মশা দমনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন

মশা দমনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন

মশা দমনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন; ডাঃ পার্থপ্রতিম। জানুয়ারি ১৯৮৯; জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত
এক জনৈক কবি গভীর আক্ষেপে রাবীন্দ্রিক অনুকরণে লিখে ছিলেন-
        মশা আমার, মশা ওগো
            মশায় শহর ভরা
        মশা পরাণ খাওয়া, আমার
            মশা শয়ন হারা
        ওষুধ বিষুধ ধুনোর ধোওয়া
            মিথ্যে খরচ করা
যে সকল পতঙ্গ রোগ সংক্রামণের দ্বারা মহামারী সৃষ্টি করে মশা তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয় মশার দংশন আমাদের সুখনিদ্রা ও কাজকর্মে সমান ব্যাঘাত ঘটায়। বিশাল এই ‘প্রাণী জগতে মানুষের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মশা’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৪২৫০ মিটার উপরেও যেমন মশা দেখা যায়, তেমনি আবার খনিগর্ভের ১২৪০ মিটার নিচেও মশার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই পৃথিবীতে মশার প্রজাতির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।
মশা যে কত প্রকার রোগের সংক্রামন করতে পারে, তার সকল তথ্য এখনো অজানা। তবে মোটামুটিভাবে যেটুকু জানা যায় তার মধ্যে প্রধান হলো-(১) ম্যালেরিয়া [Malaria],(২) ফাইলোরিয়াসিস [Filariasis],(৩) ডেঙ্গু জ্বর [Dengu Fever](৪) পীতজ্বর [Yellow Fever], (৫) এনকেফ্যালাইটিস  (৬) ডার্মাটেবিয়া [Dermatobia], (৭) চিকুনগুনিয়া [Chikum-guniya]।
মানুষ ও গবাদী পশুর বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী মশক কূলের ধ্বংস সাধনই রোগ নিয়ন্ত্রণ এর একমাত্র উপায়। পরিণত মশা ধ্বংস ও লার্ভা বিনাস এই পদ্ধতিতে মশার দমনের চেষ্টা করা হয়। পরিণত মশা ধ্বংসের কাজে D.D.T., D.D.D.,  লিনডেন, ডাইএলড্রিন, প্যারাথিয়ন, D.D.T. র ১০% জলীয় দ্রবণ; লার্ভা বিনাসে ম্যালারিওল, ট্রিটন, B১৯৫৬, ন্যাপকো১২১৬, প্যারিপ্রীন ও D.D.T-র জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।
এইসব আর্গেনোক্লোরিক ইনসেকটিসাইড [Insecticid] ক্রমাগত ব্যবহার করার ফলে বহু প্রজাতির মশার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এই কীটনাশক যৌগগুলি প্রাণীদেহের চর্বির ভেতরে থেকে বহুকাল ধরে বিষক্রিয়া ঘটায়। এখনকার পৃথিবীতে এমন কোন স্থান নেই যেখানে  D.D.T  নেই। এমন কোন জীব নেই যার দেহকোষে D.D.T  নেই। আলাস্কার হিমবাহে মেরু ভাল্লুকের  দেহে, এমন কী দক্ষিণমেরুর পেঙ্গুইন পাখীর দেহেও D.D.T  পাওয়া গিয়েছে। ভারতেই প্রতিবছর ১০০ জন লোক প্যারাথিয়নের [Parathion] বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বরণ করে [Sir R. Corson in ``silent spring] । সেই কারণে সাম্প্রতিককালে উন্নতশীল কয়েকটি দেশে কীটনাশকের ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে- যুক্তরাষ্ট্রে D.D.T-র ব্যবহার নিষিদ্ধ।

উত্তরাধিকার বিভাগ ও প্রজনন বিদ্যার উপর জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জেনেটিক কন্ট্রোল [Genetic Control] মশা দমনের এক নতুন  দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। জেনেটিক কন্ট্রোলের তিনটি প্রধান পদক্ষেপ-(১) ভারসাম্যহীন মিলন [Cytoplasmic incompatability] সাধারণত: এক অঞ্চলের পুরুষ মশা অন্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে মশার জন্মহার কমানো যায়। কারণ এক প্রজাতির মশা অন্য প্রজাতির মশার সঙ্গে মিলনে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করতে অক্ষম। (২) পুরুষ মশা নির্বীজকরণ [Sterile male technique] গবেষণাগারে প্রচুর পরিমাণ, ( সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন ) পুরুষ মশাকে রাসায়নিক বস্তু [যেমন- থিয়োটেপা Thiotepa] দ্বারা নির্বীজ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্ত্রীমশা জীবনে মাত্র একবারই যৌন মিলনে পুরুষ মশার সংস্পর্শে আসে। সেই কারণে নির্বীজ পুরুষ মশার সঙ্গে মিলনে বহু স্ত্রী মশা গর্ভবতী হবার সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়। (৩) ক্রোমোজোমের গঠন বদলে মশাকে ছেড়ে দিলে ওদের মিলনের পর আঞ্চলিক মশাকীদের বন্ধাত্ব্য আসে। এই সকল প্রচেষ্টা ভারতবর্ষে দিল্লী অন্যান্য কতগুলি এলাকায় বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থা [WHO]ও ভারতীয় মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল [ICMR]-এর যৌথ উদ্যোগে প্রয়োগের চেষ্টা চলছে।
বর্তমানে মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণে (Biological Control) বিজ্ঞানীরা সচেষ্ট হয়েছেন। ক্যালিফনিয়ায় কার্ন ভিস্ট্রিক্ট ডঃ লেনহপ ও তাঁর সহযোগী ডঃ লি (Dr.lee) হাইড্রাকে মশার প্রাকৃতিক শত্রু হিসেবে ব্যবহার করে সাফল্য লাভ করেছেন। হাইড্রা শুধু মশার লার্ভাকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না, কর্ষিকা বা নিমাটোসিস্টেট আঘাতে প্রচুর সংখ্যক শূককীট মারতে সক্ষম। বিজ্ঞানীদ্বয় হাইড্রার আস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধির উপায় উদ্ভাবন করেছেন।
তেচোখা, খলিসা, তেলাপিয়া, গাপ্পি প্রভৃতি মাছ প্রচুর সংখ্যক মশার শূক খেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের  মাছ গ্যাম্বসিয়া অ্যাফিনিস মশক লার্ভা ধ্বংসে বিশেষ পারদর্শী। এই মাছ বিভিন্ন প্রকার জলে ও পরিবেশে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে, তাছাড়া এদের বংশবৃদ্ধির হারও দ্রুত।

জলফড়িং (Dragon fly)-এর লার্ভা মশার লার্ভাকে এবং পূর্ণাঙ্গ জলফড়িং পূর্ণাঙ্গ মশাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তাছাড়া ডাইনিফড়িং (Mantis) মশা শিকার করে। ব্যাঙ, মাকড়সা, বাদুর, টিকটিকি, গিরগিটি, মে-ফ্লাই প্রভৃতি প্রাণীও মশার প্রাকৃতিক শত্রু। এই সকল প্রাণীর সুসংরক্ষণ প্রয়োজন।
কলসপত্রী উদ্ভিদ (Nepenthes) ঝাঁঝি (Utricucularia), সূর্যশিশির (Drosera), প্রভৃতি উদ্ভিদ তাদের রূপান্তরিত পাতার (Fly-trag) সাহায্যে মশা ও বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গ ধরে তাদের দেহের নির্যাস শোষণ করে নিজেদের প্রোটিন খাদ্যের অভাব মেটায়।
দিল্লীর ‘ন্যাশানাল ইনসটিটিউট অব কমিউনিকেবল ডিজিজেস (NICD) ও  I.C.M.R  কিছু কীট নিয়ে গবেষণা করেছেন যারা মশার ডিম ও শিশু মশাকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এই সব পদ্ধতির সুষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে মশা দমন সহজসাধ্য হবে।  

Join our mailing list Never miss an update