পোষাক পরে বাজি পোড়াবেন না। সুতির আঁটোসাঁটো এমন পোষাক পরুন যা প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি খুলে ফেলা যায়।
২. ভিড়ের কাছাকাছি বাজি পোড়াবেন না। বাজি ফাটান ফাঁকা জায়গায়, খোলা ছাদে বা বাড়ির উঠানে।
৩. বাচ্চাদের নাগালের মধ্যে বাজি রাখবেন না। লক্ষ্য রাখবেন বাচ্চারা যেন একা-একা বাজি না পোড়ায়।
৪. দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিপদ রকেট বা হাইউ বাজি থেকে। হাউই জ্বালানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে বাজিটি ঠিকমতো খাড়া থাকে। উলটোপালটা জায়গায় গোঁত্তা না মারে।
৫. বাজি পোড়ানোর জায়গায় জল রাখবেন। আধপোড়া বাজি জল দিয়ে নিভিয়ে দিন।
৬. একটু পরিষ্কার তুলো দু’কানে গুঁজে রাখুন, যাতে বাজির শব্দ বেশি অসুবিধা না ঘটাতে পারে।
৭. নাক ও মুখ পাতলা ভেজা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতে পারেন। এতে বাজি পটকার ধোঁয়া সরাসরি দেহে ঢুকতে পারবে না।
৮. ড্যাম্প লাগা বাজি পোড়াবেন না। আগে থেকে বাজি রোদে দিয়ে ভালভাবে শুকিয়ে নিন।
৯. বাজি পোড়ানোর আগে বাচ্চাদের নখ কেটে দেবেন। একটা লম্বা কাঠির মাথায় বাজি বেঁধে ছোটদের পোড়াতে দেবেন।
১০. হঠাৎ বাজির মুখোমুখি পড়ে গেলে দু’হাতে কান চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে রাখবেন।